• ঢাকা
  • সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১০:১২ পূর্বাহ্ন

অবহেলিত জনগোষ্ঠির কল্যাণে কাজ করছেন সাবিরা নীলা(ভিডিও)


প্রকাশের সময় : জুলাই ১৬, ২০১৯, ১১:১৬ AM / ১৮৩
অবহেলিত জনগোষ্ঠির কল্যাণে কাজ করছেন সাবিরা নীলা(ভিডিও)

সোনিয়া দেওয়ান প্রীতি : যুগে যুগে ঘর-সংসারের বাইরে নারী তার কর্ম জগতে রেখে চলেছে সফলতার স্বাক্ষর। নিজে সাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে চলেছে তারা। আজ আমরা এমনই একজন নারীকে নিয়ে কথা বলছি, যিনি প্রায় ২ যুগ ধরে উদ্যোক্তা হিসেবে তার মানবতা, দক্ষতা, ধৈর্য্য ও একাগ্রতা দিয়ে সমাজের অসংখ্য অবহেলিত নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছেন।

শুরুটা ছিল ১৯৯৫ সালের দিকে। প্রবল আগ্রহ নিয়ে সেই সময় টুকটাক কাজ শেখা, বিভিন্ন ট্রেনিং-কোর্স করা, এরপর ১৯৯৮ সালে ‘রং মেলা বুটিকস’ দিয়ে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় সাবিরা সুলতানা নীলার। ২০১৫ সালের ২ জুলাই থেকে ‘রং মেলা নারী কল্যান সংস্থা’ প্রতিষ্ঠা করার মধ্যদিয়ে প্রায় অর্ধশত নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে চলেছেন তিনি।

শুধুমাত্র সমাজের অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিতদেরই নয়, কারাগারের সাজাপ্রাপ্ত বন্দীদেরও বিভিন্ন বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষন দিয়ে আত্মকর্ম সংস্থানের লক্ষ্যে তাদেরকে প্রতিষ্ঠিত করে চলেছেন এই নারী। যেনো আইনের দণ্ড ভোগ শেষে কারাগারের বাইরের জীবনে গিয়ে তারা আর অপরাধ জগতে পা না বাড়ায়, নিজেরা এসব কাজ করে অর্থ উপার্জন করে যেনো পরিবার পরিজন নিয়ে সাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে।

এক সময়ের শখের বসে শূন্য হাতে সেলাই মেশিন নিয়ে পথচলা শুরু করা নীলা আজ একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। এর সর্বোচ্চ স্বীকৃতি স্বরুপ পেয়েছেন তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে জাতীয় পুরস্কার এবং এর আগে জয়িতা পুরস্কার সহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পদক।

বাবা মো. আলম ও মা রেহেনা বেগমের সংসারে বড় কন্যা সন্তান নীলা। নিজেও এখন ৩ সন্তানের জননী। ৯৫ সালে গার্মেন্টস ব্যবসায়ী মো. রাকিব হোসেনের সাথে পারিবারিক ভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ওই বছরই নারায়ণগঞ্জ সরকারী তোলারাম কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে বি.এ(ডিগ্রি) সম্পন্ন করেন তিনি। এরপরই সংসারের পাশাপাশি শুরু হয় তার কিছু একটা করার পথ চলা। চলতে থাকে একদিকে নিজে প্রশিক্ষিত হওয়ার চেষ্টা, অপরদিকে সমাজের সুবিধা বঞ্চিত ও দুর্বলদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলা। ১৯৯৮ সালে উত্তর চাষাঢ়ার ৫১নং বাড়িতে নিজ ঘরেই গড়ে তুলেন ‘রং মেলা বুটিকস’ নামে একটি আত্মকর্মসংস্থান মূলক প্রতিষ্ঠান। নেমে পড়েন ব্যবসায়। প্রথমদিকে সামান্য আয় থাকলেও আত্মপ্রত্যয়ে বিভোর নীলা অবহেলিত নারীদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় সমাজেরই নানা অপপ্রচার ও তাকে নিয়ে সমাজের নানা কটু কথাকে তোয়াক্কা না করে মাঠে নামেন। সে উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়ন করার প্রচেষ্টায় নিজেকে আরো সক্রিয় করে গড়ে তুলেন। একে একে নিজেকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গড়ে তুলতে শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে সেলাই, ব্লক বাটিক, কম্পিউটার, ফুড প্রসেসিং ও বিউটিফিকেশন সহ পর্যায়ক্রমে প্রতিটি বিভাগে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। কাজের দক্ষতা বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়তে থাকে তার আত্মবিশ্বাস।

সেই দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাসের আলোকে ব্যবসার পরিসর বৃদ্ধি করার জন্য ২০০৩ সালে যুব উন্নয়ন থেকে মাত্র ২৫ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করেন এবং ওই বছরই সেই ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম হন তিনি। তারপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি নীলাকে। প্রথমে বিনা খরচে ব্লকবাটিক, ফুড প্রসেসিং ও বিউটিফিকেশনস এর উপর সমাজের বিভিন্ন অবহেলিত নারীদের প্রশিক্ষণ দেন। সেই সময় তার বাৎসরিক আয় ছিল ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। তারপর সাভার ওয়ার্ল্ড ভিশনের আওতায় ২০০৩ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার নারীদের প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলেন তিনি। পরম মমতায় নিয়মিত প্রশিক্ষন দেন তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠিকেও।

বর্তমানে তার সংগঠন থেকে সেলাই-কাটিং, ব্লক বাটিক, এম্বুস, স্প্রে, সিরামিক, ডায়মন্ড সিরামিক, হ্যান্ড এম্বব্রয়ডারি, পুঁথির তৈরি বিভিন্ন শোপিস ব্যাগ, বনসাই, পটারি, ঝর্না, গ্লাস পেইন্ট, পাটের কাজ, কাপরের ফুল, ওয়ালমেট, বিউটিফিকেশন, চামড়ার দ্রব্যাদি সহ ৩২টি বিষয়ের উপর প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন সাবিলা নীলা।

নিজ সংস্থার বাইরে বর্তমানে তিনি ‘কারুকুঞ্জ সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে’র একজন প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারে বিগত ২ বছর যাবত কারাবন্দি নারী-পুরুষদের বিনামূল্যে এসব বিষয়ের উপর বিভিন্ন প্রশিক্ষন দিয়ে চলেছেন। যেনো তারা পারিবারিক জীবনে ফিরে গিয়ে পরিবার ও সমাজে অনবদ্য ভূমিকা রাখতে পারে।

নারী হিসেবে ঘরের বাইরে এত বড় পরিসরে কাজ করতে গিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে কতটুকু? এমন প্রশ্নে সাবিরা নীলা বলেন, একজন নারীর এগিয়ে যাবার পথে প্রথম বাঁধা তার সমাজ। সমাজের লোকজন যখন নারীদের বাইরের জগতে কাজ করার ব্যাপারে বাঁকা চোখে তাকায়, কানাঘোষা করে, তখন প্রতিটা নারীর উচিত সেইসব বিষয়কে তোয়াক্কা না করে নিজের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া। নিজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারলে সমাজই একদিন সেই নারীকে মূল্যায়ন করবে। যেমনটা হয়েছে আমার জীবনে। যখন শুরুর দিকে কাজ করতাম, তখন পরিবার ও সমাজের অনেকের কটুকথার স্বীকার হয়েছি। কিন্তু থেমে থাকিনি। আজকে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার পেয়েছি। সেইসব অনুষ্ঠানের প্রথম নিমন্ত্রন কার্ডগুলো আমি তাদেরকেই আগে দেই। ফলে তারাও এখন চিন্তা করেন যে- নীলা কাজ করেছে বলেই আজ এমন সম্মানের অধিকারী হয়েছে। যেটা তারা আগে ভাবতে পারেনি। সুতরাং আমি বলব যে- সমাজ যাই বলুক না কেনো, নারীদের থেমে থাকলে চলবে না।

বাংলাদেশের প্রান্তিক নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পেছনে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে অর্থ ও দিক নির্দেশনার অভাব। এই যে সমাজের নানা বাধা বিপত্তির স্বীকার হয়েও অবহেলিত একটা বিশাল জনগোষ্ঠির কল্যাণে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন এই প্রথিতযশা নারী, এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা কতটুকু পেয়েছেন? এমন প্রশ্নে নীলা জানালেন- ‘আমি মনে করি সামাজিক উন্নয়নে আরো অনেক অসামান্য অবদান রাখতে পারব যদি সরকারি ভাবে সহযোগিতা পাই। সামাজিক সহযোগিতা পেলে অনেক অসাধ্যকে সাধ্য করে তোলা সম্ভব। বিশেষ করে আমার প্রতিষ্ঠানের জন্য সরকারি কোনো পরিত্যাক্ত জায়গার সুবিধা পেলে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলতে চাই। যেখানে অবহেলিত ও দুস্থ-অসহায় নারীদের গড়ে তুলতে পারবো আত্মনির্ভরশীল হিসেবে। এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি গড়ে তুলতে পারলে পথ শিশুদের উন্নয়নে কাজ করতে চাই। যারা হেলা অবহেলায় নেশার জগতে তলিয়ে যাচ্ছে। সেইসব শিশুদের দেখাতে চাই আলোর পথ। গড়তে চাই তাদের জন্য সুন্দর ভবিষ্যৎ। কিন্তু বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে ঘুরে বার বার চেষ্টা করেও এখনো পর্যন্ত তেমন কোনো সুবিধাই পাচ্ছিনা।’’

নীলা মনে করেন শুধুমাত্র ঘরে বসে না থেকে প্রতিটা নারীরই আর্থিকভাবে নিজেকে সাবলম্বী করে তোলা আমাদের আজকের পৃথিবীতে খুব বেশি প্রয়োজন। তার মতে- ‘আর্থিকভাবে আত্মনির্ভরশীল একজন নারীর সামাজিক মর্যাদা এবং শুধুমাত্র ঘরের কাজ করা নারীর সামাজিক মর্যাদার মধ্যে বেশ পার্থক্য রয়েছে। আর তাই প্রতিটা নারীরই আত্মনির্ভরশীল হওয়া উচিত। কেননা আর্থিকভাবে আত্মনির্ভরশীল এবং উপার্জনশীল হলে পরিবার তথা সমাজে নারীর মর্যাদা আরো বেড়ে যায়। তাই প্রতিটা নারীরই ঘরে বসে না থেকে অর্থ উপার্জনে কিছু না কিছু করা উচিত

সাবিরা সুলতানা নীলার স্বপ্ন- জীবনের অন্তীম মুহুর্ত পর্যন্ত তিনি সমাজের অবহেলিত জনগোষ্ঠির কল্যাণে কাজ করে যেতে চান। প্রতিটি ঘরে ঘরে আত্মনির্ভরশীল ও আত্মপ্রত্যয়ী নারীদের গড়ে তুলতে চান।

ভিডিও সংবাদটি দেখতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন- 

https://www.youtube.com/watch?v=AiFPX1Ug4kM&t=5s

 

 

(ঢাকারনিউজ২৪.কম/এসডিপি/১১:১৫এএম/১৬/৭/২০১৯ইং)