• ঢাকা
  • রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৫৮ পূর্বাহ্ন

চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমবাগান আস্তানায় চার ‘জঙ্গির’ লাশ


প্রকাশের সময় : এপ্রিল ২৮, ২০১৭, ৮:০৮ AM / ৩৪
চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমবাগান আস্তানায় চার ‘জঙ্গির’ লাশ

ঢাকারনিউজ২৪.কম:চাঁপাইনবাবগঞ্জ:

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার শিবনগর-ত্রিমোহনী গ্রামে আমবাগান ঘেরা ‘জঙ্গি আস্তানা’য় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের ‘অপারেশন ঈগল হান্টে’র সময় আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চার জঙ্গি নিজেদের উড়িয়ে দিয়েছে বলে দাবি পুলিশের। তবে আহত অবস্থায় এক নারী ও এক শিশুকে উদ্ধার করা হয়েছে।

অভিযান শুরুর ৩৬ ঘণ্টা পর গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তা সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। অভিযান শেষে পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সোয়াট টিমের অভিযানের মধ্যেই গতকাল সন্ধ্যায় আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটায় জঙ্গিরা। এতে চারজন মারা যায়। এর মধ্যে তিন মাস আগে ওই বাড়িতে ওঠা রফিকুল ইসলাম আবুও (৩০) রয়েছেন। অন্য তিনজনও পুরুষ।

তবে আবুর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী সুমাইয়া খাতুন (২৫) ও মেয়ে সাজিদা খাতুনকে (৪) আহত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেছে পুলিশ। তাদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুলি ও বোমার স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়েছে। আবুর আরেক সন্তান নূরী (৮) তার নানিবাড়িতে রয়েছে বলে জানা গেছে।

সন্ধ্যায় সোয়াটের অভিযান শেষ হওয়ার পর বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল বাড়িটিতে তল্লাশি চালায়। এ সময় বেশ কয়েকটি শক্তিশালী গ্রেনেড ও বোমা উদ্ধারের পর নিষ্ক্রিয় করা হয়। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বাড়িটি ঘিরে রেখে তল্লাশি অব্যাহত রেখেছে পুলিশ।

গতকাল সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) এম খুরশিদ হোসেন এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, সন্ধ্যার আগে সোয়াট সদস্যরা জঙ্গি আস্তানায় ঢুকে পড়ে। তারা জঙ্গি রফিকুল ইসলাম আবুসহ চারজনের মরদেহ উদ্ধার করে। চার জঙ্গি আত্মঘাতী হয়। ধারণা করা হচ্ছে, অভিযানকালে সন্ধ্যার দিকে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে তারা নিহত হয়। নিহত অন্য তিন জঙ্গির পরিচয় তিনি জানাতে পারেননি। নিহত আবুসহ অন্যরা জেএমবির সদস্য বলে জানান তিনি।

এম খুরশিদ হোসেন বলেন, জঙ্গি আস্তানা থেকে আবুর স্ত্রী ও শিশু সন্তানকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারের পর তাদের চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ডিআইজি আরো জানান, সোয়াটের ‘অপারেশন ঈগল হান্ট’ সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। তবে বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল অভিযান চালাচ্ছে।

রাতে সিটিটিসি ইউনিটের উপকমিশনার মহিবুল ইসলাম খান ঘটনাস্থল থেকে  বলেন, অভিযান শেষের পরে চারটি লাশ পাওয়া গেছে। ভেতরে গ্রেনেডসহ কয়েকটি বোমাও পাওয়া যায়। সেগুলো নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। এখন সুইপিং বা তল্লাশির কাজ চলছে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিহতদের পরিচয় এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে তারা আত্মঘাতী হয়েছে। বোমাগুলো শক্তিশালী ছিল। তবে সুইসাইডাল ভেস্টের মাধ্যমে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে কি না তা বোঝা যাচ্ছে না বলে জানান তিনি।

সরেজমিনে জানা গেছে, গত বুধবার সকাল থেকে শিবগঞ্জের শিবনগর-ত্রিমোহনী গ্রামে আমবাগানের মধ্যে সাইদুর রহমান ওরফে জেন্টু বিশ্বাসের একতলা বাড়ি ঘিরে অভিযান শুরু করে পুলিশের সিটিটিসি ইউনিট। অভিযানের সামনে ছিল সোয়াট দল। পুলিশের কাছে খবর ছিল, একতলা ওই বাড়িতে রফিকুল ইসলাম আবু (৩০) নামের এক জঙ্গি এবং তাঁর স্ত্রী-সন্তানসহ চারজন আছে। বুধবার সকালেই স্থানীয় প্রশাসন গোটা এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। বিকেলে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে করে সোয়াট দল যাওয়া পর আমবাগান ঘেরা ওই বাড়িতে চূড়ান্ত অভিযান শুরু হয়। তবে দুই ঘণ্টা পরই আবার স্থগিত ঘোষণা করা হয়। গতকাল সকাল থেকে ফের অভিযান শুরু করে পুলিশ। বুধবারের মতো গতকাল দুপুর ১২টার দিকে জঙ্গিদের আত্মসমর্পণ করতে মাইকে আহ্বান জানানো হয়। তবে এ আহ্বানে কেউ সাড়া দেয়নি। এরপর দুপুরে একটি ও বিকেল ৪টার দিকে দুটি বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়। অভিযান চলাকালে বিকেল ৫টার পর ওই বাড়ি থেকে এক নারী ও এক শিশুকে বের করে আনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আলাদা অ্যাম্বুল্যান্সে তাদের বের করে হাসপাতালে নেওয়া হয়।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতালে নেওয়া ওই নারী হলেন জঙ্গি আবুর স্ত্রী সুমাইয়া। আর শিশুটি আবুর ছোট মেয়ে সাজিদা খাতুন। এর মধ্যে সুমাইয়ার পায়ে গুলি লেগেছে। সে চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা বলেও জানা গেছে।

সিটিটিসির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, ওই আস্তানায় আত্মঘাতী হওয়া চারজনের মধ্যে একজন আবু। দুই মাস আগে সে-ই বাড়িটি ভাড়া নিয়েছিল। নিহত বাকি তিন জঙ্গিও পুরুষ। তাদের পরিচয় জানা যায়নি।

তবে অন্য একটি সূত্র জানায়, আবু ওই বাড়িতে তার স্ত্রী সুমাইয়া, দুই মেয়ে নূরী ও সাজিদাকে নিয়ে থাকত। সাজিদা ও সুমাইয়াকে উদ্ধার করা হলেও নূরীর হদিস মিলছিল না। বোমায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়া লাশের মধ্যে নূরী আছে কি না তা যাচাই করা হচ্ছিল। পরে জানা গেছে নূরী তার নানির বাড়িতে আছে।

অভিযান সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অন্তঃসত্ত্বা সুমাইয়া তার গর্ভের অনাগত সন্তান ও মেয়ে সাজিদাকে বাঁচাতে স্বামীসহ অন্য জঙ্গিদের কাছ থেকে দূরে চলে যায়। এ কারণে সে বেঁচে গেছে।

পুলিশ সূত্র জানায়, প্রায় এক মাস আগে জেএমবির জঙ্গি আবুর বাড়ির আস্তানার হদিস পায় সিটিটিসি ইউনিট। গত মঙ্গলবার রাতে শিবগঞ্জের মোবারকপুর ইউনিয়নের শিবনগর ত্রিমোহনী গ্রামে অভিযান চালিয়ে মাইনুল ইসলামের ছেলে মাহফুজুর রহমান মোহন, রবু বিশ্বাসের ছেলে আবদুস সালাম ও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি মনিরুল ইসলামকে আটক করে। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী সিটিটিসি ত্রিমোহনী শিবনগরের প্রত্যন্ত এলাকা সাইদুর রহমান জেন্টু বিশ্বাসের বাড়ি ঘিরে ফেলে। সেদিন ভোর ৫টার দিকে অভিযান টের পেয়ে ওই বাড়ি থেকে একটি বিস্ফোরণ ঘটানো হয় এবং পুলিশকে লক্ষ্য করে এক রাউন্ড গুলিও ছোড়া হয়। জবাবে পুলিশও বেশ কয়েক রাউন্ড পাল্টা গুলি চালায়।

তিন মাস আগে চাচরা গ্রামের দিনমজুর আফসার আলীর ছেলে রফিকুল ইসলাম আবুকে ভাড়া ছাড়াই ওই বাসায় থাকতে দেন জেন্টু বিশ্বাস। এক সময় মাদরাসায় পড়া আবু একজন ভ্রাম্যমাণ মসলা বিক্রেতা।

আবুর মা ফুলছানা বেগম বলেন, প্রায় ৯ বছর আগে সুমাইয়া খাতুনের সঙ্গে বিয়ের পর একই উপজেলার আব্বাস বাজারে শ্বশুর বাড়িতেই থাকতেন আবু। মাস তিনেক আগে তিনি জেন্টুর বাড়িতে ওঠেন। ভিন্ন তরিকায় নামাজ আদায় ও চলাফেরার কারণে পরিবারের সঙ্গে আবুর সম্পর্ক ছিল না।

স্থানীয়রা জানায়, আবুর বাড়িতে কয়েকজন অপরিচিত লোক আসা-যাওয়া করত। তবে তার স্ত্রী সুমাইয়া পর্দা করতেন। কারো সঙ্গেই দেখা করতেন না।

স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, নিহতদের লাশ এতটা ক্ষতবিক্ষত হয়েছে যে চেহারা চেনা যাচ্ছে না। তাদের মরদেহগুলো চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে নিহতদের পরিচয় যাচাই করার চেষ্টা করা হবে বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।

সমপ্রতি চট্টগ্রাম, সিলেট ও সুনামগঞ্জে কয়েকটি বাড়িতে অভিযান চালানোর পর পুলিশ গত শুক্র ও শনিবার ঝিনাইদহের একটি বাড়ি ঘিরে অভিযান চালিয়ে ‘বিপুল বিস্ফোরক ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম’ উদ্ধার করে। এরপর মঙ্গলবার দিনভর রাজশাহীর একটি এলাকায় কয়েকটি বাড়ি ঘিরে ‘ব্লক রেইড’ চলে। তবে সেখানে কোনো জঙ্গি আস্তানার খোঁজ পায়নি পুলিশ।

 

  (ঢাকারনিউজ২৪.কম/এনএম ০৮.০৪এএম/২৮//২০১৭ইং)