• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১০:৪৩ অপরাহ্ন

দেশবরেণ্য সঙ্গীতজ্ঞ ও চলচ্চিত্রজন খান আতার কথা


প্রকাশের সময় : ডিসেম্বর ১২, ২০২২, ১:০২ PM / ২০৪
দেশবরেণ্য সঙ্গীতজ্ঞ ও চলচ্চিত্রজন খান আতার কথা

রিপন শান : খান আতাউর রহমান। যিনি খান আতা নামে বহুল পরিচিত ছিলেন। একজন বাংলাদেশী চলচ্চিত্র অভিনেতা, গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক, গায়ক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, কাহিনীকার, এবং প্রযোজক। তার অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র জাগো হুয়া সাভেরা । চলচ্চিত্রকার এহতেশাম পরিচালিত এ দেশ তোমার আমার তার অভিনীত প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র। নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা (১৯৬৭) এবং জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০) চলচ্চিত্র দিয়ে তিনি পরিচিতি লাভ করেন। সুজন সখী (১৯৭৫) চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার হিসেবে ১ম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। পরে এখনো অনেক রাত (১৯৯৭) চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ গীতিকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হন।

খান আতা ১৯২৮ সালের ১১ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর উপজেলার রামকান্তপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম জিয়ারত হোসেন খান এবং মাতা যোহরা খাতুন। তার মা তাকে “তারা” নামে ডাকতেন। তার মায়ের পরিবার ছিলেন মাজারের খাদিম তথা তত্ত্বাবধায়ক। ধর্মীয় উরসে তার মামা নানারকম আধ্যাত্মিক সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। ১৯৩৭ সালে ঢাকা জিলা সঙ্গীত প্রতিযোগীতায় খান আতা প্রথম স্থান দখল করেন। তিনি তখন তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। খান আতা ১৯৪৩ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশান পরীক্ষা পাশ করেন। ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষা দেন ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৪৫ এ । এরপর ১৯৪৬ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। এসময় তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের উদ্দেশ্যে বাড়ি ছেড়ে পালাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে তিনি পরিবারের এক সদস্যের চোখে পড়ে গেলে বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু অল্প কিছুদিন পরেই মেডিকেল ছেড়ে চলে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এবারো তার বোহেমিয়ান স্বভাবের কারণে তিনি সেখানে থাকলেন না। এ বছরেই তিনি লন্ডনে ফটোগ্রাফি বিষয়ক একটি বৃত্তি লাভ করেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তিনি সেখানে যাননি। ১৯৪৯ সালে আবার তিনি বাড়ি ছেড়ে পালাবার চেষ্টা করেন। এবারো উদ্দেশ্য ছিল একই। এবার তিনি প্রথমে মুম্বই যান। মুম্বাই গিয়ে তিনি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছেন, চলচ্চিত্র জগতের আনাচে কানাচে গিয়েছেন। এসময় তিনি জ্যোতি স্টুডিওতে ক্যামেরাম্যান জাল ইরানির শিক্ষানবিশ হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন।

চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব খান আতাউর রহমান তিনবার বিয়ে করেন। তার প্রথম স্ত্রী শার্লি। লন্ডন থাকাকালীন ১৯৫৮ সালে তিনি তাকে বিয়ে করেন। পরে বাংলাদেশের আসার পর ১৯৬০ সালে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। শার্লি তার সন্তানকে নিয়ে লন্ডন চলে যান। পরে ১৯৬০ সালে তিনি কণ্ঠশিল্পী মাহবুবা রহমানকে বিয়ে করেন। তার তৃতীয় স্ত্রী নীলুফার ইয়াসমীন। ১৯৬৮ সালে তিনি তাকে বিয়ে করেন। খান আতা ও মাহবুবা রহমানের ঘরে জন্ম নেন কণ্ঠশিল্পী রুমানা ইসলাম। অপরদিকে খান আতা ও নিলুফারের ঘরে জন্ম নেন বর্তমান প্রজন্মের গায়ক ও অভিনেতা খান আসিফ আগুন। ১৯৫০ সালের জানুয়ারিতে চলে আসেন করাচি। করাচী এসে তিনি যোগ দেন রেডিও পাকিস্তান এ সংবাদপত্র পাঠক হিসেবে। এখানেই আরেকজন প্রতিভাবান বাঙালি ফতেহ লোহানীর সাথে তার সখ্যতা গড়ে উঠে। তখনো চলচ্চিত্রের ব্যাপারে তার উৎসাহ কমেনি। যার কারণে তিনি প্রায়ই লাহোর যেতেন। এসময় তিনি সারঙ্গী বাদক জওহারি খানের কাছ থেকে তালিম নেয়া শুরু করেন। ফতেহ্‌ লোহানী কিছুদিন পরে লন্ডন চলে গেলে ১৯৫২ সালে খান আতা একটি পোল্যান্ডীয় জাহাজে করে লন্ডন পাড়ি জমান। সেখানে অনেক বাঙালি অনুষ্ঠানে গায়ক এবং অভিনেতা হিসেবে তিনি অংশগ্রহণ করেন। এখানে এস এম সুলতানের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। এস এম সুলতানের চিত্রকর্মের উপকরণ যোগানে সাহায্য করেন তিনি। খান আতা এবং তার সাথীরা এস এম সুলতান-এর চিত্রকর্মের প্রদর্শনী এবং বিক্রয়ের ব্যবস্থা করেন। লন্ডনের সিটি লিটারেরি ইন্সটিটিউটে তিনি থিয়েটার ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হন। পরের বছরেই তিনি ইউনেস্কো বৃত্তি নিয়ে নেদারল্যান্ডে চলে যান। ১৯৫৫ সালে আবার লন্ডনে ফিরে এসে থিয়েটার রয়াল, ইউনিটি থিয়েটার, আরভিং থিয়েটারে সকল স্থানীয় গ্রুপের সাথে কাজ করতে থাকেন। এসময় তিনি কিছুদিন বিবিসি’র সাথেও কাজ করেছেন। ১৯৫৭ তে ফিরে আসেন ঢাকায়। এসেই তিনি পাকিস্তান অবজারভারে চাকরি নেন। এরপর তিনি রেডিওতে গীতিকার, সঙ্গীত পরিচালক, আবৃত্তিকার এবং অভিনেতা হিসেবে যোগ দেন।
খান আতা ১৯৫৯ সালে পাকিস্তানি পরিচালক আখতার জং কারদার পরিচালিত উর্দু ভাষার চলচ্চিত্র জাগো হুয়া সাভেরাতে মূল ভূমিকাতে অভিনয়ের মাধ্যমে তার চলচ্চিত্র জীবন শুরু করেন। এতে তার বিপরীতে ছিলেন ভারতীয় অভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্র। এ ছায়াছবির সহকারী পরিচালক ছিলেন জহির রায়হান। চলচ্চিত্র জগতে তিনি আনিস নামটি ব্যবহার করতেন। একই বছরে মুক্তি পায় তার অভিনীত প্রথম বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র “এ দেশ তোমার আমার”। এই চলচ্চিত্রের পরিচালক ছিলেন এহতেশাম। ১৯৬০ সালে জহির রায়হানের সাথে গড়ে তোলেন লিটল সিনে সার্কেল। এতে পরের বছরগুলোতে তার জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। অভিনেতা হিসেবে তিনি কাজ করেছেন কখনো আসেনি, যে নদী মরুপথে, সোনার কাজল, জীবন থেকে নেয়া, সুজন সখী এর মতো সফল চলচ্চিত্রে। খান আতা সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে প্রথম কাজ করেন এহতেশাম পরিচালিত এ দেশ তোমার আমার চলচ্চিত্রে। পরে ১৯৬২ সালে সূর্যস্নান ছায়াছবিতে তিনি উপহার দেন পথে পথে দিলাম ছড়াইয়া রে এর মতো গান। যাতে কন্ঠ দেন কলিম শরাফী। ১৯৬৩ সালে জহির রায়হানের কাঁচের দেয়াল ছায়াছবিতে তিনি নিয়ে আসেন শ্যামল বরণ মেয়েটি শীর্ষক একটি জনপ্রিয় গান। সূর্যস্নান ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ গীতিকার হিসেবে এবং কাচের দেয়াল ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান চলচ্চিত্র উৎসব-এ তিনি পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন বাহানা, সাগর, আখেরি স্টেশান, মালা প্রভৃতি উর্দু ছবিতে। ১৯৭০ সালে জহির রায়হান পরিচালিত জীবন থেকে নেয়াতে তিনি এ খাঁচা ভাংবো আমি কেমন করে শীর্ষক গানের কথা লিখেন এবং নিজেই কন্ঠ দেন। ’৭০ এবং ’৮০’র দশকে উপহার দেন সাবিনা ইয়াসমীনের কন্ঠে এ কি সোনার আলোয়, শহনাজ রহমতুল্লাহের কন্ঠে এক নদী রক্ত পেরিয়ে এর মতো গান। খান আতাউর রহমান প্রায় ৫০০ গানের গীতিকার। এখনো অনেক রাত চলচ্চিত্রের জন্য তিনি ২২তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ গীতিকারের পুরস্কার অর্জন করেন।
তার প্রথম পরিচালিত চলচ্চিত্র অনেক দিনের চেনা। ছায়াছবিটি ১৯৬৩ সালে মুক্তি পায়। ১৯৬৭ সালে তিনি বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার জীবনী নিয়ে নির্মাণ করেন নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা। চলচ্চিত্রটি ১৯৬৯ সালে মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব-এ প্রদর্শিত হয় এবং শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে গোল্ডেন প্রাইজের জন্য মনোনীত হয়। এরপর তিনি নির্মাণ করেন সাত ভাই চম্পা, অরুণ বরুণ কিরণমালা, জোয়ার ভাটা। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৩ সালে নির্মাণ করেন আবার তোরা মানুষ হ ; যার বিষয়বস্তু ছিল যুদ্ধ পরবর্তী বাস্তবতা। ১৯৭৫ সালে প্রমোদ কর ছদ্মনামে গ্রামীণ পটভূমিতে নির্মাণ করেন রোমান্টিক চলচ্চিত্র সুজন সখী। এই চলচ্চিত্রের জন্য তিনি ১ম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার হিসেবে পুরস্কৃত হয়। ৮০’র দশকের নির্মাণ করেন হিসাব নিকাশ এবং পরশপাথর নামের দুইটি ছায়াছবি। মুক্তিযুদ্ধের উপর ১৯৯৪ সালে তিনি এখনো অনেক রাত চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ শুরু করেন। ১৯৯৭ সালে ছবির কাজ শেষ হয়। কিন্তু সেন্সর বোর্ড ছবির ৭টি স্থানে দৃশ্য কেটে ফেলার নির্দেশ দেয়ায় ক্ষুব্ধ হন তিনি। তিনি বাংলার কবি জসীম উদ্‌দীন, গঙ্গা আমার গঙ্গা, গানের পাখি আব্বাস উদ্দিন সহ বেশকিছু তথ্যচিত্রও তৈরি করেছেন।

১৯৯৭ সালের ১ ডিসেম্বর তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে অনন্ত কালের দেশে চলে যান।