• ঢাকা
  • শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ০৩:০৭ অপরাহ্ন

শেখ হাসিনার ৩৫ বছর : ঘরের শত্রুরা ঠেকাতে না চাইলে এরশাদ-খালেদার উত্থান হতো না


প্রকাশের সময় : এপ্রিল ৯, ২০১৮, ৬:১৮ PM / ৩৭
শেখ হাসিনার ৩৫ বছর : ঘরের শত্রুরা ঠেকাতে না চাইলে এরশাদ-খালেদার উত্থান হতো না

সোহেল সানি : শেখ হাসিনা। জীবনই যাঁর ট্রাজেডিসর্বস্ব। বাংলার জনক-জননীহারা দুখিনীকন্যার এক মহাকাব্যগাঁথা। পথচলা তাঁর মৃত্যুর ফাঁদ ছাপিয়ে। যিনি শত্রুর মুখে ছাঁই দিয়ে সময়ক্রমে ইস্পাত কঠিন, আবার সময়ের সংকল্পে শুভের কল্যাণে পরম মমতায় অনিন্দ্য কোমল। অবিসংবাদী নেতার আসনে যোগ্য পিতার ন্যায়, যোগ্য কন্যা হিসাবে পরিনত হয়েছেন, জাতির আশ্রয় ঠিকানায়। শেখ হাসিনার ৩৫ বছরঃ ঘরের শত্রুরা ঠেকাতে না চাইলে এরশাদ-খালেদার উত্থান হতো না।

শেখ হািসনার জীবনের ট্রাজেডিই প্রাণহীন বাংলার প্রাণপ্রতিষ্ঠার স্পন্দন হয়ে উঠেছে। বিস্ময়কর তাঁর উত্থানপতনের গল্প।

তাঁর ৩৫ বছরের শুরুটা যখন বাংলা তখন তীরহারা। উজানে নৌকা ঠেলার দায়িত্ব কাঁধে চড়ানোর মতো মনবল সে-তো দুঃসাধ্য, দুঃসাহসের ব্যাপার। সঙ্গী-সাথীরা আবার অনেকেই তাঁর বাবার লাশ ফেলে রেখে খুনী মোশতাকের মন্ত্রীত্ব করে ফেরা। তারপরও তাঁকে হজম করতে হয়েছে চাটুকারদের। শেখ হাসিনাকে মনের অজান্তে বছর দুই গড়াতেই মন তার আপনারে টানে। সীমানা পেরুতে চান।

নিছক সমর্থক হয়ে আওয়ামী লীগের পথচলায় শুভ কামনাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। শুধু এতটুকু প্রাপ্তি, পচাত্তরত্তোর দ্বিধাবিভক্ত আওয়ামী লীগের একাংশের সমর্থক হয়ে থাকা। ১৯৭৯ সালের ৮ মে সুইডেন আওয়ামী লীগের এক সম্মেলনে লিখিত বানীটিই ছিল, শেখ হাসিনার পরোক্ষ সম্পৃক্ততা। আর প্রথম বক্তৃতা, ১৯৮০ সালের ১৬ আগস্ট লন্ডনের ইয়র্ক হলে।

বাবা-মা-ভাইদের ৫ম শাহাদৎবার্ষিকীতে। প্রধান অতিথির বক্তৃতায় স্বদেশের শাসকজান্তা জেনারেল জিয়াকে ‘গণতন্ত্র হত্যাকারী’ হিসাবে অভিহিত করে সামরিক শাসনের কঠোর সমালোচনা করেন। আব্দুল মালেক উকিল ও আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন জানানোর ফলে বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরা এ অংশকেই মূল ধরে অগ্রসর হতে চাইলেন। শেখ হাসিনার স্রেফ সমর্থনেই মিজানুর রহমান চৌধুরী ও অধ্যাপক ইউসুফ আলীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ মার খেলো। বঙ্গবন্ধুর পুরো সাড়ে তিন বছর
মন্ত্রীত্বকরাই কেবল নয়, সংবিধানে বিধিবদ্ধ যে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র তার স্বাক্ষরদাতাও চীফ হুইপ হিসাবে অধ্যাপক ইউসুফ আলী। খুনী খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী যেমন আওয়ামী লীগ (মিজান) এর সাধারণ সম্পাদক, তেমনি মূল আওয়ামী লীগ (মালেক) সভাপতি আব্দুল মালেক উকিলও খন্দকার মোশতাকের দোসর বলে বিতর্কিত ছিলেন। মোশতাক পার্লামেন্ট বহাল
রাখায় স্পিকার পদেই ছিলেন আব্দুল মালেক উকিল। তাঁকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে স্পীকার করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু সেই তিনি বানিজ্য মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক খুনীচক্রের হোতা হিসাবে অবৈধভাবে রাষ্ট্রপতির পদ দখল করলে তাকে স্বাগত জানান। লন্ডনে প্রেসবিফিং বঙ্গবন্ধু হত্যা সম্পর্কে তীর্যক মন্তব্য করে মালেক উকিল বলেছিলেন,”দেশ ফেরাউনের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।

”জাতীয় চার নেতা হত্যার তিন দিনের মাথায় মোশতাকের পতন ঘটে। বিচারপতি এএসএম সায়েম রাষ্ট্রপতি হয়ে ৬ নভেম্বর জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দেন। মোশতাকের ২১ মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রীর অধিকাংশের ন্যায় মালেক উকিলও ভোল পাল্টে আওয়ামী লীগে ভিড়েন। আওয়ামী লীগের হাল চলে যায় তাঁর কব্জায়। আব্দুর রাজ্জাক দলের সাধারণ সম্পাদক। সভাপতি মালেকের নাম ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ (মালেক) পরিচালিত হওয়ায় দ্বন্দ্ব বাঁধে। আওয়ামী লীগ (মালেক-রাজ্জাক) ব্যবহারেও দ্বন্দ্ব মিটে না।
ওই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব প্রশ্নে নবীন-প্রবীনের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ বিরাজ করে। বিপ্লবী সংগঠন আওয়ামী যুবলীগ মূল চালিকা শক্তি হয়ে উঠলে তার প্রভাব মালেক – রাজ্জাক দ্বন্দ্বকে চাঙ্গা করে। আমির হোসেন আমু ও সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বাধীন যুবলীগের জাতীয় কংগ্রেসে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে স্বদেশে ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়ে একটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব পাস করে এবং লিফলেট বিলি করে। এরপর আওয়ামী লীগের বিবাদমান প্রবীন নেতারাও শেখ হাসিনার সঙ্গে দিল্লী গিয়ে যোগাযোগ শুরু করেন। সমস্ত নেতাকর্মীর ভেতর মুহূর্তে বিদ্যুৎরশ্মির চমক পৌঁছে দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়েকে স্বদেশে ফেরানোর সেই দাবী।

শেখ হাসিনাকে ১৯৮১ সালের কাউন্সিলে নাটকীয়ভাবে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। কথা ছিল দশ সদস্যের প্রেসিডিয়ামের সদস্য হবেন শেখ হাসিনা। শসহ সভাপতির পদগুলো বিলুপ্ত করে প্রেসিডিয়াম গঠনের সিদ্ধান্তটি দিল্লীতে শেখ হাসিনার উপস্থিতিতেই নেয়া হয়েছিল। একক নেতৃত্বের বদলে যৌথ নেতৃত্বে পরিচালনার জন্যই। কিন্তু সভাপতি নির্বাচিত করার খবর পৌঁছে যায় দিল্লীতে।

প্রেসিডিয়াম সদস্য ডঃ কামাল হোসেন ও যুগ্ম সম্পাদক সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী দিল্লীতে গেলেও শেখ হাসিনা স্বদেশে ফেরা হলো না। বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রী ডঃ কামাল ফিরে আসেন সাজেদা চৌধুরীকে নিয়ে। প্রত্যাবর্তনের তারিখ পাল্টে দেন পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের পানিবাহীরোগে আক্রান্ত হলে। নতুন তারিখ ১৭ মে নির্ধারণ করা হলে প্রেসিিডয়াম সদস্য আব্দুস সামাদ
আজাদ ও কোরবান আলী দিল্লীতে যান। ওদিন শেখ হাসিনাকে বহনকারী ইন্ডিয়ান এয়ার লাইন্সের ৭৩৭ বোয়িটির আকাশ থেকে অবতরণ এক ঐতিহাসিক ঘটনা। যেন জনকহারা ঘুমেবিভোর লাখ লাখ মানুষ জেগে উঠলো শেখ হাসিনাকে এক নজর দেখতে।
লীগের। প্রথম শ্রম সম্পাদক বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ ও প্রথম সাংগঠনিক সম্পাদক ও ববঙ্গবন্ধুর মন্ত্রী কোরবান আলী বিমানে শেখ হাসিনার সঙ্গী ছিলেন। কুর্মিটোলায় অবতরণ করার পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক বিমানের ভেতরে গিয়ে নতুন সভাপতি শেখ হাসিনাকে মাল্যভূষিত করেন। অথচ, শেখ হাসিনা সমর্থক থাকতে চেয়েছিলেন।

নেতৃত্বগ্রহণের বাড়তি দাবি ছিল না। বরং বাঙালী জাতিকে অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোই ছিল তাঁর বেলায় যথার্থ পথ।

তিনি বলতে পারতেন, তোমরা বাঙালীরা আমার মা-বাবা-ভাইদের হত্যাকারী, খুনীদের সাহায্যকারী, তোমাদের সংশ্রব আর চাই না। ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করতে পারতেন। সেই সূত্র ধরে যেমনটি বলেছিলেন,তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ ‘যে বাঙালীরা হিমালয়পর্বতসম শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করতে পারে, সেই বাঙালীদের আর বিশ্বাস করা যায় না।’ ওখানেই ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্বের সর্বমনুষ্যে উজ্জ্বলিত তিনি। জাতির পিতার কন্যা। আপনমনে সাধারণের ন্যায় বেঁচে থাকার জন্যে পরদেশী মাটিকে শ্রেয় ভাবতে পারেননি। বরং রাজনীতির মারপ্যাঁচের বেড়াজাল ছিন্ন করে অভিযুক্ত আত্মবিস্মৃত বাঙালী জাতির প্রাণপ্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হলেন তিনি। শেখ হাসিনা নির্জীব,নিথর-গণমানুষের প্রাণের সূঁতিকাগারে নিজের পরিবারের আত্মার সন্ধানে ব্রত হলেন।

এক ঐশ্বরিক কর্তব্যকর্ম পালনের উদার নৈতিক পথ অবলম্বন করে। আপন পরিবারের অস্তিত্ব রক্তসাগরের সমাধিস্থ হবার পর শেখ হাসিনার আর রাজনীতি করুন তা তাঁর স্বামী পরমানু বিঞ্জানী ডঃ এম এ ওয়াজেদ মিয়ারও ছিল না। অবাস্তব উচ্চাকাঙ্ক্ষাতো নয়ই।

তাই তিনি১৯৭৬ সালে একটি বিবৃতির মাধ্যমে দ্বিধাবিভক্ত আওয়ামী লীগের একাংশের ‘সমর্থক’ হয়েছিলেন মাত্র। যে নেতৃত্বের উদ্ভাসিত আলোয়ে মেঘকালো কুৎসিত অন্ধকার ছড়িয়ে পড়েছিল খুনী মোশতাকের আপন-আপন মুখগুলো। ১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই সামরিক দলবিধি আইনের আলোকে আওয়ামী লীগ যাঁর হাত ধরে সরকারি অনুমোদনলাভ করে,তার অস্থায়ী সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত অর্থে) মহিউদ্দীন আহমেদও অবিতর্কিত ছিলেন না। মোশতাকের দূত হয়ে মস্কো ছুটে গিয়েছিলেন রাশিয়ার সমর্থন আনতে।

গঠনতান্ত্রিকভাবে বৈধতার প্রশ্ন এড়াতে দৃশ্যত এ ছাড়া কোন বিকল্প ছিল না। ১৯৭৪ সালের ১৮-২০ জানুয়ারী অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কাউন্সিলে নির্বাচিত কমিটিকে ভিত্তি ধরে বঙ্গবন্ধু হত্যাত্তোর এক বৈরী পরিবেশে ফের আওয়ামী লীগ নামে সরকারী অনুমোদন লাভ করে। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের হাতেই নিহত জাতীয় চারনেতার মধ্যে আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান তখন কারাগাের। অন্যতম।

ওই কমিটির সিনিয়র সহসভাপতি ছিলেন মহিউদ্দীন আহমেদ। ১৯৭৩ সালে ৭ মার্চের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ত্যাগ করে আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচিত হন কমিউনিস্ট মহিউদ্দীন আহমেদ। অপর দুই সহসভাপতি ডাঃ আসহাবুল হক ও রফিক উদ্দীন ভূঁইয়া, সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক, প্রচার সম্পাদক সরদার আমজাদ হোসেন ছিলেন কারাগারে। বিভিন্ন কারণে সক্রিয় ছিলেন না দপ্তর সম্পাদক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, শ্রম সম্পাদক কাজী মোজাম্মেল হক, কৃষি সম্পাদক রহমত আলী, সাংস্কৃতিক সম্পাদক মোস্তফা সারওয়ার, সমাজকল্যাণ সম্পাদক শেখ শহীদুল ইসলাম ও কোষাধ্যক্ষ হামিদুর রহমান। ফলে সম্পাদক মন্ডলীর সর্বশেষ সদস্য মহিলা সম্পাদিকা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসাবে সামরিক সরকারের বরাবরে অনুমোদনের জন্য লিখিতমর্মে আবেদন করতে হয়।

আবেদনপত্রটি আইন মন্ত্রনালয় দলবিধি আইন ১৯৭৬ এর ১০ নম্বর দফা পরিপন্থী উল্লেখ করে নাকচ করে দেয়। ওই দফায় কোন জীবিত বা মৃত ব্যক্তির গুণকীর্তন কিংবা ব্যক্তিত্বের মহত্ব প্রচার করা যাবে না মর্মে বিধিনিষেধ আরোপিত ছিল। ফলে আওয়ামী লীগকে ঘোষণাপত্র থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শুধু নয়, দলের মূল প্রতিষ্ঠাতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, প্রতিষ্ঠাকালীন পূর্বপাকিস্তান প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকের নামও মুছে ফেলতে হয়। ঘোষণাপত্রে উল্লেখিত শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রীত্বে অল পাকিস্তানে দেড় বছরের আওয়ামী লীগের শাসনামল ছাড়াও ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন ও প্রাদেশিক সরকার অধ্যায়ে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের যে নাম তাও উঠিয়ে দেয়া হয়। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ১৯৫৪ সালের নির্বাচনকালে প্রথম দেখেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানকে। নারায়ণগঞ্জ ঘাট থেকে স্টিমারে চড়তে গিয়ে। স্বেচছায় কেবিনে বসা শেখ মুজিবের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে দারুন খুশী মেজাজে ফরিদপুরের নগরকান্দায় নিজের বাড়িতে পৌঁছেছিলেন সেদিনের তরুণী সাজেদা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবের আহবান ছিল দলে যোগদানের।

তিনি পরিবারের সম্মতি নিয়ে যোগও দিয়েছিলেন। ১৯৭০ নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের সংরক্ষিত আসনে সদস্য নির্বাচিত হন। মহান মুক্তিযুদ্ধে মেয়েদের নিজহাতে অস্রের প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অধ্যাপিকা বদরুন্নেছা আহমেদ ও সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠালাভ করে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগ। দলের সভানেত্রী ও স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রিসভার প্রথম মহিলা সদস্য বদরুন্নেছার অকাল মৃত্যুর পর সাজেদা চৌধুরী মূল আওয়ামী লীগেরও মহিলা সম্পাদক নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি এএসএম সায়েম ১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই সামরিক আইন বিধি ১৯৭৬ এর ২২) জারী করেন।

ফলে রাজনৈতিক দলবিধির অধীনে দল গঠনের অধিকার লাভ করে। আওয়ামী লীগ এর প্রেক্ষিতে ২৫ আগস্ট এক সভায় কেন্দ্রীয় সংসদ, সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা ও মহকুমার শীর্ষ নেতারা বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেন- আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত করণের। মিজান চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৭৬ সালের ৪ নভেম্বর আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসাবে সরকারী অনুমতিলাভের ২৬ দিনের ব্যবধানে জেনারেল জিয়াউর রহমান সায়েমের কাছ থেকে অসৌজন্য আচরণ করে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদটি কেড়ে নেন। এবং ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতির পদটিও কব্জা করেন জিয়া। সায়েমের সংসদ নির্বাচনের পরিকল্পনা ভেস্তে পাঠান খুনী মোশতাকের নিয়োগ পাওয়া সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়া। আওয়ামী লীগের ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত জনসভায় সাজেদা চৌধুরী প্রথম বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড ও জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার দাবি করেন।
আব্দুল মালেক উকিল, মোজাফফর হোসেন পল্টু, সালাউদ্দীন ইউসুফসহ বেশ কিছু নেতা গ্রেফতার হন।

ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মহিউদ্দীন আহমেদ আত্মগোপন করলে আহবায়ক করা হয় ফণীভূষণ মজুমদারকে।

কিন্তু ফণীভূষণও দায়িত্বপালনে অক্ষমতা প্রদর্শন করলে মিজানুর রহমান চৌধুরী ও মোল্লা জালাল উদ্দীন আহমেদ যুগ্ম আহবায়ক হিসাবে দলের হাল ধরেন। নেতৃত্বের সংকটের মুখে ১৯৭৭ সালের ৩ এপ্রিল ঢাকার ইডেন হোটেল প্রাঙ্গনে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়।

১৪ শত কাউন্সিলরের উপস্থিতিতে ৪টি মূলনীতির প্রশ্নে এক মত পোষণ করলেও নেতৃত্বের বিষয়ে মতভেদে জড়িয়ে পড়েন। যুগ্ম আহবায়ক মিজান চৌধুরীর নেতৃত্ব রক্ষণশীল ধারা ও মোল্লা জালাল উদ্দীনের নেতৃত্বে প্রগতিশীল ধারার কলোহে সংকট দেখা দেয়। মূল নেতারা কারাগারে থাকায় বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়া ও দলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মিজান চৌধুরী এক প্রস্তাবে একটি পূনাঙ্গ আহবায়ক কমিটি গঠনের সিদ্ধান্তের পক্ষে অবস্থান নেন। কিন্তু প্রগতিবাদীরা ১৯৭২ থেকে মহিলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ সভানেত্রী ও দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নিহত জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমেদের পত্নী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে কেবল আহবায়ক
করে ৪৪ সদস্য বিশিষ্ট সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়। ওই আহবায়ক কমিটির সদস্যরা হলেন ক্রমানুসারে, বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রী মোল্লা জালাল উদ্দীন, ফণীভূষণ মজুমদার, মতিউর রহমান ও সহসভাপতি কাজী জহিরুল কাইয়ুম। ফণীভূষণকে অবশ্য পিজি হাসপাতাল থেকে উঠিয়ে নিয়ে মোশতাক মন্ত্রী বানিয়েছিল। পাঁচ নম্বর অবস্থান দেয়া হয় মিজানুর রহমান চৌধুরীকে।
এর পরবর্তী নামগুলোর মধ্যে আব্দুল মান্নান, আব্দুল মমিন, সোহরাব হোসেন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীত্ব করেও খুনী মোশতাকের মন্ত্রিসভার সদস্য হন। আসাদুজ্জামান খান খুনী মোশতাকের মন্ত্রীত্বের অফার না পেলেও মনোরঞ্জণ ধর, বঙ্গবন্ধুর বাকশাল মন্ত্রিসভার ন্যায় মোশতাকেরও আইন মন্ত্রী ছিলেন। তিনি কুখ্যাত ইনডেমনিটি আইন অধ্যাদেশ১৯৭৫ এর প্রণেতা। যে আইনে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বৈধতা দেয়া হয়েছিল। কমিটিতে স্থান পাওয়াদের মধ্যে ময়েজউদ্দীন আহমেদ, মফিজুল ইসলাম খান, ফজলুল করিম, মোহাম্মদ হানিফ, আনসার আলী, ওমর আলী, শামসুর রহমান খান, ব্যারিস্টার শওকত আলী খানের পর ঠাঁই দেয়া হয় ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মহিউদ্দীন
আহমেদকে। কুমিল্লার আহম্মদ আলী, আলী আজম ভূঁইয়া, নুরুল ইসলাম, নোয়াখালীর এ বি এম তালেব আলী, অধ্যাপক হানিফ, ময়মনসিংহের আব্দুল হাকিম, পটুয়াখালীর খন্দকার আবুল কাশেম, যশোরের অধ্যক্ষ কামরুজ্জামান(পরে প্রেসিডিয়াম সদস্য) বদিউজ্জামান, কুষ্টিয়ার আজিজুর রহমান, পাবনার খন্দকার আবু তালেব, রাজশাহীর ডাঃ আলাউদ্দিন (১৯৯২ সালে প্রেসিডিয়াম সদস্য ‘৯৬ সালে মনোনয়ন না পেয়ে বিএনপিতে ভিড়ে এমপি এবং আবার ফিরে এসে আওয়ামী লীগের প্রতিমন্ত্রী!)
বগুড়ার এ কে এম মজিবর রহমান, রংপুরের লুৎফর রহমান, দিনাজপুরের আব্দুর রহিম ( স্বাধীনতাত্তোর আওয়ামী লীগের অন্যতম সহসভাপতি) সিরাজুল ইসলাম, খুলনার মোহাম্মদ মোহসীন, সৈয়দ কামাল বখত, ফরিদপুরের নুরুন্নবী, চট্টগ্রামের এম এ ওয়াহাব, ঢাকার মাহমুদা চৌধুরী ও রংপুরের রওশণ আরা মোস্তাফিজ। বাকশালের প্রতিমন্ত্রী ফরিদ গাজী (মোশতাকের প্রতিমন্ত্রী পরে আওয়ামী লীগ মিজান সব শেষে আওয়ামী লীগে ফেরার নিজ নামেও একটি আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব বহাল রেখেছিলেন)। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী, ডাঃ ক্ষীতিশ মন্ডল (মোশতাকের প্রতিমন্ত্রী ও পরে এরশাদেরও মন্ত্রী)। ১৯৭৮ সালের ৩ মার্চ ইডেন প্রাঙ্গনে কাউন্সিল করে আওয়ামী লীগ কমিটি প্রকাশ করে। আব্দুল মালেক উকিল সভাপতি করে জোহরা তাজউদ্দীনকে এক নম্বর সহসভাপতি করা হয়। অন্য ৫ সহসভাপতি মতিউর রহমান, আব্দুল মান্নান, রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া, মহিউদ্দীন আহমেদ, আব্দুল মমিন তালুকদার।

যুগ্ম সম্পাদক সাজেদা চৌধুরী ও সালাউদ্দীন ইউসুফ, সাংগঠনিক সম্পাদক তোফায়েল আহমেদ, প্রচার সম্পাদক সরদার আমজাদ হোসেন, যুব সম্পাদক আমির হোসেন আমু , দপ্তর সম্পাদক সৈয়দ আহমেদ, শ্রম সম্পদক কাজী মোজাম্মেল হক, কৃষি সম্পাদক মানিক চৌধুরী, শিক্ষা সাংস্কৃতিক সম্পাদক এস এম ইউসুফ, সমাজকল্যাণ সম্পাদক ইয়াহিয়া চৌধুরী, মহিলা সম্পাদিকা আঈভী রহমান, কোষাধ্যক্ষ ফজলুল করিম। ১৯৭৮ সালে মিজান চৌধুরী সভাপতি ও অধ্যাপক ইউসুফ আলী সাধারণ সম্পাদক হয়ে পাল্টা আওয়ামী লীগ গঠন করেন।

১৯৮১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি কাউন্সিলে সভাপতি হন শেখ হাসিনা। সহসভাপতির পদ বিলুপ্ত করে যৌথ নেতৃত্বে দল চালনার জন্য প্রেসিডিয়াম গঠন করা হয়। আব্দুল মালেক উকিল জোহরা তাজউদ্দীন, ডঃ কামাল হোসেন, আব্দুল মান্নান, কোরবান আলী, আব্দুস সামাদ আজাদ, ফণীভূষণ মজুমদার, মহিউদ্দীন আহমেদ, জিল্লুর রহমান ও আব্দুল মমিন তালুকদার। সম্পাদক মন্ডলীতে নতুন মুখ আসেন সমাজকল্যাণ মফিজুল ইসলাম খান কামাল, শ্রম সম্পাদক এবিএম তালেব আলী, কৃষি অধ্যাপক হানিফ, যুব সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিম, আন্তজাতিক সম্পাদক আব্দুল জলিল, সাংস্কৃতিক সম্পাদক শফিকুল ইসলাম আজিজ মুকুল। ১৯৮৩ সালের আগস্টে আওয়ামী লীগ ভাঙ্গে আরও একদফা। আব্দুর রাজ্জাক ও মহিউদ্দীন মিলে বাকশল গঠন করেন।
মোশতাক ১৯৭৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাকশাল বাতিল করেছিলেন। ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন সাজেদা চৌধুরী।

১৯৮৭ সালের ১ জানুয়ারি কাউন্সিল হলে সাজেদা সাধারণ সম্পাদক হন। পুলিন দে, সালাউদ্দীন ইউসুফ, কামরুজ্জামান, সিরাজুল হক ও ডাঃ আলাউদ্দিন প্রেসিডিয়ামে স্থান পান। চলবে….. হাসিনার ৩৫ বছরঃ ঘরের শত্রুরা ঠেকাতে না চাইলে
এরশাদ-খালেদার উত্থান হতো না

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও প্রধান সম্পাদক – সংবাদ বিডি 24 ডটকম

(ঢাকারনিউজ২৪.কম/আরএম/৬:১৮পিএম/৯/৪/২০১৮ইং)