• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ০৮:০২ পূর্বাহ্ন

আমাদের বাঁচতে দিন


প্রকাশের সময় : নভেম্বর ৭, ২০২৩, ৯:১১ PM / ১৯২
আমাদের বাঁচতে দিন

মীর আব্দুল আলীম : না আর ভাল্লাগেনা। দুঃসংবাদ শুনছি। নানা রোগে মানুষ মরছে প্রতিদিন। কেউ
আবার অর্থাভাবে চিকিৎসাও করতে পারছেন না। ভেজাল খাদ্যের কারনেই এমন
হচ্ছে। কারো কিডনি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, ফুসফুস আক্রান্ত হচ্ছে, ক্যানসারের
কিংবা অন্য কোনো জটিল রোগে ভোগছেন স্বজনরা। নিজেও সুস্থ নই। ক্যানসারে
মারা গেছেন চাচা, ভাইটাও ক্যানাসারে আক্রান্ত। বাড়ির পাশের ছোট্র শিশুটা
জটিল সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তির পর জানানো হলো তার ব্লাড ক্যান্সার
হয়েছে। শেষ ষ্ট্রেজ। ক’মাস হয়তো বাঁচবে। আসলে রোগবালাই পেয়ে বসেছে
আমাদের। মানুষ অকাইে মারা যাচ্ছে। বিষ খেলে মানুষতো মরবেই। বেঁচে থাকার
তাগিদেই প্রতিদিনই আমরা খাবার খাই। কিন্তু এই খাবারই যে আবার মানুষকে
মৃত্যুর দিকে ধাবিত করছে, সে খেয়াল ক’জনে রাখেন।
আমরা আসলে কী খাচ্ছি? কখনো কি জানতে চেয়েছি? সাম্প্রতিক এক লেখায় পড়েছি
‘আমরা প্রতি জনে; প্রতি ক্ষণে; জেনে শুনে করেছি বিষ পান।’ আরেক লেখক
লিখেছেন- ‘কত কিছু খাই ভস্ম আর ছাই।’ সেদিন জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম ছিল:
‘মাছের বাজারে মাছই নেই!’ প্রতিদিন আমরা যে খাবার খাচ্ছি তাতে কোনো এক
মাত্রায় বিষ মেশানো আছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এই বিষই আমাদের তিলে
তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে গেলেই বোঝা যায় কত প্রকার
রোগই না এখন মানবদেহে বাসা বেধেছে।
ভেজাল নেই কোথায়? ভেজালের রাজ্যে আমরা যেন রাজা। ভেজাল দিচ্ছি; ভেজাল
খাচ্ছি, ভেজাল বলছি; ভেজাল করছি। এটা তো দেখছি ভেজালের এক মহারাজত্ব। কেউ
কেউ বলেন এদেশে কেবল খাদ্যে নয়; বিষেও নাকি ভেজাল আছে। কথা কিন্তু মিথ্যে
নয়। ভেজাল খেয়ে যা হবার তাই হচ্ছে। কিডনি নষ্ট হচ্ছে, হচ্ছে হাই প্রেশার;
দুরারোগ্য ক্যান্সার ও হার্টস্ট্রোকে অহরহ মরছে মানুষ। প্রতিটি খাবারে
মেশানো হচ্ছে বিষ। আর সেই বিষ খেয়ে আমরা আর বেঁচে নেই। জীবিত থেকেও লাশ
হয়ে গেছি। এ যেন জিন্দা লাশ! রোগে শোকে কয়েকটা দিন বেঁচে থাকা এই আর কি।
প্রতিনিয়তই বিষ খাচ্ছি।
আসলে আমরা জেনে শুনেই বিষ খাচ্ছি। না খেয়ে উপায়ই বা কী? তবে উপায় একটা
আছে। না খেয়ে থাকলে এ থেকে যেন নিস্তার মিলবে। কিন্তু তাতো হবার নয়। তাই
আমে, মাছে, সবজিতে বিষ মেশানো আছে জেনেও তা আমরা কিনে নিচ্ছি। আর সেই বিষ
মেশানো খাবারই সপরিবারে গিলে খাচ্ছি দিন-রাত। ভেজাল দেওয়া বা ভেজাল খাদ্য
ও পানীয় বিক্রির কারণে ১৯৭৪ সালের বিশেখ ক্ষমতা আইনে কঠের শাস্তির বিধান
রয়েছে। এ আইনের ২৫(গ) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ কোনো খাদ্য বা
পানীয়দ্রব্যে ভেজাল দিয়ে তা ভক্ষণ বা পান করার অযোগ্য করে ও তা খাদ্য,
পানীয় হিসেবে বিক্রি করতে চায় বা তা খাদ্য বা পানীয় হিসেবে বিক্রি হবে
বলে জানা সত্ত্বেও অনুরূপ ভেজাল দেয় অথবা কোনো দ্রব্য নষ্ট হয়েছে বা নষ্ট
করা হয়েছে বা খাদ্য, পানীয় হিসেবে অযোগ্য হয়েছে জানা সত্ত্বেও বা তদ্রূপ
বিশ্বাস করার কারণ থাকা সত্ত্বেও অনুরূপ কোনো দ্রব্য বিক্রি করে বা
বিক্রির জন্য উপস্থিত করে; তবে সে ব্যক্তি মৃত্যুদন্ড, যাবজ্জীবন
কারাদন্ড অথবা ১৪ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদন্ডে এবং তদুপরি জরিমানাদন্ডে
দন্ডিত হবে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ২০০৫ সালে অর্ধশত
বছরের পুরনো ১৯৫৯ সালের বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশে (পিএফও) বেশ কিছু
গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনে। মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোনো
দ্রব্য, কোনো খাদ্যপণ্যের সঙ্গে যার মিশ্রণ কোনো আইন বা বিধির অধীনে
নিষিদ্ধ, এরূপ দ্রব্য মিশ্রিত কোনো পণ্য বিক্রি করা বা করতে প্রস্তাব করা
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে ভোক্তা অধিকারবিরোধী কাজ হিসেবে স্বীকৃত। এ
জন্য আইনে শাস্তির বিধান রয়েছে। সেই বিধান মানছে ক’জন।
বিএসটিআই অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ এবং এর অধীনে প্রণীত বিধিমালায় খাদ্য ও কৃষিজাত
পণ্যের প্রক্রিয়া ও পরীক্ষা পদ্ধতির জাতীয় মান প্রণয়ন এবং প্রণীত মানের
ভিত্তিতে পণ্যসামগ্রীর গুণগত মান পরীক্ষা ও যাচাই করার বিধান রয়েছে।
পালনীয় বিধানাবলী ভঙ্গের জন্য চার বছর পর্যন্ত কারাদন্ড এবং ১ লাখ টাকা
পর্যন্ত জরিমানার ব্যবস্থা রয়েছে। খাদ্যে ভেজাল রোধ ও ভেজালকারীদের
শাস্তি দেওয়ার বিধান রয়েছে সিটি কর্পোরেশন অধ্যাদেশগুলোয়। দেখা যাচ্ছে,
দেশে খাদ্যদ্রব্যে ভেজালবিরোধী আইনের কমতি নেই। শাস্তির বিধানও রয়েছে এসব
আইনে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে, শাস্তির বিধানসংবলিত এসব আইন বলবত
থাকা সত্ত্বেও খাদ্যদ্রব্যে ভেজালের এত দৌরাত্ম্য কেন? কারাদন্ডের বিধান
থাকলেও এ পর্যন্ত তা প্রয়োগের কোনো নজির নেই। এটা আমাদের বাঙালি জাতির
জন্য দুর্ভাগ্য।
খাদ্যে ভেজাল রোধে অনেক আইন রয়েছে, কিন্তু এর যথাযথ প্রয়োগ নেই। ভেজাল
দেওয়া বা ভেজাল খাদ্য ও পানীয় বিক্রির কারণে ১৯৭৪ সালের বিশেখ ক্ষমতা
আইনে কঠের শাস্তির বিধান রয়েছে। এ আইনের ২৫ (গ) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ
কোনো খাদ্য বা পানীয়দ্রব্যে ভেজাল দিয়ে তা ভক্ষণ বা পান করার অযোগ্য করে
ও তা খাদ্য, পানীয় হিসেবে বিক্রি করতে চায় বা তা খাদ্য বা পানীয় হিসেবে
বিক্রি হবে বলে জানা সত্ত্বেও অনুরূপ ভেজাল দেয় অথবা কোনো দ্রব্য নষ্ট
হয়েছে বা নষ্ট করা হয়েছে বা খাদ্য, পানীয় হিসেবে অযোগ্য হয়েছে জানা
সত্ত্বেও বা তদ্রূপ বিশ্বাস করার কারণ থাকা সত্ত্বেও অনুরূপ কোনো দ্রব্য
বিক্রি করে বা বিক্রির জন্য উপস্থিত করে; তবে সে ব্যক্তি মৃত্যুদন্ড,
যাবজ্জীবন কারাদন্ড অথবা ১৪ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদন্ডে এবং তদুপরি
জরিমানাদন্ডে দন্ডনীয় হবে।বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ২০০৫
সালে অর্ধশত বছরের পুরনো ১৯৫৯ সালের বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশে (পিএফও)
বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনে। বিএসটিআই অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ এবং এর অধীনে
প্রণীত বিধিমালায় খাদ্য ও কৃষিজাত পণ্যের প্রক্রিয়া ও পরীক্ষা পদ্ধতির
জাতীয় মান প্রণয়ন এবং প্রণীত মানের ভিত্তিতে পণ্যসামগ্রীর গুণগত মান
পরীক্ষা ও যাচাই করার বিধান রয়েছে।
পালনীয় বিধানাবলী ভঙ্গের জন্য চার বছর পর্যন্ত কারাদন্ড এবং ১ লাখ টাকা
পর্যন্ত জরিমানার ব্যবস্থা রয়েছে। খাদ্যে ভেজাল রোধ ও ভেজালকারীদের
শাস্তি দেওয়ার বিধান রয়েছে সিটি কর্পোরেশন অধ্যাদেশগুলোয়। দেখা যাচ্ছে,
দেশে খাদ্যদ্রব্যে ভেজালবিরোধী আইনের কমতি নেই। শাস্তির বিধানও রয়েছে এসব
আইনে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে, শাস্তির বিধানসংবলিত এসব আইন বলবত
থাকা সত্ত্বেও খাদ্যদ্রব্যে ভেজালের এত দৌরাত্ম্য কেন? কারাদন্ডের বিধান
থাকলেও এ পর্যন্ত তা প্রয়োগের কোনো নজির নেই। এটা আমাদের বাঙালি জাতির
জন্য দুর্ভাগ্য। খাদ্যে ভেজাল রোধে অনেক আইন রয়েছে, কিন্তু এর যথাযথ
প্রয়োগ নেই। মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর কোনো কিছুই খাদ্যে মিশ্রণ করা যাবে
না- এটাই বিধান। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা এ আইন মানছে না। এ জন্য চলমান
ভেজালবিরোধী আইনকে কঠের করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড
টেস্টিং ইনস্টিটিউটের জনবল ও ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।
এদেশে খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে ‘দি পিওর ফুড অর্ডিন্যান্স’ ১৯৫৯ বর্তমান
ব্যবস্থায় কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না। এই আইন যখন হয়েছে তখন মানবদেহের
জন্য ক্ষতিকর অনেক রাসায়নিক দ্রব্য সৃষ্টিই হয়নি। আর খাদ্যে ভেজাল
মেশানোর প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে আশির দশকের পর। ফলে জনস্বার্থে আইন সংশোধন
না করে নতুন করে কঠের আইন তৈরি করতেই হবে। এতে খাদ্যে ভেজালকারীর
বিরুদ্ধে সরাসরি ২০২ ধারা অনুসরণ করা দরকার। কারণ খাদ্যে ভেজাল মিশিয়ে
মানুষ মারা এবং সরাসরি মানুষ মারাকে এই অপরাধের আওতায় আনা না হলে ভেজাল
মেশানো প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। আর এভাবে খাদ্যে ভেজাল হলে পরবর্তী
প্রজন্ম বিকলাঙ্গ হয়ে যাবে। জাতীয় স্বার্থেই সরকারে কঠের হতে হবে।
অপরদিকে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত এবং আমদানিকৃত খাদ্যের মান নিশ্চিত করতে
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের জনবল বৃদ্ধির পাশাপাশি
শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি করা দরকার। বিএসটিআইর জন্য ‘ইকুইপমেন্ট ক্রয়
ও ধারাবাহিকভাবে দেশি-বিদেশি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা দরকার। পিওর ফুড
অর্ডিন্যান্স ১৯৫৯ সংশোধন করা হয় ২০০৫ সালে। আইনটি বাস্তবায়নে
সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা ছিল না। এ আইন স্থানীয় সরকার,
স্বাস্থ্য এবং প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন করত। মূল ভূমিকা পালন
করত স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এসব মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজের
সমন্বয়হীনতায় ভেজাল রোধ করা সম্ভব হয়নি। এতো আইন রয়েছে তবুও কেন ভেজাল
থেমে নেই? খাদ্যে ভেজালের অপরাধে দেশে কঠিন শাস্তিযোগ্য আইন থাকলেও তার
কার্যকারিতা নেই। এ অবস্থাই ভেজালকারীদের উৎসাহিত করছে। আর এ থেকে আমাদের
বেরিয়ে আসতে হবে। প্রশ্ন হলো ভেজালের বিরুদ্ধে আমরা কি সোচ্চার? হলে
কতটা? জীবন বাঁচানোর তাগিদেই তো যুদ্ধে নামা দরকার। ভেজালের বিরুদ্ধে
দেশব্যাপী আমজনতা, প্রশাসন, সংশ্লিষ্ট বিভাগের সবাইকে হাতে হাত মিলিয়ে
কাজ করতে হবে। জনস্বাস্থ্য নিয়ে অবহেলা প্রদর্শনের কোনোই সুযোগ নেই।
এ অবস্থায় সর্বতোভাবে তৎপর হতে হবে বিএসটিআইসহ সংশ্লিষ্ট
প্রতিষ্ঠানগুলোকে। এতে গণমাধ্যমেরও ব্যাপক ভূমিকা থাকা প্রয়োজন।
সর্বোপরি ভেজাল প্রতিরোধে জনসচেতনতা একান্ত দরকার। গ্রামেগঞ্জে,
শহরে-নগরে এ ব্যাপারে প্রয়োজনে গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এক যোগে আওয়াজ
তুলতে হবে- ‘আমরা আর ভেজাল খাবো না; ফরমালিনমুক্ত খাবার চাই।’ মানুষ তো
বাঁচার জন্য খায়, মরার জন্য নয়। আর খাদ্য যদি মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়,
তাহলে তা কতটা দুঃখজনক। বিষয়টি নিশ্চয়ই সরকার এবং সংশ্লিষ্টরা ভাববেন।
@ লেখক : মহাসচিব- কলামিস্ট ফোরাম অফ বাংলাদেশ, চেয়ারপার্সন (পরিবেশ) –
লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনাল (৩১৫ এ-১)।