• ঢাকা
  • রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:১১ পূর্বাহ্ন

জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে ‘আঁধারে আলো বয়স্কশিক্ষা নিকেতন’


প্রকাশের সময় : জুন ৭, ২০১৭, ৩:১৩ PM / ৩৬
জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে ‘আঁধারে আলো বয়স্কশিক্ষা নিকেতন’

 

ঢাকারনিউজ২৪.কম, শিবগঞ্জ(চাঁপাইনবাবগঞ্জ) : স্যারের দেয়া বই, শ্লেট ও চক পেয়ে স্যারের স্কুলে হামরা ৪ মাসের ল্যাইগা ল্যাখা পড়া করতে এ্যাসাছি। গেল দুমাসে ম্যালাই শিখেছি। হামি হামার নাম,বাড়ির মালিকের (স্বামী) নাম লেখতে পারি। হেসাব করতে পারি।ছোট ছোট বই গ্যালা পড়তে পারি। হামরা ২৬ বেটিছালা(মহিলা) এক দলে( ব্যাচে) আছি। স্যারেরকাছে ৪ মাস পইড়্যার পর হামরা সবাই পেরাইমারী( প্রাইমারী) স্কুলে যাবো। যদিন বাঁচবো তদিনই পহড়বো। মানুষে যা পারবে তাই কহুক গা(সমালোচনামূলক কথা)। কথাগুলো বললেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার মোবারকপুর ইউনিয়নের সাহেবগ্রামের হযরত আলির স্ত্র্রী ৭৫ বছরের বৃদ্ধা গাজলী বেগম। শুধু গাজলী বেগমই নয় একই গ্রামের মৃত সলেমানের স্ত্রী রাশেদা বেগম(৭৫) মৃত সহিমুদ্দিনের স্ত্রী শহববানু(০ ও গাজলীর পুত্রবধূ মনোয়ারা বেগম সহ উপস্থিত ২৬ জন মহিলা। গতকাল সরজমিনে গিয়ে দেখা হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ সরকারী কলেজের সম্মান ২য় বর্ষের ইতিহাসের ছাত্র ও সাহেব গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মনিরুলের ছেলে আব্দুর রবের বাড়ির নিজ উঠানে অক্ষর দানের সময়। সেখানে এক দলে ২৬ মহিলাকে পাঠ দান দিচ্ছে আব্দর রব । সবার বয়স ৪০ থেকে ৭৫ বছরের মধ্যে। রব নিজ উদ্যোগে ও নিজ খরচে বর্তমানে আঁধারে আলো বয়স্ক শিক্ষা নিকেতন নামে নিজ উদ্যোগে তিনটি ইউনিয়নে কয়েকটি দল গঠন করে ১৪জন পুরুষ ও ১৩৬জন মহিলা মোট ২৭৬ নারী পুরুষদের অক্ষর দান করছেন এবং বর্তমানে আরো কয়েকটি দল নিয়ে অক্ষর দানের কাজ চলছে।
শিক্ষার্থী আব্দুর রব জানান ২০০৯সালে যখন আমি সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষাথী তখন গ্রামের নেফাউর রহমানের ছেলে তোহরুল ইসলাম আমার নিকট নাম লিখতে শেখার জন্য আসে। তখনই আমি চরমভাবে অনুতপ্ত হই। কয়েকদিন পর আমি তাকে নাম লিখতে শিখিয়ে দিই এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যে তাকে বেশ কিছু দিন অক্ষর দানের মাধ্যমে সে নিজের চলার মত সব কিছু পড়তে ও লেখতে পারল তখন আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম আমি গ্রামের সকল নিরক্ষরকে অক্ষর দান করবো।
অক্ষর দান শুরু:২০১৩সালে এস এসসি পরীক্ষা দিয়ে আমার পৃর্বপরিকল্পনানুযায়ী আমার ব্যবহূত সাইকেল ও মোবাইল সেট বিক্রী করে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ,শতকিয়া, কিছু ধর্মীয় শিক্ষা নিয়ে ও কিছু ছন্দ বাক্যের সমন্বয়ে নিজের রচিত বইয়ের কিছু কপি করে এলাকার তানভির রহমান ও জাফর আলি সহ কয়েকজনের উৎসাহে আমার নিজ বাড়ির উঠানে মাটিতে চট ছালা বিছিয়ে ১৫ হতে ৬০/৬৫ বছর বয়সের ৪ মাস পযন্ত অক্ষর দান করি। মাত্র ৪মাসের ব্যবধানে প্রথম ব্যাচটি চরম সাফল্য লাভ করায় আমার উৎসাহ আরো বেড়ে যায়।
পরবর্ততে আমার পরিকল্পনার কথা গ্রামের তানভির আলম তুষারের নিকট প্রকাশ করলে সে আমাকে উৎসাহ, উদ্দীপনা ও সহযোগিতা করায় প্রতিশ্র“তি দেয়। তখন থেকে আমার পিতা লেখাপড়া করতে যে অর্থ দেন তা থেকে কিছু সঞ্চয় করি, মৃতকালে আমার দাদার দেয়া কিছু টাকা দিয়ে একটি গরু পালন করে বছরের শেষে যে মুনাফা পাই তা দিয়ে ও মাঝে মাঝ আমার পিতা কিছু টাকা দেয় সব মিলিয়ে আমি আরো কয়েকটি ব্যাচ সৃষ্টি করি। বর্তমানে নারী ও পুরুষের দুটি ব্যাচ চলছে । এক প্রশ্নের জবাবে আব্দুর রব জানান অক্ষর দানের প্রসার ঘটাতে আমি কানসাট, চককীর্র্তি ও মোবারকপুর ইউনিয়নে ৮/৯ ওয়ার্ডে জরিপ করেছি। কোন গ্রামে কত শতাংশ নিরক্ষর রয়েছে তা তালিকাভুক্ত করেছি। যেখানে নিরক্ষরদের সংখ্যা বেশী সেখানে আমি বাড়ি বাড়ি আঁধারে আলো বয়স্ব শিক্ষা নিকেতনের মাধ্যমে অক্ষর দানের কথা প্রচার করি। এভাবে আমি জেগেছে যুবক,জেগেছে দেশ গড়বো মোরা নিরক্ষরমুক্ত বাংলাদেশ এ শ্লোগানকে সামনে রেখে আমার কাজ চালিযে যাচ্ছি।
শিক্ষার্থী আব্দুর রবের স্বপ্ন প্রথমে নিজ থানা ও জেলা এমনকি সারা দেশে এভাবে অক্ষর দানের কার্যক্রম চালু করবো। যাতে আমার এ সোনার বাংলাদেশে কোন নিরক্ষর না থাকে। তবে আম কোন বিত্তবানদের নয় স্বউদ্যোগী যুবকদের সহযোগিতা কামনা করছি। আমার মতে প্রতিটি গ্রামে যদি আমার মত নিজ উদ্যোগে ১০ জন করে যুবক নিরক্ষর দূরীকরনে পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তবে একদিকে যেমন নিরক্ষর দূর হবে অন্যদিকে দেশপ্রেমের পরিচয় দেয়া হবে এবং সংগে সংগে পরকালের মুক্তির পথও সুগম হবে।
আব্দুর রবের স্বপ্ন সে কোনদিন চাকুরী করবে ন্।া চাকুরী করলে সে নিরক্ষর মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার কাজ করা সম্ভব হবে না। জীবীকার তাগিদে লেখাপড়া শেষ করে বড় করে একটি গরুর খামার দিবে। সেখানে সে নিজেই কাজ করবে এবং এরই ফাঁকে নিরক্ষরদেরকে জ্ঞান দান করবে।গরুর খামারের লাভের একটি অংশ এ কাজের জন্য বরাদ্দ থাকবে এবং আর এক অংশ দিয়ে সংসার চালাবে। সংগে সংগে আন্যান্য এলাকায় কয়েকজন যুবককে নিজ তহবিল থেকে সম্মানী ভাতা দিবে।
আব্দুর রবের এ কাজে এখন পর্যন্ত কেউ কোন ধরনের আর্থিক সহযোগিতা করেননি। তবে প্রথমদিকেই কানসাট সলেয়মান ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ শফিকুল ইসলাম বিশ্বাস ২০টি শ্লেট কিনে দিয়েছিলেন এবং আমাকে উৎসাহ প্রদান করেছেন। তিনি আরো জানান, বিভিন্ন সংস্থা থেকে আমার নিকট প্রস্তাব এসেছে তাদের হয়ে কাজ করার জন্য। কিন্তু নানাবিদ করনে আমি রাজী নয়।
আব্দুর রবের এ কাজকে শতভাগ ভাল কাজ উল্লেখ করে উপজেলার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যন সায়েমা বেগম বলেন, আমাদের সবার উচিত আব্দররবের আঁধারে আলো বয়স্কনিকেতনকে তরান্তিত করতে এগিয়ে আসা। আমার পক্ষ থেকে যতটুকা পারি সহযোগিতা করবো। তিনি আরো আশাবাদী যে তার মাধ্যমে শিবগঞ্জের সমস্ত নিরক্ষর জ্ঞানের আলো পাবে। মোবারকপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তোহিদুর রহমান মিঞ্জা বলেন, অবশ্যই এটি ভাল কাজ,শুধু আমার ইউনিয়ন নয়, তার মাধ্যমে সারা উপজেলায় আঁধারে আলো বয়স্ক শিক্ষা নিকেতন চালু করতে তার সাথেই আছি এবং থাকবো।কানসাট সলেয়মান ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ শফিকুল ইসলাম বিশ্বাস জানান আঁধারে আলো বয়স্ক শিক্ষা নিকেতনের মাধ্যমে আব্দুর রব অক্ষর জ্ঞান ছড়ার কাজটি মাইলফলক হয়ে থাকবে এবং সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। একই ভাবে সুর মিলিয়ে গ্রামের সব পেশার প্রায় ৫০/৬০জন একই ধরনের মন্তব্য দেন।
(ঢাকারনিউজ২৪.কম/এসডিপি/৩:১২পিএম/৭/৬/২০১৭ইং)