কলকাতা থেকে দিপক দেবনাথ : দক্ষিণ কলকাতার নড়ার সেই বিখ্যাত চা’য়ের দোকানেই বন্ধুদের সাথে নিয়ে একসময় অনেক সময় কাটিয়েছেন বাংলাদেশের নায়ক রাজ রাজ্জাক। আর কখনও কখনও আড্ডার মাত্রা এতটাই বেশি হয়ে যেতো যে অতিষ্ঠ হয়ে উঠতেন চা দোকানের মালিকও। মুখে বলেও চা দোকানে রাজ্জাকদের আড্ডা বৈঠক বন্ধ করতে পারেনি দোকানদার। অবশেষে রাজ্জাক ও তার বন্ধুদের দুরন্তপনা থামাতে শুকনো মরিচ পোড়া দিতেন নড়া। আর তার ঝাঁঝালো গন্ধেই দোকানে ঢুকতে পারতেন না রাজ্জাক বা তার বন্ধুরা। যদিও ১৯৬৪ সালে কলকাতা ছেড়ে বাংলাদেশে গিয়ে অভিনয়ে নাম করার পর ১৯৭১ সালে রাজ্জাক যখন কলকাতায় ফিরে আসেন এবং সেই চায়ের দোকানে যান সেসময় তাকে যতœ করে চা খাওয়ান নড়া। শুধু সেবারই নয়, এর পর থেকে নায়করাজ যতবার কলকাতায় এসেছেন প্রায় প্রত্যেকবারই ওই নড়ার চায়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াতেন। সময় কাটাতেন পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে। কিন্তু সেই নড়ার চা’য়ের দোকান আজ আর নেই। সেখানে এখন মাথা তুলেছে আকাশচুম্বী বহুতল ভবন। পাশের রাস্তা দিয়ে ছুটছে বড় বড় গাড়ি। তবে দোকান না থাকলেও এলাকা জুড়ে রয়েছে একরাশ স্মৃতি।
নড়ার চায়ের দোকানের কাছেই নাকতলা রোডেই পৈত্রিক ভিটে ছিল রাজ্জাকদের। ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারী নাকতলা রোডেই অবস্থিত আকবর হোসেন ও মিনারুন্নেসা’র পরিবারে কোল আলো করে জন্ম নেয় আব্দুর রাজ্জাক। তিন ভাইয়ের মধ্যে রাজ্জাকই ছিলেন সবার ছোট। নাকতলার খানপুর হাইস্কুলে পড়াশোনা। স্কুলে পড়ার সময়ই মঞ্চ নাটকে অভিনয় করে কিশোর রাজ্জাক। এরপর এসএসসি পাশ করার পর পুরোপুরি ভাবে অভিনয় জগতে প্রবেশ করেন তিনি। ১৯৬২ সালে লক্ষীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন রাজ্জাক। এরপর ১৯৬৪ সালে একটি জাতি সংঘর্ষের পরই নিজেদের বিশাল সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়ে কলকাতা ছেড়ে স্ত্রী লক্ষী ও ছয় মাসের ছেলে বাপ্পারাজকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে যান রাজ্জাক। মেজ ভাই চলে যান কলকাতার খিদিরপুরে। বড় ভাইও নাকতলা ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। তুতো ভাইরাও কলকাতার কাছেই কামালগাজি এলাকায় চলে যান।
রাজ্জাক বাংলাদেশে যাওয়ার পরই নড়ার চায়ের দোকানের আড্ডাও আস্তে আস্তে কমে আসে। রাজ্জাকের সেই পুরোনো বন্ধুদেরও অনেকেই আজ কাজের সন্ধ অন্যত্র চলে গেছেন, কেউ বা হয়তো চলে গেছেন এই পৃথিবী ছেড়েই। কিন্তু যারা আছেন তাদের কাছে রাজ্জাকের মৃত্যুর খবর অনেকটাই আকস্মিক ঘটনার মতো। বৃহস্পতিবার সকালে নাকতলার যে জায়গায় রাজ্জাকরা থাকতেন সেখানে গিয়ে দেখা গেল সেখানেও এক একটা করে বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে। অনেক খোঁজার পর একজনকে পাওয়া গেল যিনি রাজ্জাকের মৃত্যুর খবর শুনেই স্তম্ভিত হয়ে পড়লেন। রাজ্জাকের চেয়ে বয়সে সাত মাসের ছোট নাকতলার বাসিন্দা টি দাস (৭৬) জানান ‘খানপুর হাইস্কুলে রাজ্জাক ও আমি দুই জনেই অষ্টম শ্রেণীতে পড়তাম। সেখান থেকে আমাদের পরিচয়’। রাজ্জাকের সঙ্গে তাঁর পুরোনো স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে টি. দাস বলেন ‘স্কুলে তখন আমাদের অঙ্কের শিক্ষক ছিলেন দুর্গাপ্রসন্ন চক্রবর্তী। রাজ্জাক অঙ্কে খুব একটা ভাল ছিল না। তাই শিক্ষক মহাশয় ডাস্টার দিয়ে রাজ্জাকের মাথা নিচু করে তার পিঠে মারতো। আর বলতো-তোর বাবা অঙ্ক শিখতে হবে না। খালি যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ শিখলেই হবে। কারন তোদের তো অনেক জমি আছে, যোগ-বিয়োগ না শিখলে সব জমি অন্যেরা ঠকিয়ে নিয়ে যাবে’। তবে রাজ্জাক কখনও ডান পিটে ছিল না। উগ্র মনোভাবাপন্নও ছিল না। ও ছিল খুব শান্ত প্রকৃতির মানুষ’।
তিনি আরও জানান ‘রাজ্জাকরা নাকতলার জমিদার ছিল। একসময় সম্পত্তি নিয়ে তিন ভাইয়ের মধ্যে বিবাদ হয়। কিন্তু বাড়ির ছোট ছেলে হিসাবে কিছুটা বঞ্চিত হয়ে ছিলেন রাজ্জাক। ১৮/১৯ বছরে রাজ্জাক মুম্বাই চলে যায়। কিন্তু সেখানে সুবিধা করতে না পারায় ফের টালিগঞ্জে ফিরে আসে’।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজ্জাকের ছোটবেলার আরেক বন্ধু জানান ‘রাজ্জাক আমার খুব পুরোনো বন্ধু ছিল। রেজজ্জাককে সেই বিয়ের আগে থাকতে দেখেছি, তাঁকে নাটক করতে দেখেছি। সে অসম্ভব ভাল নাটক করতো। ওঁর বিয়েটাও খুব জাকজমকপূর্ণ ভাবে হয়েছিল। বিয়ের সময় নাকতলা রোড দিয়েই ঘোড়ার গাড়ি করে গিয়েছিলেন। বিয়েতে এলাকার বাসিন্দাদের প্রায় এক সপ্তাহ ধরে পাতপেড়ে খাওয়ানো হয়েছিলো। নড়ার চায়ের দোকানেও আমরা একসঙ্গে আড্ডা মারতাম। কলকাতা থেকে বাংলাদেশ চলে যাওয়ার পরে রাজ্জাক সাহেব ফের যখনই কলকাতায় আসতো তখনই নাকতলার মোড়ে নড়ার দোকানে এসে পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে যেতো’।
(ঢাকারনিউজ২৪.কম/প্রতিনিধি/এসডিপি/১২:০৫এএম/২৫/৮/২০১৭ইং)
আপনার মতামত লিখুন :