• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ০৭:০৫ অপরাহ্ন

৭২ এর সংবিধান বাস্তবায়ন কি অধরায় রয়ে যাবে


প্রকাশের সময় : নভেম্বর ৪, ২০১৮, ৫:৫১ PM / ৩৪
৭২ এর সংবিধান বাস্তবায়ন কি অধরায় রয়ে যাবে

মোহা. রাকিবুল ইসলাম : আজ ৪ নভেম্বর সংবিধান দিবস। সংবিধান একটা জীবন্ত দলিল। সমাজের অগ্রগতির সাথে এটিও এগিয়ে যাবে, পরিবর্তিত হবে–তাই স্বাভাবিক। সংশোধনের মাধ্যমেই সংবিধানে সমাজের এই পরিবর্তন প্রতিফলিত হয়ে থাকে। তাই সংবিধানের সংশোধন যেমন কোন নতুন বিষয় নয় তেমনি তাকে সাধারণভাবে খারাপ বলারও অবকাশ নেই। তবে কোন কোন সংশোধন করা হয়ে থাকে যাতে সমাজের অগ্রগতির প্রতিফলন হয় না, বরং তা কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে করা হয়ে থাকতে পারে। তাই ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া কোন একগুয়েমির কারণে নয়, কোন রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশে নয়, বরং আমাদের ভুলকে শুধরে নেবার স্বার্থে। আর তা রাজনৈতিক সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণের মাধ্যমেই করতে হবে। এটাকে অন্যভাবে বলা যেতে পারে, লাফ দেবার আগে অনেকটা পেছনে যেতে হয়। সেই পেছনে যাওয়া মানে পেছনে পরে থাকার জন্য নয়, বরং সামনে এগিয়ে যাবার জন্য।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে’৭২ এর সংবিধানের অপরিহার্যতা অনিস্বীকার্য। এই চেতনা বাস্তবায়নে’৭২ এর সংবিধানের চার মূলনীতি_গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙ্গালী জাতীয়বাদ ও সমাজতন্ত্র পূনঃপ্রতিষ্ঠা করার কোনো বিকল্প নেই। কেননা মহান মুক্তিযুদ্ধের নির্যাস হলো’৭২ এর সংবিধান। কিন্তু ৭২ এর সেই সংবিধানে প্রথম পেরেক মারেন জেনারেল জিয়া , অতঃপর রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা করে শেষ পেরেকটা মেরে যান আরেক জেনারেল এরশাদ।

দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাঙালির জাতীর জাতীয় চেতনার সকল ইতিবাচক উপাদানের নির্যাস ’৭২-এর সংবিধান। কোন রাজনৈতিক সুবিধার জন্য ৭২ এর সংবিধান প্রণীত হয়েছিল না। একটি পরাধিন জাতির আন্দোলনের ফসল ছিল ৭২ এর সংবিধান রা ছিল বাঙ্গালি জাতির মুক্তির রক্ষাকবচ, ত্যাগ-তিতিক্ষার প্রতিফলন।

৭১’ এর মুক্তিযুদ্ধ শুধুমাত্র ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধই ছিলোনা, মুক্তিযুদ্ধ ছিলো কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র জনতার দীর্ঘদিনের মুক্তিকামী সংগ্রামের এক চুড়ান্ত রুপ। সাঁওতাল-গারো-হাজং প্রভৃতি আদিবাসীদের বিদ্রোহ, সন্নাসী ও ফকির বিদ্রোহ, সিপাহী বিদ্রোহ, মাষ্টারদা সূর্যসেন -প্রীতিলতা প্রমূখ বিপ্লবীর নেতৃত্বে সংঘটিত অগ্নিযুগের সশস্ত্র জাতীয় বিপ্লবী আন্দোলনসহ জনগনের বহুমাত্রিক সংগ্রাম ব্রিটিশ শাসনের ভিতকে কাঁপিয়ে তুলেছিলো। ’৪৭-এ ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটলেও সাম্প্রদায়িক ও দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের অর্ন্তভূক্ত হয় বাংলাদেশ। পাকিস্তানি শাসকদের জাতিগত শোষণ, দমন-পীড়ন ও প্রতিক্রিয়াশীল নীতির বিরুদ্ধে বাংলার জনগন তীব্র সংগ্রাম গড়ে তোলে। ‘৫২, ‘৫৪, ‘৬২, ‘৬৪, ‘৬৬ এবং সবশেষে ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, আইয়ুব শাহির পতন, ‘৭১-এর নির্বাচন, ২১ দফা, ৬ দফা, ১১ দফা এসব সংগ্রাম ও গণদাবির মধ্য দিয়েই সৃষ্টি হয় ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি। বাঙ্গালীর বীরত্বপূর্ন সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় আসে এই মহান মুক্তিযুদ্ধ। তারপর দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগ, ২ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা পেলাম লাল-সবুজের পতাকা ও স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশ।

“স্বাধীন দেশে যে সংবিধান রচিত হয়েছিল (‘৭২ সালের সংবিধান) তার প্রস্তাবনায় লেখা হয়, ‘আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক-প্রতিষ্ঠা সমাজের যেখানে সব নাগরিকের জন্য … রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য … নিশ্চিত হইবে।’  রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি প্রসঙ্গে বলা হয়েছিল ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা, … রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে।’ এবং ‘… সাম্যবাদী সমাজ লাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করা হইবে।’ আরো বলা হয়েছিল যে, ‘রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব হইবে মেহনতি মানুষকে … এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি প্রদান করা।’ এই সংবিধানে স্পষ্টভাবে ‘পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশ’, নাগরিকদের জন্য ‘অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা’, ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা’, ‘মানুষে-মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ’ ইত্যাদির কথা এবং এমনকি নাগরিকদের প্রাপ্তি সম্পর্কে মার্কস-এঙ্গেলস রচিত কমিউনিস্ট ইশতেহার থেকে কোটেশন মার্কে উদ্ধৃতি দিয়ে লেখা হয়েছিল, ‘প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্যতানুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী’ এই ফর্মুলা হবে সামাজিক সম্পদ বিতরণের নীতি। ‘৭২-এর সংবিধান থেকে এই কয়েকটি উদ্ধৃতির মাধ্যমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চরিত্র”। (মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম)।

’৭২ এর সংবিধান প্রবর্তিত রাজনীতি, অর্থনীতি ছিল মেহনতি মানুষের স্বার্থে। সংবিধানের ৪ মূলনীতির আলোকে দেশ চলতে শুরু করে। যার ফলে দেশীয় লুটপাটকারী বুর্জোয়া শ্রেণী ও সাম্রাজ্যবাদী চক্র খুব্ধ হয়ে এই ষড়যন্ত্র শুরু করে। এরপর আসে চতুর্থ সংশোধনী।

পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘সমাজতন্ত্র’কে বাদ দিয়ে একদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে, অন্যদিকে সামরিক শাসনকে বৈধতা দিয়ে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করেছিল জেনারেল জিয়া। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালু করেন, সংবিধানে সংযুক্ত করেন ধর্মকে। হাইকোর্টের রায়ে ওই সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালী করার তাৎপর্যপূর্ণ সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এই রায় বাস্তবায়নে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সকল শক্তির ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা জরুরি। স্বাধীনতাবিরোধীরা শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে দেশকে বিচ্যুত করার ষড়যন্ত্র করেছে। ’৭২-এর সংবিধানের পরিবর্তনগুলো তাদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, পাকিস্তানী আদর্শবান্ধব, প্রতিক্রিয়াশীল আদর্শের সঙ্গে মিলে গেছে। এর মধ্যদিয়ে এ বিষয়টি খুবই স্পষ্ট যে ’৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা বিষয়টি তাই মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনা ও ধারা ফিরিয়ে আনার কর্তব্যের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়। বাংলাদেশকে প্রগতি ও উন্নয়নের দিকে ধাবিত করতে হলে ’৭২-এর সংবিধানের মূলভিত্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা অন্যতম প্রধান কর্তব্য।

বাহাত্তরের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার যে মূলনীতিগুলো_ অর্থাৎ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ ঘোষণা করা হয় তা কেবল ঘোষণাই ছিল না, ওই সংবিধানের বিধানেই বলা হয় যে, ‘… ওই নীতিসমূহ বাংলাদেশ পরিচালনার মূল সূত্র হইবে। আইন প্রণয়নকালে রাষ্ট্র তাহা প্রয়োগ করিবেন, এই সংবিধান ও বাংলাদেশের অন্যান্য আইনের ব্যাখ্যাদানের ক্ষেত্রে তাহা নির্দেশক হইবে এবং তাহা রাষ্ট্র ও নাগরিকদের কার্য্যের ভিত্তি হইবে…।’

“৭২-এর সংবিধানে ফিরে যেতেই হবে। কারণ এতে দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটেছে। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে আমাদের ৭২-এর সংবিধান প্রথমে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ৭২-এর চার মূলনীতির মাধ্যমেই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব। মুক্তিযুদ্ধের সাথে যে সব শক্তির একনিষ্ঠতা রয়েছে তাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই সংবিধান বাস্তবায়নের জন্য এগিয়ে আসতে হবে”—-অ্যাড. সুলতানা কামাল।

“৭২ এর সংবিধান পৃথিবীর সেরা সংবিধান”- তোফায়েল আহমেদ

“৫০-এর দশক থেকে ৭১ পর্যন্ত জনগণের অধিকারের যে সংগ্রাম তার প্রতিফলন ঘটেছে ৭২-এর সংবিধানে। ৭২-এর সংবিধান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কাঠামোগত রূপ। ৫ম ও ৭ম সংশোধনী দিয়ে ৭২-এর সংবিধানকে ভাঙ্গা হয়েছিল। এ কাজে যারা যুক্ত ছিল তারা অপরাধী। তাদের বিচার হওয়া উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন”। ——ব্যারিস্টার আমির-উল-ইসলাম

গত দুই দশকের সংগ্রামের মূল দাবি ছিল ৭২-এর সংবিধান পুন:প্রতিষ্ঠা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরে যাওয়া মানে রাষ্ট্রের কাঠামোতে ৭২-এর সংবিধান পুন:প্রতিষ্ঠা করা। একটি চক্র ৭২-এর সংবিধান পুন:প্রতিষ্ঠা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। ——রাশেদ খান মেনন

মুক্তিযুদ্ধ কখনো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। এ সংগ্রামের সাথে জড়িয়ে ছিল জাতীয় চেতনা আর এর প্রতিফলন ঘটেছে ৭২-এর সংবিধানে। মূল কথা হলো ৭২-এর সংবিধানে আমাদেরকে ফিরে যেতেই হবে। এর বিকল্প কোনো পথ নেই।— হায়দার আকবর খান রনো

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠা করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের চার মূলনীতি (গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙ্গালী জাতীয়বাদ ও সমাজতন্ত্র) পূনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। সংখ্যালঘু জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। সংখ্যালঘু জাতিসত্তার উপর সকল নির্যাতন-বৈষম্য বন্ধ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার জন্য, দেশের কৃষক-শ্রমিক তথা আপামর জনগনের স্বার্থ রক্ষা তথা একটি সমৃদ্ধশালী সমাজ গড়ার সুন্দর স্বপ্নপূরন করতে হলে এখনোই আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আর তা করতে পারলেই আমরা আমাদের ৭১’ এর শহীদদের স্বপ্নও বাস্তবায়ন করতে সমর্থ হবো। ‘৭২ এর সংবিধান পূণ:স্থাপন হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফেরার পথে অন্যতম প্রধান কাজ। এরপরও অনেক কাজ রয়েছে। সেই কাজের পূর্বে ‘৭২ এর সংবিধানে আগে ফিরতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকার রয়েছে ২/৩ অংশ ভোট রয়েছে সংসদে তবুও ৭২ এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া আমাদের আজও অধরায় রয়ে গেলো!

লেখক :
মোহা. রাকিবুল ইসলাম
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

(ঢাকারনিউজ২৪.কম/আরএম/৫:৫০পিএম/৪/১১/২০১৮ইং)