• ঢাকা
  • সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:৪৫ পূর্বাহ্ন

সংকটে কুমিল্লার খাদি শিল্প


প্রকাশের সময় : ফেব্রুয়ারী ১, ২০১৭, ৮:৩৯ AM / ৩৮
সংকটে কুমিল্লার খাদি শিল্প

 

ঢাকারনিউজ২৪.কম, কুমিল্লা : কুমিল্লার ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে খাদি শিল্প। এক সময় খাদি দেশের সংগ্রামী ও দারিদ্র মানুষের পোশাক হিসেবে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে দেশ-বিদেশে এই খাদি কাপড়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যসহ সকল দেশে খাদির কাপড় বেশ জনপ্রিয়। তবে এক সময়ের জনপ্রিয় এই পোশাক কাঁচামাল, কারিগর ও ব্র্যান্ডিংয়ের অভাবে পড়েছে মহাসংকটে। হস্ত শিল্পের খাদি কাপড় এখন হারাচ্ছে বাজার। খাদিকে তার এ অবস্থা থেকে তুলে আনতে প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তার দাবি জেলার সংশ্লিষ্টদের।

খাদি ব্যবসায়ী ও কারিগরদের ইতিহাস থেকে জানা যায়, শতবর্ষের ঐতিহ্যের খাদি আলোচনায় আসে ১৯২১ সালে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময়। তখন মহাত্মা গান্ধীর আহ্বানে সমগ্র ভারত বর্ষে অসহযোগ আন্দোলনের সময় কুমিল্লায় খাদি শিল্প প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সেই সময় বিদেশি পণ্য বর্জন করার ডাক উঠে। সর্বত্র এক আওয়াজ ‘মোটা কাপড়-মোটা ভাত’। সেই মোটা কাপড় এখন মিহি হয়েছে। কাপড়ে লেগেছে নান্দনিকতার ছোঁয়া। কুমিল্লার খাদি এখন শৈল্পিকতার ছোঁয়ায় দেশ-বিদেশে সমাদৃত হচ্ছে। খাদির কাপড় যাচ্ছে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। এ সুনাম অর্জিত হয়েছে বহু বছর ধরে অনেক কারিগর আর ব্যবসায়ীর অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, খাদি কাপড়ের সঙ্গে কয়েকটি দিক জড়িত রয়েছে। তা হচ্ছে তাঁতি, সুতা কাটুনি, ব্লক কাটার ও রঙের কারিগর। সবাই মিলে তৈরি করেন নান্দনিক খাদি কাপড়। বর্তমানে কুমিল্লা জেলায় দেড় হাজার পরিবার এই পেশায় জড়িত। মহানগরে খাদি কাপড়ের রয়েছে শতাধিক দোকান। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর কুমিল্লা শাখা থেকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রত্যাহার করা হলে খাদি শিল্পে বিপর্যয় নেমে আসে। তবে খাদি শিল্পের এ বিপর্যয় বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৫২ সালে ড. আখতার হামিদ খানের চেষ্টায় এবং তৎকালীন গভর্নর ফিরোজ খান নুনের সহযোগিতায় কুমিল্লার অভয়াশ্রমে দি খাদি এন্ড কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়।

কুমিল্লা মহানগরের স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ‘অভয় আশ্রম’ এর কর্মীদের প্রচেষ্টায় কুমিল্লার আশ-পাশের গ্রামগুলোতে হাতে সুতা কাটা ও হস্তচালিত তাঁতের ব্যবহার ব্যাপকভাবে শুরু হয়। বিশেষ করে কুমিল্লা জেলার চান্দিনা উপজেলার মাধাইয়া। দেবীদ্বার উপজেলার বরকামতা, সাইতলা, বাখরাবাদ। দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুর। মুরাদনগর উপজেলার রামচন্দ্রপুর, রামকৃষ্ণপুর, ঘোড়াশাল, ময়নামতি, জালালপুর এলাকায় হস্তচালিত তাঁত শিল্পের প্রসার ঘটে। এই তাঁত শিল্পকে কেন্দ্র করে কুমিল্লার বিভিন্ন এলাকার মানুষ সুতা কাটার পেশায় জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু বর্তমানে কাঁচামাল সংকট, কারিগর সংকট, পরিশ্রমের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া ও ব্র্যান্ডিংয়ের অভাবে খাদি পোশাক তৈরির সংখ্যা কমছে।

গ্রামীণ খদ্দর ভাণ্ডারের সত্ত্বাধিকারী রঞ্জিত দেবনাথ জানান, খাদির চাহিদা অনুসারে তাঁতি ও সুতা কাটনি না থাকায় এই শিল্প হারিয়ে যেতে বসেছে। এমনকি অনেকে তাঁত বন্ধ করে দিয়ে অন্য পেশার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। আমরা বাপ-দাদার ঐতিহ্যের পেশা হিসেবে এখনও কাপড় বুনছি। সুতা ও তুলার দাম বাড়ায় আমরা বর্তমানে বেকায়দায় পড়ছি।
আরেক খাদি দোকানদার হরণ দেবনাথ জানান, শ্রমিক তার পরিশ্রমের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, সুতার অভাব, কারিগর সংকট, কাঁচামাল সংকট এবং ব্র্যান্ডিংয়ের অভাবে কুমিল্লার খাদি তার ঐতিহ্য হারাচ্ছে। এমনকি খাদির পোশাক তৈরির কারখানা দিন দিন কমছে।

নগরীর লাকসাম রোডের খাদি স্টোরের মালিক তপন পাল জানান, খাদি শিল্পের প্রসারে মাঠ পর্যায়ে প্রান্তিক খাদি শিল্পীদের সঠিকভাবে জরিপ করে অসুবিধা-অসুবিধা জেনে তাদেরকে সংগঠিত করা উচিত। এমনকি কুমিল্লা মাটির সাথে মিশে থাকা এই ঐতিহ্যকে টিকাতে স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।

কুমিল্লা মহানগরীর খাদি কাপড়ের প্রবীণ ব্যবসায়ী খাদিঘরের সত্ত্বাধিকারী প্রদীপ কুমার রাহা জানান, বর্তমানে খাদি শিল্পে অনেক নতুন নতুন ডিজাইন এসেছে, কারণ ১৯২১ সালের প্রেক্ষাপট ও চাহিদা এক নয়। কুমিল্লা খাদি শিল্পের একটা শক্ত ভীত আছে। শতবর্ষের খাদি পণ্য তার গুণগত মান বজায় রেখে আধুনিকতার সংমিশ্রণে প্রতিযোগিতার বাজারে চাহিদা ধরে রেখেছে। পৃথিবীর যেখানে বাঙালি কমিউনিটি আছে সেখানে খাদি কাপড়ের প্রসার ঘটেছে। বাংলাদেশের বিদেশি দূতাবাসে খাদিসহ দেশিয় পণ্যের প্রদর্শনী করলে তা পণ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটাবে।

কুমিল্লা জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘বর্তমানে খাদির যে হারে চাহিদা বেড়েছে সেই চাহিদা মিটাতে হলে মেশিনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হস্তশিল্প টিকে থাকতে পারবে না। তাই খাদির ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে হলে যেভাবে হোক, মুক্ত বাজারে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকতে হবে। আমরা তালিকা করতেছি জেলায় কতগুলো হস্তশিল্প খাদি কারখানা আছে। সেই অনুসারে তাদের সঙ্গে কথা বলে কিভাবে খাদি শিল্পকে নতুন উদ্যমে শুরু করা যায় সেই চিন্তা করছি।’

(ঢাকারনিউজ২৪.কম/আরএম/৮:৩৫এএম/১/২/২০১৭ইং)