• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ০১:৩৫ অপরাহ্ন

ফের হিসাব মান লংঘন, প্রতারনায় নেমেছে জাহিন স্পিনিং


প্রকাশের সময় : জুলাই ২০, ২০১৮, ১১:৩৭ PM / ৪৫
ফের হিসাব মান লংঘন, প্রতারনায় নেমেছে জাহিন স্পিনিং

সোহাগ চৌধূরী বিজয় : সকল নিয়মকে বৃদ্ধাআঙ্গুলি প্রর্দশন করে প্রাথমিক গণ প্রস্তাবের ন্যায় জাহিন স্পিনিং এবার বাংলাদেশ হিসাব মান (বিএএস) লংঘন করে শেয়ারবাজার থেকে রাইট ইস্যুর মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করতে যাচ্ছে। এছাড়া প্রতারনার আশ্রয় নিয়েছে জাহিন স্পিনিংয়ের পরিচালনা পর্ষদ। তারা নিজেদের শেয়ার বিক্রয় ও হস্তান্তরের পরে রাইট ইস্যুর জন্য আবেদন করে। এছাড়া কোম্পানিটি নিয়মিত বোনাস শেয়ার দেওয়া সত্ত্বেও রাইট শেয়ার ইস্যু করতে যাচ্ছে। অথচ আইপিও এবং বোনাস শেয়ারে নিয়মিত মূলধন বৃদ্ধি সত্ত্বেও কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) ও বিক্রয় কমেছে। এ যেন এক মগের মুললুগ।

এই বিষয়ে জাহিন স্পিনিংয়ের কোম্পানী সচিব মহিন উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের কোম্পানী সুনামের সঙ্গেই বাজারে আছে। রাইট শেয়ার ইস্যুর ক্ষেত্রে ভুল-ভ্রান্তি হতে পারে। আমরা চেষ্টা করেছি সঠিকভাবেই করতে। ছোট ভুল এড়িয়ে গণমাধ্যমের সহায়তা চান তিনি ।

বাংলাদেশ হিসাব মান (বিএএস) ৩৩ এর ৬৪ অনুযায়ি, পূর্বের বছরের শেয়ারপ্রতি মুনাফা নির্ণয় করতে হয় বর্তমান শেয়ার দিয়ে। এবং হিসাব মানে রিস্টেড ইপিএস বলে কিছু নেই। কিন্তু জাহিন স্পিনিং কর্তৃপক্ষ ইপিএস গণনায় এই হিসাব মান অনুসরন করেনি।

রাইট অফার ডকুমেন্টসের ১৯ পৃষ্টায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ইপিএস গণনায় ২০১৭ সালের ৩০ জুনের শেয়ারকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। যাতে ০.৮৯ টাকার ইপিএসকে বাড়িয়ে ১.০৩ টাকা দেখানো হয়েছে। একইভাবে ৪৩ পৃষ্টায় ২০১২ সালে ২.১৯ টাকা, ২০১৩ সালে ০.৬৭ টাকা, ২০১৪ সালে ০.৫২ টাকা ও ২০১৫ সালে ০.২৪ ইপিএস টাকা বেশি দেখানো হয়েছে। এছাড়া ২০১৬ সালের প্রথমার্ধে ইপিএস ০.০৮ টাকা বেশি দেখানো হয়েছে।

অন্যদিকে হিসাব মানে এমন কিছু না থাকলেও জাহিন স্পিনিং কর্তৃপক্ষ ১৯ ও ৪৩ পৃস্টায় রিস্টেড ইপিএস দেখিয়েছেন।

কোম্পানিটির পর্ষদ শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ প্রদানের ক্ষেত্রেও চালাকির আশ্রয় নেয়। কোম্পানিটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েই ২০১৪ সালের ব্যবসায় ১৫ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করে। কিন্তু অর্থবছর জুলাই-জুনকে কেন্দ্র করে ২০১৫ সালের প্রথমার্ধে কোন লভ্যাংশ দেয় না। এরপরে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১৫ শতাংশ লভ্যাংশ দেয়। অর্থাৎ ২০১৪ সালের পরবর্তী দেড় বছরে ১৫ শতাংশ লভ্যাংশ দেয়।

কোম্পানিটির রাইট শেয়ারে পরিচালকদের আগ্রহ না থাকলেও সাধারন বিনিয়োগকারীদের মাঝে ইস্যু করবে জাহিন স্পিনিং। এ কোম্পানির পরিচালকেরা নিজেদের শেয়ার কমিয়ে রাইট ইস্যু করতে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় রাইট ইস্যুর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

আইপিওতে ১২ কোটি টাকা সংগ্রহের পরে ৬৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা মূলধনের জাহিন স্পিনিংয়ে পরিচালকদের মালিকানা দাড়ায় ৪৪.৩৮ শতাংশ। তবে এখন কমে এসেছে ৩১.১০ শতাংশে। এরমধ্যে পরিচালক সাদিয়া আমিন পদত্যাগ করেছেন। যার শেয়ার ধারন ছিল ৩.৮৩ শতাংশ। এ হিসাবে বর্তমান পরিচালকেরা কোম্পানিটির ধারনকৃত ৯.৪৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রয় করে দিয়েছেন।

চেয়ারম্যান ফরিদা খানমের আইপিও পরবর্তী জাহিন স্পিনিংয়ের শেয়ার ধারন ছিল ৭.৫৯ শতাংশ। তবে তা এখন কমে দাড়িঁয়েছে ৫.৭৪ শতাংশে। এছাড়া ব্যবস্থাপনা পরিচালক এএম বদরুজ্জামান খশরুর ১৮.০৩ শতাংশ থেকে কমে ১৩.৬৩ শতাংশে, পরিচালক মাহমুদুর রহমানের ১১.১১ শতাংশ থেকে কমে ৮.৪০ শতাংশে ও নুশরাত জাহানের ৩.৮৩ শতাংশ থেকে কমে ৩.৩৩ দাড়িঁয়েছে শতাংশে।

পরিচালক ফরিদা খানম ২০১৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ৭.৩৮ লাখ শেয়ার তার ছেলে মাহবুবুর রহমানের খানের কাছে হস্তান্তর করে। একইদিনে বদরুজ্জামান খশরু ১৭.৫২ লাখ শেয়ার তার মেয়ে মাসুমা খানের কাছে ও মাহমুদুর রহমান তার বোন মাসুমা খানের কাছে ১০.৮০ লাখ শেয়ার হস্তান্তর করে।

পরিচালকেরা এই শেয়ার বিক্রয় ও হস্তান্তরের পরে ২০১৭ সালের ৩০ এপ্রিল রাইট শেয়ার ইস্যুর ঘোষণা দেয়।

শেয়ারবাজারে আসার সময় জাহিন স্পিনিংয়ের পরিশোধিত মূলধন ছিল ৫২ কোটি ৮০ লাখ টাকা। আর ২০১৫ সালে আইপিওতে ১২ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। এরমধ্যে ব্যবসা সম্প্রসারনে ১০ কোটি ৮০ লাখ টাকা ও আইপিওতে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যবহার করা হয়। তবে কোম্পানিটির ব্যবসায় সম্প্রসারণ হয়নি।

কোম্পানিটি এবারও ব্যবসায় সম্প্রসারণের নামে ১টি সাধারন শেয়ারের বিপরীতে ১টি রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে ৯৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা সংগ্রহ করতে চায়। যা দিয়ে এবারও ব্যবসায় সম্প্রসারন করবে বলে জাহিন স্পিনিংয়ের দাবি। এছাড়া চলতি মূলধন ও ঋণ পরিশোধের কাজে ব্যবহার করা হবে।

এদিকে শেয়ারবাজার থেকে উত্তোলিত টাকা ব্যবহারের আগেই কোম্পানিটির পর্ষদ ২০১৪ সালের ব্যবসায় ১৫ শতাংশ হারে ৯ কোটি ৭২ লাখ টাকার বোনাস শেয়ার ইস্যু করে। এরপরে ২০১৫ সালের ব্যবসায় ১৫ শতাংশ হারে ১১ কোটি ১৮ লাখ টাকা ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ব্যবসায় ১৫ শতাংশ হারে ১২ কোটি ৮৫ লাখ টাকার বোনাস শেয়ার ইস্যু করে। যাতে বর্তমানে কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ দাড়িঁয়েছে ৯৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।

ব্যবসায় উন্নতি করার লক্ষে নিয়মিত বোনাস শেয়ার প্রদান করলেও তা সম্ভব হয়নি। বরং মুনাফা কমেছে। যাতে শেয়ারহোল্ডাররা লাভবান হতে পারেনি। এছাড়া কোম্পানিটির শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের চাহিদা কম থাকার কারনে বাজার দরও কমে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা আশাহত।

শেয়ারবাজারে আসার সময় কোম্পানিটির ২০১৪ সালের প্রথমার্ধে ইপিএস হয়েছিল ১.০১ টাকা। তবে কোম্পানিটির ২০১৬-১৭ এর পুরো অর্থবছরে হয়েছে ১.৩৯ টাকা। আর চলতি বছরের ৯ মাসে হয়েছে ১.০৬ টাকা। অর্থাৎ কোম্পানিটির ইপিএসে উন্নতির পরিবর্তে পতন হয়েছে।

এদিকে ব্যবসায় সম্প্রসারণের লক্ষ্যে আইপিও এবং বোনাস শেয়ারের মাধ্যমে ইক্যুইটি বা নিট সম্পদের পরিমাণ দ্বিগুণ করা হলেও তার কোন প্রতিফলন নেই। কোম্পানিটির আইপিওকালীন ইক্যুইটির পরিমাণ ছিল ৬৬ কোটি টাকা। যা দিয়ে ২০১৪ সালের প্রথমার্ধে বা ৬ মাসে বিক্রয় বা আয় হয়েছিল ৪৪ কোটি টাকার। তবে সেই ইক্যুইটি ১২১ কোটি টাকায় উন্নিত হলেও ২০১৬-১৭ পুরো অর্থবছরে বা ১২ মাসে বিক্রয় হয়েছে ৮৭ কোটি টাকার। এক্ষেত্রে সময়ের হিসাবে বরং ১ কোটি টাকার বিক্রয় কমেছে।

এদিকে কোম্পানিটির চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে ইপিএস কমেছে ৯ শতাংশ। এ অর্থবছরের ৯ মাসে ইপিএস হয়েছে ১.০৬ টাকা। যার পরিমাণ আগের অর্থবছরের ৯ মাসে হয়েছিল ১.১৭ টাকা। এছাড়া কোম্পানিটির চলতি অর্থবছরের ৩ মাসে ইপিএস হয়েছে ০.২৬ টাকা। যার পরিমাণ আগের অর্থবছরের ৩ মাসে হয়েছিল ০.৩০ টাকা। এ হিসেবে ইপিএস কমেছে ০.০৪ টাকা বা ১৩ শতাংশ।

এর আগে কোম্পানিটি প্রসপেক্টাসে গোজামিল তথ্য দিয়ে শেয়ারবাজার থেকে আইপিওতে টাকা সংগ্রহ করে। কোম্পানিটি শেয়ারবাজারে আসার আগে ২০১২ সালে ৫০ শতাংশ কর অবকাশ পায়। কিন্তু কোম্পানি কর্তৃপক্ষ বাকি ৫০ শতাংশ কর প্রভিশনিং বা ব্যয় দেখায়নি। যেখানে কোম্পানিটি ২০১২ সালে প্রায় ১৪ লাখ ৫২ হাজার টাকার কর না দিয়ে রাজস্ব ফাকি দিয়েছে। অপরদিকে করবাবদ ব্যয় না দেখিয়ে একই পরিমান মুনাফা বেশি দেখায়।

২০১৪ সালে নতুন ক্রয় করা ইলেকট্রিক্যাল ইক্যুপমেন্টের উপর অবচয় চার্জ না করে জাহিন স্পিনিং কর্তৃপক্ষ ‘বিএএস-১৬’ লঙ্ঘন করে। যেখানে যোগ হওয়া সম্পদের উপর অবচয় চার্জ না করে ৪৮৪২৬ টাকার মুনাফা বেশি দেখানো হয়। আর একই পরিমান সম্পদ বেশি দেখানো হয়েছে।

শ্রম আইন পালন না করেও প্রসপেক্টাসে ৩২ লাখ ৬৫ হাজার টাকার মুনাফা বেশি দেখায়। এর মাধ্যমে কোম্পানিটি শ্রমিকদের সাথে প্রতারণা ও আইনের প্রতি অবজ্ঞা করে।

(ঢাকারনিউজ২৪.কম/এসডিপি/১১:৩৫পিএম/২০/৭/২০১৮ইং)