• ঢাকা
  • শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ০৯:০৬ পূর্বাহ্ন

‘এ কী কথা শুনি আজি মন্থরার মুখে?’


প্রকাশের সময় : ডিসেম্বর ১০, ২০১৮, ১২:৫৪ PM / ৩৯
‘এ কী কথা শুনি আজি মন্থরার মুখে?’

অসীম সাহা : বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কণ্ঠে নির্বাচন-কমিশনের প্রশংসা শুনে আমার তো ভিরমি খাবার জোগাড়। জন্মের পর থেকে নির্বাচন কমিশন এবং তার কমিশনার বিশেষত নূরুল হদাকে আক্রমণে আক্রমণে জর্জরিত করে ফেলার জন্য বিএনপির সিকি, আধা এবং আস্ত নেতারা যেখানে হাতমাইক, চোঙ্গামাইক, এমনকি ডোঙ্গামাইক ব্যবহার করে করে ক্লান্ত, যখন বিএনপির স্থায়ী মুখপাত্র রিজভী বিএনপির গৃহকর্তা হিসেবে খুব দরাজ কণ্ঠে ও প্রমিত ভাষায় মিথ্যের খেয়ালে নিয়মিত গলা সাধার কসরত করে যাচ্ছিলেন এবং নির্বাচন কমিশনারকে এক দণ্ডের জন্যও সোজা হয়ে দাঁড়াতে দেননি; তখনি হঠাৎ করে মির্জা ফখরুলের নূরুল হুদাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন বিস্ময়কর বৈকি। এই ধন্যবাদের কারণ কী? যেসব বিএনপি নেতার মনোনয়ন নানা কারণে বাতিল হয়ে গিয়েছিলো, সেখানে সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের যোগসাজস অথবা সরকারি নির্দেশে বিএনপি প্রার্থীদের বাদ দেয়ার ষড়যন্ত্র খুঁজে পেয়ে তারা তাদের ছুরিতে এমন ধার দিতে শুরু করেছিলেন যে, তা ঝা-চকচকে হয়ে কশাইয়ের চাপাতির চেয়েও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছিলো। কিন্তু আপিলে সেই প্রার্থীরা নির্বাচন করার সুযোগ পাওয়াতে এখন নির্বাচন কমিশন ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য হয়ে গেলো?
তার মানে নিজেদের পক্ষে গেলে সব ভালো। আর কারণ কিংবা অকারণে তাদের বিপক্ষে গেলেই সব কারসাজি, যোগসাজশ কিংবা সরকারি হস্তক্ষেপের ব্যাধি, যা বিএনপির মগজকে ধোলাই করে রেখেছিলো, তা থেকে বেরিয়ে আসায় মির্জা ফখরুল কি ঠিক কাজটি করলেন নাকি ভুলের ফাঁদে আটকে গিয়ে ভুলের আঠাতেই জড়িয়ে পড়লেন, তার লক্ষণ এরই মধ্যে পাওয়া গেলো। মির্জা ফখরুল যতোই নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ দিন, তাদেরই আরেক নেতা, বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান ইনাম আহমেদ চৌধুরীর কণ্ঠে তারই উল্টো অগ্রভাষ পাওয়া গেলো! তিনি অভিযোগ তুলে বললেন, “নির্বাচন কমিশন পক্ষপাতমূলক আচরণ করছেন।” তা হলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো? একদিকে ধন্যবাদ, অন্যদিকে কুপোকাৎ করার এই প্রয়াস কি ইতিবাচক রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ হলো?
বুঝি, রাজনীতিতে চাপে রাখা একটি কৌশল, যাতে নির্বাচন কমিশন কিংবা সরকার সতর্ক থাকে। কিন্তু বেশি টিপলে যে লেবু তেতো হয়ে যায়, বিএনপি নেতাদের সেটাও মনে রাখা দরকার! তারা ভুলে গেলে চলবে কেন, তাদের শাসনামলে আজিজুর রহমানমার্কা নির্বাচন কমিশন, ইয়াজউদ্দিনমার্কা রাষ্ট্রপতি আর মাগুরামার্কা নির্বাচন করে যে নেতিবাচক কর্মকে তারা জায়েজ করার চেষ্টা করেছিলেন, তা কিন্তু এখনো জনগণ ভুলে যায়নি। তা হলে ‘আপনি আচরি ধর্ম, পরকে শেখাও’ এই আপ্তবাক্য তাদেরই তো ঠোঁটস্থ করে রাখার কথা। তা না করে শুধু শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে নামানোর প্রতিহিংসায় ড. কামালের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে আর তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের দিয়ে “দিনভর চৌপর দেয় দূর পাল্লা’ বলে নৌকা চালানোর বদলে ধানের শীষ কাঁধে বহন করে নিতে বললে জনগণ তা হতে দেবে কেন? বিএনপি যে বঙ্গবন্ধুহত্যা, মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের গাড়ি-বাড়িতে পতাকা তুলে দেয়া, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে শেখ হাসিনার জীবন কেড়ে নেয়ার চেষ্টা, হরতালের নামে আগুনসন্ত্রাস করে দেশকে একটি দোজখে পরিণত করে ফেলেছিলো, সেখানে কোন্ মুখে তারা লেভেল প্লেইং ফিল্ড, সমান্তরাল মাঠ, সমান সুযোগ প্রভৃতি কথাগুলো চিৎকার করে বলেন? মানুষ কি এতোটাই বিস্মৃতিপ্রবণ হয়ে গেছে যে, তারা বিএনপিকে তাদের ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনেই ফেলবে? আনবে না যে, তা তারাও হয়তো জানেন। তাই ড. কামাল, কাদের সিদ্দিকী, আসম আবদুর রব প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কাজেই তারা নিয়োজিত করেছেন। এটা যে তারা করতে পেরেছেন, সে-জন্যে তারা নিশ্চয়ই ক্রেডিট পাবার যোগ্য। তার সঙ্গে আরো অনেক আদর্শহীন ডিগবাজি-নেতা যে বিএনপির ‘উদার’ কোলে আশ্রয় পেয়েছেন, সেটাই বা কম কিসে? যদি কোনো কারণে নির্বাচনে বিএনপি পরাজিত হয়, তখন দেখা যাবে, এইসব নেতা আবার পল্টি খেয়েছেন। তাতে অবশ্য বিএনপির কিছু এসে যাবে না। শুধু আদর্শহীনতার কারণে রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়ে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ দিতে দিতে পশ্চিমে রওয়ানা দেয়া ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় থাকবে না!
রাজনীতিতে ন্যূনতম আদর্শ না থাকলে সে-রাজনীতি ও দলের ভাগ্যে কী ঘটে, তার ইতিহাস এদেশেই আছে। আজ মুসলিম লীগ কোথায়? এমনকি ভাসানীর মতো এতো বড় দলের হুকুমবরদাররা? আজ আর তাদের কোনো অস্তিত্বই নেই। রাজনীতিকে সদর্থক ধারায় আনতে না পারলে বিএনপিও যে দল হিসেবে বিলীন হয়ে যাবে, সে-ব্যাপারে সংশয়ের কোনো কারণ আছে কি? বিগত নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে বিএনপি যে ভুল করেছে, সেই একই ভুল আর না করলেই ভালো। উল্টা-পাল্টা কথা না বলে, অকারণে নির্বাচন কমিশনকে চাপে রাখার নীতি থেকে সরে এসে নির্বিঘ্নে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে তাতে বিএনপির অস্তিত্ব ক্ষীণকায় হলেও থাকবে। আর তখন হয়তো সময়মতো তাদের নদীতে কিছুটা হলেও জোয়ার আসতেও পারে। তা না হলে ক্ষীণকায় নদী থেকে খাল এবং খাল থেকে হাজামাজারপুকুর হতে বিএনপির জন্য বেশি সময় লাগবে না। মির্জা ফখরুলের কণ্ঠে নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ দেয়ায় ‘একী কথা শুনি আজি মন্থরার মুখে?’ মধুসূদনের এই পংক্তিটি মনে পড়লেও বিএনপির অন্য নেতারা যাতে তাতে জল ঢেলে না দেন, সেদিকে লক্ষ রাখাটা বিএনপির সিনিয়র নেতাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করি। তা না হলে তাদের জন্য এক অন্ধকার খাদের কিনার ছাড়া আর কিছুই যে অবশিষ্ট থাকবে না, ইতিহাস তাই বলে।

লেখক : কবি ও সংযুক্ত সম্পাদক, দৈনিক আমাদের নতুন সময়
(ঢাকারনিউজ২৪.কম/এসডিপি/১২:৫৪পিএম/১০/১২/২০১৮ইং)