• ঢাকা
  • শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০৯:৫৮ পূর্বাহ্ন

ব্যবহারের রকমফের


প্রকাশের সময় : অক্টোবর ২৪, ২০১৮, ৬:৪২ PM / ৩৯
ব্যবহারের রকমফের

দিলীপ গুহঠাকুরতা : আজ একদম জীবন থেকে নেয়া একটা গল্প বলি। তিনদিন আগে ২০ অক্টোবর আমার আত্মজার সাথে মানুষের ব্যবহারের মূল্য নিয়ে তর্ক হয়। ডেল কার্নেগির উপদেশ আমার মাথায়। আমার ধারণা, ভদ্র মার্জিত ব্যবহার দিয়ে এ দেশে যে কোন অফিসে গিয়ে সহজে কাজটি করিয়ে আনা সম্ভব। আমার মেয়ে আমার কথা মেনে নিলো না। তার মতে- ‘ এ দেশে এখনো অনেক অফিস আছে যেখানে তুমি একটু পোলাইট ব্যবহার করলে, টেবিলের ওপাশে বসা মানুষটিকে একটু বেশি সম্মান দিলে দেখবে তোমাকে তেমন পাত্তা দিচ্ছে না। তুমি পরীক্ষা করে দেখতে পারো।‘

আমি বললাম, আজকাল ব্যাংক, মোবাইল কোম্পানি, আইটি কোম্পানীসহ অনেক দেশীয় এবং মাল্টিন্যাশনাল প্রতিষ্ঠান আছে, সেখানে তাদের স্ট্যাফদের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে যাই।‘ যাহোক, আমি সুকন্যার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম।

প্রতিবছর ট্যাক্স রিটার্ন জমা দেয়ার সময় সাথে ব্যাংক স্টেটমেন্ট দিতে হয়। আড়াই দশক আগে একটি প্রাইভেট ব্যাংকের ধানমণ্ডি ব্রাঞ্চে আমি সস্ত্রীক দুটো একাউন্ট খুলেছিলাম। বছর কয়েক আগে ঐ ব্যাংকে অল্পকিছু টাকার দুটো ফিক্সড ডিপোজিট একাউন্টও খুলি।  পরশুদিন ২১ অক্টোবর আমি ঐ ব্যাংকের বসুন্ধরা এলাকার একটি শাখায় যাই । ব্যাংকে ঢুকেই দেখি প্রথম এন্ট্রি রুমে দুজন অফিসার টেবিলের উপর কম্পিউটার মনিটর সামনে নিয়ে বসে আছেন। একজন পুরুষ। একজন মহিলা।
আমি মহিলার টেবিলের সামনে গিয়ে খুব ভদ্রভাবে সালাম দিলাম। তিনি আমার সালামের কোন জবাব না দিয়ে মুখের চোয়াল কঠিন করে অত্যধিক গম্ভীরভাবে বললেন – ‘কী চাই? ‘
– ‘ম্যাডাম, আমার দুটো ব্যাংক স্টেটমেন্ট লাগেবে। কাইন্ডলি কি একটু করে দেবেন’।
– ‘কীসের স্টেটমেন্ট?’
– ‘ট্যাক্স রিটার্ন জমা দিতে যে স্টেটমেন্ট লাগে।‘
– ‘দুটো কেন?’
– ‘একটা আমার এবং অন্যটি আমার স্ত্রীর।‘
– ‘শুধু আপনারটা দেয়া যাবে।‘
– ‘তাহলে আমার স্ত্রীরটা?’
– ‘না, তার আসতে হবে।‘
– ‘তিনি তো অসুস্থ। পা-এ এক্সিডেন্ট করেছেন। আসতে পারবেন না।‘

তখন মহিলা অফিসার খুব তাচ্ছিল্য ভঙ্গিতে আমাকে একটা প্রিন্টেড ফর্ম বের করে দিয়ে বললেন –‘এই ফর্মটা পূরণ করে তার স্বাক্ষরসহ নিয়ে আসবেন। আর জানেন তো, প্রতি স্টেটমেন্টের জন্য ৯২০ টাকা  একাউন্ট থেকে কেটে রাখা হবে।‘
শুনে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু তা আর মুখমণ্ডলে ফুটতে দিলাম না। কাতরস্বরে বললাম – ‘কেন টাকা নিবেন? অন্য সব ব্যাংক কি এই ভাবে ফি নেয়? এটা কি সরকারি নিয়ম?’

মহিলা আরও গম্ভীর হয়ে বললেন  ‘ অন্য ব্যাংক নেয় কি না বলতে পারবো না। এটা সরকারি নিয়ম নয়, আমাদের ব্যাংকের পলিসি।‘

আমি এবার সবিনয়ে বললাম – ‘ আমাদের দুটো এফডিআর আছে, তারও স্টেটমেন্ট লাগবে। ‘
– ‘এখান থেকে দেয়া যাবে না। ফিক্সড ডিপোজিটের স্টেটমেন্ট নিতে হলে এই ব্যাংকের যে ব্রাঞ্চে একাউন্ট খুলেছেন, সেখানেই যেতে হবে।‘

মনটা খারাপ হয়ে গেলো। এতো যানজট ঠেলে ধানমণ্ডি যেতে হলে আমার একটা বেলাই মাটি হবে। আরও খারাপ লাগলো, প্রায় ষাট বছরের একজন প্রায়বৃদ্ধ আমি এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কথা বলছি, মহিলা সামান্য ভদ্রতা দেখিয়ে আমাকে সামনের খালি চেয়ারে একবার বসতে পর্যন্ত বললেন না। কী আর করা। ধানমণ্ডি যখন যেতেই হবে, আমি সেভিংস একাউন্টেরও কোন স্টেটমেন্ট না নিয়ে শুধু রিকোয়েস্ট ফর্মটা হাতে নিয়ে ব্যাংক ভবন থেকে নিষ্ক্রান্ত হলাম।

কয়েকদিন পরের কথা।

ইস্তিরি করা শার্টপ্যান্ট পরে চুল পরিপাটি করে আঁচড়িয়ে চকচকে মোকাসিন জুতো পায়ে দিয়ে যতটা সম্ভব কেতাদুরস্ত হয়ে সকাল সকাল ধানমণ্ডিতে নির্দিষ্ট ব্যাংকে উপস্থিত হলাম। ভেতরে ঢুকে সামনের দিকে দেখলাম একজন মহিলা অফিসার টেবিলে ডেস্কটপ নিয়ে ফ্রি বসে আছেন। আমি সামনে গিয়ে একদম সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মুখমণ্ডল যতটা সম্ভব গম্ভীরভাব করে খুব মুড নিয়ে মহিলার চোখের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে বললাম – ‘আমার দুটো ব্যাংক স্টেটমেন্ট লাগবে। ট্যাক্সের জন্য।’
মহিলা খুব ভদ্রভাবে চেয়ার থেকে খানিকটা উঠে আমাকে সমীহ করে বললেন, -‘স্যার আপনি বসুন প্লিজ। আমি করে দিচ্ছি।‘ এই বলে আমার  কাছ থেকে ব্যাংকের একাউন্ট নম্বর লেখা কাগজটি চেয়ে নিলেন।

এরপর মহিলা বললেন – ‘ আপনি কি জানেন স্যার, প্রতি স্টেটমেন্টের জন্য ৯২০ টাকা ফি দিতে হবে।‘
আমি বললাম – ‘ হ্যাঁ, গতকাল আমি জেনেছি। কিন্তু বুঝতে পারছি না, আমার টাকা ব্যাংকে আছে, তার স্টেটমেন্ট নিতে হলে আমাকে বাড়তি এতোগুলো টাকা কেন দিতে হবে। আমার টাকার হিসেব দেয়া কি আপনাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না?‘
মহিলা স্মিত হাসি দিয়ে অসহায়ের মতো আমার দিকে একবার তাকিয়ে আবার কাজে মন দিলেন।

আমি এবার অন্য টেবিলে গিয়ে অপেক্ষাকৃত একজন বয়স্ক মহিলার টেবিলের সামনে গিয়ে একইরকমভাবে বললাম – ‘আমার এফডিআর-এর দুটো স্টেটমেন্ট লাগবে।’ মহিলা বললেন, ‘আপনি অপেক্ষা করুন। আমি বের করে দিচ্ছি।‘

আমি আবার পুর্বের মহিলার টেবিলের সামনে এসে বসলাম। ততক্ষণে আর্কোপালের কাপে ধোঁয়া ওঠা এককাপ গরম চা চলে এসেছে। আমি চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মোবাইলের ই-বুক থেকে সৈয়দ মুজতবা আলীর  ‘চাচা কাহিনী’ নিয়ে ব্যস্ত হলাম।

আধা ঘণ্টা পরে মহিলা অফিসার বললেন – ‘এই নিন, কাগজ সব রেডি। আপনাদের এফডিআর-এর স্টেটমেন্টও চলে এসেছে।‘ মহিলা আরও বললেন –‘আপনাদের ট্রাঞ্জেকশন একদম নাই বললেই চলে। এতো ছোট কাজের জন্য ফি নিতে খারাপ লাগছে। আপনাদের ৯২০ টাকা ফি দিতে হবে না। আমি হেড অফিসে ই-মেইল করে আপনাদের স্টেটমেন্ট আনিয়ে নিয়েছি।‘

আমি তখন আমার স্ত্রীর স্বাক্ষর করা রিকোয়েস্ট ফর্মটি তার হাতে দিলাম। তিন খুব খুশি হয়ে আমাকে ধন্যবাদ জানালেন, আর বললেন, এই কাগজটা তার দরকার ছিলো।

আমি মহিলাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে একবুক প্রশান্তি নিয়ে ব্যাংক থেকে বের হয়ে আসলাম। কিন্তু মেয়ের কাছে হেরে গেলাম বলে পরাজয়ের আনন্দ হলো।

(ঢাকারনিউজ২৪.কম/জেএইচ/এসডিপি/৬:৪২পিএম/২৪/১০/২০১৮ইং)