• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৯ অপরাহ্ন

আমুদে রাজার গল্প


প্রকাশের সময় : জুন ২৩, ২০১৮, ১১:১৬ PM / ৩৪
আমুদে রাজার গল্প

দিলীপ গুহঠাকুরতা : এক দেশে একদা একজন রাজা ছিলেন। রাজা দেখতে যেমন সুন্দর, সুপুরুষ – তেমনি ছিলেন খুব আমুদে। অনেক বিষয়ে তিনি বুদ্ধিদীপ্ত রসিকতা করতে পছন্দ করতেন। সেই সাথে তিনি ছিলেন স্বভাব কবি। পারিপার্শিক যে কোন বিষয় নিয়ে তিনি মুখে মুখে ছড়া বা ছন্দোময় কবিতা রচনা করতে পারতেন। অন্যদিকে তিনি ছিলেন সৎ, ধার্মিক, দয়াশীল। প্রজারা তাঁকে ভীষণ ভালোবাসতো।

একজন রাজা যতই জনপ্রিয় হন, এরপরেও তাঁর শত্রুর অভাব হয় না। রাজার একজন দূর সম্পর্কের ভাই অনেকদিন ধরে ফন্দিফিকির খুঁজতে থাকে কী করে রাজাকে কতল করা যায়। কিন্তু রাজা যেভাবে তাঁর মন্ত্রী, রাজকর্মচারি, পারিষদবর্গ, নিরাপত্তা সৈন্যদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকেন, তাঁকে হত্যা করা সহজ কাজ নয়।

রাজার অভ্যাস ছিলো প্রতিদিন নরসুন্দর দিয়ে দাড়ি কামানো। সেইমতে প্রতিদিন সকালে রাজবাড়িতে নাপিত এসে রাজার দাড়ি কামিয়ে যায়। শত্রু-ভ্রাতা অনেক চিন্তা করে বুদ্ধি আঁটে, ঐ নাপিতকে কেন টাকার লোভ দেখিয়ে বশ করি না! নাপিত দাড়ি কামানোর ছলে ধারালো ক্ষুর রাজার গলায় বসিয়ে দেবে । তাহলেই কেল্লা ফতে। সবাই ভাববে রাজা দাড়ি কামানোর সময় হঠাৎ নড়াচড়ায় নাপিতের ক্ষুর হাত ফসকে রাজার গলায় বসে গেছে। পুরাতন নাপিতকে কেউ সন্দেহ করবে না।

শত্রু তার পরিকল্পনামাফিক নাপিতের দ্বারস্থ হয়। বিশাল অংকের ইনামের লোভে নাপিত রাজি হয়ে যায়। পরদিন সকাল। অঘ্রাণ মাস। শীত শীত আমেজ। মৃদুমন্দ বাতাসে রাজার মেজাজ খুব ফুরফুরে। রোজকার মতো নাপিত রাজার বাড়িতে আসে। রাজা আরাম করে উচ্চ আসনে বসেন। নাপিত মোটা শ্বেতবস্ত্র দিয়ে শীতের চাদরের মতো করে রাজার শরীর জড়িয়ে নেয়। এরপর ভালো করে রাজার গালে গলায় চিবুকে ব্রাশ দিয়ে সাবান মেখে বেশ ফেনা তৈরি করে। গলার কাছে একটু বেশি সাবান মাখে, যেন জায়গাটা নরম তুলতুলে হয়। এরপর ক্ষুর চালাতে গিয়ে ভাবে, ধারটা মনে হয় ঠিকমতো নেই। গলা কাটার জন্য আরো একটু বেশি ধারালো হলে ভালো। এইভেবে মেঝেতে বসে নাপিত শানপাথরে ক্ষুর ঘষে ঘষে শান দিতে শুরু করে। ভাবে, কিছুক্ষণের মধ্যে রাজ্যের প্রিয় রাজা তার হাতে খুন হয়ে যাবেন। পাপী মন। বুক কাঁপছে। ভয়ে হাত কাঁপছে। উত্তেজনায় সে ভুলে গেছে, শান দিতে গেলে পাথরে জলের ছিটে দিতে হয়।

রাজা চেয়ে চেয়ে নাপিতে কর্ম দেখছেন আর অপেক্ষা করছেন, শান দেয়া শেষ হলে কখন দাড়ি কামানো শুরু হবে। জলের ছিটে দিতে নাপিত ভুলে গেছে তাও রাজার চোখ এড়ায়নি। তাছাড়া জল বিহীন পাথরে ক্ষুরের ঘসায় ছন্দে ছন্দে একটা ঘস ঘস শব্দ তৈরি হচ্ছে। সেই পরিবেশে রাজার মন কাব্যময় হয়ে যায়। তিনি মুখে মুখে দু’লাইন ছড়া বানিয়ে নাপিতকে শোনান –

ক্ষুর ঘষে দিচ্ছো শান – দাওনি পাথরে জল,
জানি তুমি কাহার তরে করছো এমন ছল।

চোরের মন পুলিশ পুলিশ। রাজার ছড়া শুনে নাপিত ভয়ে আঁৎকে ওঠে – রাজা কি তাহলে জানতে পেরেছেন আজ এই শান দেয়া ক্ষুর দিয়ে রাজার গলা কাটার পরিকল্পনা হয়েছে !

ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে নাপিতের হাত থেকে ক্ষুর পড়ে যায়। নাপিত হাউ মাউ করে কেঁদে রাজার দু’পা জড়িয়ে ধরে। কান্নাজড়িত কন্ঠে নাপিত রাজার কাছে ষড়যন্ত্রের কথা সব স্বীকার করে।

এরপর আর কী! শত্রুকে পাকরাও করা হয়। জনসম্মুখে তার গর্দান যায়। মুখে মুখে ছড়া রচনার নেশায় আমুদে রাজার প্রাণ বেঁচে যায়। দেশের মানুষ নিশ্চিত বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়া রাজাকে নিয়ে ধন্য ধন্য করে।

পাদটিকাঃ ছোটবেলা আমাদের একজন প্রিয় দাদু ছিলো। পিরোজপুরে আমরা যে বাড়িতে ভাড়া থাকতাম সেই বাড়ির মালিকের পিতৃদেব। গৌড় বর্ণের। দন্তহীন হলেও মুখখানা ছিলো খুব সুন্দর। ছানি পড়া চোখে প্রায় কিছুই দেখতে পেতেন না। বয়স আশির বেশ উপরে। অপরাহ্ণে বাড়ির বৌ-ঝিরা যখন বৈকালিক ঘুমে কাতর, তখন তিনি বেশ শব্দ করে দু’বার কাশি দিতেন। আমরা ছোটরা বুঝে যেতাম, দাদুর এই কাশি একটি সিগন্যাল, যার ভাবার্থ – ‘এই দাদুরা, তোরা গল্প শুনবি। তবে চলে আয়’। আমরা পরিমরি করে দাদুর কাছে ছুটে যেতাম। দাদু গল্প শুরু করতেন। এমনি করে দাদুর কাছে আমরা অনেক গল্প শুনেছি। যখন গল্প শুনতাম, সবাই যেন কল্পনার জগতে চলে যেতাম। গল্পের পাত্র-পাত্রী-পরিবেশ আমাদের কল্পনার চোখে ছবির মতো ভেসে উঠতো। উপরে গল্পটা সেই দাদুর কাছে শোনা। এত বছর পরে আমার বর্ণনায় হয়তো কিছুটা হেরফের হয়ে থাকতে পারে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সড়ক ও জনপথ বিভাগ

(ঢাকারনিউজ২৪.কম/আরএম/১১:১০পিএম/২৩/৬/২০১৮ইং)