• ঢাকা
  • শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ১২:০৬ পূর্বাহ্ন

মৃত্যুকূপ থেকে লাল সবুজের বাংলা ও একটি ঐতিহাসিক ভাষণ


প্রকাশের সময় : জানুয়ারী ৯, ২০১৯, ৬:৪৮ PM / ৩৫
মৃত্যুকূপ থেকে লাল সবুজের বাংলা ও একটি ঐতিহাসিক ভাষণ
মো. রাকিবুল ইসলাম : ২৫ মার্চ রাতেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে চলে যায় । দীর্ঘ ২৯০ দিন বন্দি থাকার পর ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পান বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি, স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা , মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমান । ৯ জানুয়ারি ১৯৭২,রবিবার জাতির জনক লন্ডন, দিল্লি হয়ে স্বাধীন দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন । লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধু নামেন । বঙ্গবন্ধু নেমেছেন এই খবর পাওয়া মাত্র তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ উনার পূর্বনির্ধারিত শিডিউল বাতিল করে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে আসেন হোটেল  ক্ল্যারিজেসের প্রেসিডেনশিয়াল স্যুটে । সেখানে জাতির পিতা এক সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ববাসির কাছে স্বাধীন দেশের স্বীকৃতি দেবার জন্য বলেন । জাতির জনক সেদিনের সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করলেও ব্রিটিশদের উদ্দেশ্যে বলতে ভুল করেন নি –“ বাংলাদেশের সম্পদে ধনী হওয়া বৃটিশ জনগণের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন,বাংলাদেশ থেকে তোমরা অনেক কিছু নিয়েছো, এবার কিছু ফিরিয়ে দাও।”
লন্ডনে মেডিক্যাল চেক-আপ শেষে বঙ্গবন্ধু দিল্লীর উদ্দেশ্যে রওনা হোন। এদিকে পূর্বেই ঢাকা থেকে তাজউদ্দীন আহমেদ , সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে কথা বলেছিলেন । তিনি জাতির পিতাকে ভারতে নামার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন । রুপালী কমেট বিমানে লন্ডন থেকে জাতির পিতা ভারতের দিল্লীর পালাম বিমানবন্দরে নামেন । বিমানবন্দরে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ মন্ত্রিসভার সকল সদস্য, তিন বাহিনীর প্রধান এবং কূটনৈতিক মিশনের প্রধানগণ উপস্থিত ছিলেন। দিল্লীর প্যারেড গ্রাউন্ডের জনসভায় বঙ্গবন্ধু এক সংক্ষিপ্ত ও মর্মস্পর্শী ভাষণ দেন । মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতার জন্য ইন্দিরা গান্ধী ও ভারত সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছিলেন ‘জানেন বাংলাদেশ শেষ হয়ে গেছে। আমি সকল প্রকার সাহায্য সহানুভূতি আশা করি এবং এও আশা করি দুনিয়ায় শান্তিকামী, গণতান্ত্রিক যে মানুষ আছে তারা এগিয়ে আসবে আমার মানুষদের সাহায্য করার জন্য।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি সেক্যুলারিজমে। আমি বিশ্বাস করি গণতন্ত্রে। আমি বিশ্বাস করি সোশ্যালিজমে।’ আমাকে প্রশ্ন করা হয় শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আপনার আদর্শের এত মিল কেন? আমি বলি -‘এটা আদর্শের মিল, নীতির মিল, এটা মনুষ্যত্বের মিল, এটা বিশ্বশান্তির জন্য মিল।’ বঙ্গবন্ধুর এই কথা শুনে সমবেত জনতা করতালিতে ফেটে পড়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বক্তব্য রাখেন । তিনি বলেছিলেন – ‘শেখ সাহেব তাঁর জাতিকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তাদের স্বাধীনতা এনে দেবেন। তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে তাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। পাকিস্তানীরা কায়িকভাবে তাঁকে বন্দী করেছিল, তাঁর আত্মাকে বন্দী করতে পারেনি। তাঁর স্বাধীন আত্মা বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার লড়াইয়ে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। যে সব আদর্শের জন্য তাঁরা সংগ্রাম করেছেন আমরাও একই আদর্শে বিশ্বাসী।’
বঙ্গবন্ধুকে দিল্লী থেকে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের রুপালী কমেট বিমানটি বেলা ১টা ৪১ মিনিটে যখন তেজগাঁও বিমানবন্দরে পৌঁছায়, তখন বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স পরিণত হয়েছে এক জনসমুদ্রে যা কেবল ৭ মার্চে তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণের জনসমুদ্রের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। বিমানবন্দর থেকে সাড়া পথ প্রচ- ভীড়ের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সের দিকে রওনা হন। বিমানবন্দর থেকে একটি খোলা ট্রাকে রেসকোর্স যেতে জাতির পিতার সময় লাগে আড়াই ঘণ্টা। রেসকোর্সের জনসভায় তিনি মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়লেন, দু’ চোখ গড়িয়ে পড়েছিল বহুবার অশ্রু। অশ্রুসজল তাঁর এ ভাষণটিতে আবেগের মধ্য দিয়ে দেশবাসীর ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি তিনি যে আহ্বান ও নির্দেশনা দিয়েছিলেন তা ছিল বীরোচিত এক বিশ্ব বরেণ্য নেতার ভাষণ।
জাতির পিতা সেদিন কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন – ‘বিশ্বকবি তুমি বলেছিলে ‘সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি।’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তুমি দেখে যাও, তোমার আক্ষেপকে আমরা মোচন করেছি। তোমার কথা মিথ্যা প্রমাণিত করে আজ ৭ কোটি বাঙালি যুদ্ধ করে রক্ত দিয়ে এই দেশ স্বাধীন করেছে। হে বিশ্বকবি তুমি আজ জীবিত থাকলে বাঙালির বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে নতুন কবিতা সৃষ্টি করতে।’
‘গত ১০ মাসে সেনাবাহিনী বাংলাকে বিরান করেছে। বাংলার লাখো মানুষের আজ খাবার নাই, অসংখ্য লোক গৃহহারা। এদের জন্য মানবতার খাতিরে আমরা সাহায্য চাই। বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের প্রতি আমি সাহায্যের আবেদন জানাই। বিশ্বের সকল মুক্ত রাষ্ট্রকে অনুরোধ করছি বাংলাকে স্বীকৃতি দিন।’
তিনি ভাষণে আরও বলেন ‘তোমরা বাংলায় যারা কথা বলো না, তারা এখন থেকে বাংলার মানুষ হও। ভাইয়েরা, তাদের গায়ে হাত দিও না; তারাও আমাদের ভাই। বিশ্ববাসীকে আমরা দেখাতে চাই; বাঙালিরা কেবল স্বাধীনতার জন্যেই আত্মত্যাগ করতে পারে, তাই না, তারা শান্তিতেও বাস করতে পারে।’
তিনি ভাষণে আরও বলেন, ‘ইয়াহিয়া খান আমার ফাঁসির হুকুম দিয়েছিলেন। আমি বাঙালি, মানুষ, আমি মুসলমান। বাঙালিরা একবারই মরতে জানে। তাই আমি ঠিক করেছিলাম, আমি তাদের কাছে নতি স্বীকার করব না। ফাঁসির মঞ্চে যাবার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। তাদের আরও বলেছি, তোমরা মারলে ক্ষতি নাই। কিন্তু আমার লাশ বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দিও।’
তিনি ভাষণে বলেন ‘আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই যে, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোন ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এ দেশের কৃষক-শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে আমি চিনি। তাঁকে আমি জানাই আমার শ্রদ্ধা। তিনি পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর কন্যা, পণ্ডিত মতিলাল নেহেরুর নাতনি। তাঁর রক্তে মিশে রয়েছে রাজনীতি। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বের সকল রাষ্ট্র প্রধানের কাছে আমার মুক্তির জন্য আবেদন করেছেন। আমার সঙ্গে দিল্লীতে শ্রীমতী গান্ধীর আলাপ হয়েছে। আমি যখনই বলব, ভারতীয় সেনাবাহিনী তখনই ফেরৎ যাবে। এখনই আস্তে আস্তে অনেককে ফেরৎ পাঠানো হচ্ছে।’
তিনি ভাষণে আরও বলেন ‘আমি ফিরে আসার আগের ভুট্টো সাহেব অনুরোধ করেছেন দুই অংশের মধ্যে বাঁধন সামান্য হলেও রাখা যায় কিনা। আমি তখন বলেছিলাম আমি আমার মানুষের কাছে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত কিছু বলতে পারছি না। আমি বলতে চাই-ভুট্টো সাহেব, আপনারা সুখে থাকুন। আপনাদের সঙ্গে আর না। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এখন যদি কেউ বাংলাদেশের স্বাধীনতা হরণ করতে চায়, তাহলে সে স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য মুজিব সর্বপ্রথম প্রাণ দেবে। বাঙালি আর স্বাধীনতা হারাতে পারে না। আমি আপনাদের মঙ্গল কামনা করি। আমরা স্বাধীন, এটা মেনে নিন। আপনারা স্বাধীনভাবে থাকুন।’
১৯৭১’র গণহত্যার কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ৩০ লাখ মানুষকে হত্যার কথা উল্লেখ করে স্বাধীন বাংলার প্রথম এই ভাষণেই বঙ্গবন্ধু গণহত্যাকারীদের বিচারের কথা বলেছিলেন।
পাকিস্তানী জান্তারা শত প্রলোভন ও ফাসির ভয় দেখিয়েও বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে কোন কথা আদায় করতে পারেন নি । জেলে ২৯০ দিন আটক থাকা অবস্থায় প্রহরীদের সালামের উত্তর দেয়া ছাড়া জাতির পিতা কোনো কথায় বলতে পারেন নি । সেই অন্ধকার মৃত্যুকূপ থেকে ইতিহাসের সেই মহানায়ক বঙ্গবন্ধু ফিরে এসেছিলেন বাংলার মানুষের কাছে , লাল সবুজে আকা স্বাধীন দেশে ।
বাংলার রাজনীতির মুকুটহীন সম্রাট সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান না থাকলে আমরা স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলা পেতাম না । জাতির পিতার যোগ্য উত্তরসূরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতার সোনার বাংলা গড়ার জন্য নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন । যতদিন বাংলাদেশ থাকবে জাতির পিতার নাম অক্ষুণ্ণ থাকবে, তিনি বেঁচে থাকবেন লাল সবুজের বুকে। কবি অন্নদাশংকরের ভাষায় বলতে হয় ‘যতদিন রবে পদ্মা, মেঘনা, গৌরী, যমুনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’
লেখক-
মোহাঃরাকিবুল ইসলাম
শিক্ষানবিস আইনজীবী