• ঢাকা
  • রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:২৬ পূর্বাহ্ন

৩৩ বছরে ১৮ হাজার রোগী বহন করেছেন ফজলুল হক


প্রকাশের সময় : মে ৬, ২০১৮, ৫:৩৪ PM / ২১৫
৩৩ বছরে ১৮ হাজার রোগী বহন করেছেন ফজলুল হক

 

মমিনুল ইসলাম বাবু, কুড়িগ্রাম : ১৯৭৮ সালের ঘটনা তখন ৭ম শ্রেণিতে পড়ার সময় শহরের পুরাতন রেজিস্ট্রি পাড়ার এক লোক অসুস্থ অবস্থায় পড়ে দেখি। অসুস্থ ব্যক্তিটিকে কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করাই। তাকে সহযোগিতার মাধ্যমেই আমার মনে সাধ জাগে মানুষের সেবা করার। কথা গুলো বললেন, কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালের ৩৩ বছর ধরে এ্যাম্বুলেন্সের চালক একেএম ফজলুল হক।
বাড়ি কুড়িগ্রাম শহরের পৌরসভার কৃষ্ণপুর গ্রামে। বাবা মৃত: মহির উদ্দিন। ফজলুল হক ৬ভাই-বোনের মধ্যে ৪র্থ সন্তান। তিনি ১৯৬১সালে জন্ম গ্রহণ করেন। চালকের প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৮৫সালে যোগদান করেন কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালে এ্যাম্বুলেন্স চালক হিসেবে। তার সংসার জীবনে স্ত্রীসহ দুই ছেলে ও এক মেয়ে এবং নাতী-নাতনী। ফজলুল হক চাকুরির ৩৩বছরে জেলার উলিপুর, রাজারহাট, চিলমারী এবং কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালে এ্যাম্বুলেন্স চালক হিসেবে কাজ করেন। কর্ম জীবনে প্রায় ১৮হাজার রোগী বহন করেন তিনি। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ফজলুল হক বলেন, চাকুরিতে যোগদানের পর সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কুড়িগ্রাম সফরের সময় দায়িত্ব পালন তিনি করেছেন। একজন রোগীকে সুস্থ করে তোলার জন্য চিকিৎসক, নার্স, আয়া, ওয়ার্ড বয়ের পাশাপাশি ভূমিকা রাখেন এই এ্যাম্বুলেন্স চালক। তবে রোগীর উন্নত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে বড় ভূমিকা থাকে এ্যাম্বুলেন্স চালকদেরও। তাদের কারণেই একজন মুমুর্ষ রোগীকে দ্রুত চিকিৎসা করার সুযোগ পান চিকিৎসক ও নার্সসহ অন্যান্য স্টাফরা।
ফজলুল হক বলেন, এ্যাম্বুলেন্সে করে যখন কোনো গুরুতর রোগীকে দ্রুত চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ কিংবা ঢাকায় পৌঁছে দিতে পারার পর একটি জীবন বাঁচানোর সহায়ক হিসেবে কাজ করতে পারায় তৃপ্তি পান। তার গাড়িতে কোনো রোগীর মৃত্যু হলে বা পৌঁছানোর পরে যদি শুনতে পান সেই রোগী মারা গেছে তখন তার বেদনায়ক হয়ে ওঠে সেই সময় গুলো। কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতাল থেকে গুরুতর কোনো রোগীকে দ্রুত রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্য যার নাম উঠে আসে তিনি হলেন অ্যাম্বুলেন্স চালক ফজলুল হক। সাংসারিক জীবনে যে অবস্থায় থাকেন না কেন কোন মুমুর্ষ রোগীকে নিয়ে যাবার কথা শুনলেই ছুটতেন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। দীর্ঘ ৩৩বছর ধরে অবিরাম ছুঠে চলছেন ফজলুল হক।
স্মৃতিচারণে তিনি আরো বলেন, ১৯৯০সালে কুড়িগ্রাম শহরের মিস্ত্রিপাড়ার তপু মিয়ার স্ত্রী গর্ভবতী ছিলেন। তাকে ডেলিভারী করার জন্য রংপুর নিয়ে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে লালমনিরহাট জেলার বড়বাড়ি নামক স্থানে গাড়িতেই জমজ দুটি ছেলে সন্তান প্রসব করে মহিলাটি। এখন তারা আল্লাহর রহমতে ভালই আছেন। এমনই আরেকটি ঘটনা আছে শহরের গাড়িয়াল পাড়ার আফজালের স্ত্রীর ক্ষেত্রেও ঘটে। সেটা ছিল ১৯৯৫সালের ঘটনা। ডেলিভারী করার জন্য রংপুর নিয়ে যাবার সময় আরকে রোডের লালমনিরহাট জেলার মোস্তফী এলাকার মন্দিরের কাছে তারও জমজ দুটি সন্তান জন্ম নেয়। এদের একজন মেয়ে অপর জন ছেলে। এদের সঙ্গে আজো কোথাও দেখা হলে বুকটা ভরে যায় আমার।
এছাড়াও তিনি আরো বলেন, ২০০৭ অথবা ২০০৮সালের দিকে তারই কলিগ কুড়িগ্রাম সিভিল সার্জন অফিসের প্রজেক্ট ড্রাইভার স্টক করেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাবার সময় রংপুরের নব্দীগঞ্জ বাজারে এ্যাম্বুলেন্সের দুটি চাকা পর্যায়ক্রমে পাম্পচার ঘটে। দ্রুত সেগুলো সেরে রোগীকে রংপুরে পৌঁছানোর পর চিকিৎসা পেয়ে বেঁচে যান।
কর্ম জীবনে তার কষ্টদায়ক একটা দিন ছিল ২০১৫সাল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুড়িগ্রাম সফরে আসেন। এবং বিকেলে তিনি কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ মাঠে জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখার জন্য বের হোন। এসময় গাড়ি বহরে থাকা একজন চালক হার্ট এ্যাটাক করে মারা যান। সেই মুহুর্তটা তার মনে এখনও দাগ কাটে। এছাড়াও তার চাকরি জীবনে মিথ্যে মামলার ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে ২০১৬সালে। একজন মুমুর্ষ রোগীকে নিয়ে তিনি রংপুর যাচ্ছিলেন। লালমনিরহাটের মোস্তফীরহাট আরকে রোডে বিপরীত গামী একটি মোটর সাইকেল এসে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। এসময় এ্যাম্বুলেন্সে থাকা রোগীটি মারা যান। মোটর সাইকেল আরোহী আহত হোন। পড়ে তারা ঘটনার দু’মাস পর লালমনিরহাট থানায় আমার নামে একটি মিথ্যে সন্ত্রাসী ও চাঁদাবজি মামলা করেন। মামলায় তাকে সরকারি এ্যাম্বুলেন্সের চালক হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। অপরদিকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভুয়া সার্টিফিকেট দেখিয়ে মামলার চার্জশিট দেয়া হয়। এরপর থেকে লালমনিরহাট চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজিরা দেবার জন্য যেতে হয় আমাকে। এতে করে আমার সময়, অর্থ এমনকি পেশাগত দায়িত্বে এর প্রভাব পড়ছে। তিনি আরো বলেন, চাকুরির দীর্ঘ ৩৩বছরে কর্মকর্তা এবং রোগী ও স্বজনদের সাথে আন্তরিকতার সাথে কাজ করার জন্য আজ পর্যন্ত দায়িত্বে অবহেলা কিংবা কোন ধরনের অভিযোগ ওঠেনি আমার বিরুদ্ধে। চাকুরির বাকি সময়টা রোগীর সেবা আর নিজের কাজের সুনাম অক্ষুন্ন রেখে অবসরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এই দক্ষ এ্যাম্বুলেন্স চালক।
কুড়িগ্রাম সিভিল সার্জন ডা: এসএম আমিনুল ইসলাম জানান, জেলার প্রায় ২২লক্ষাধিক মানুষের জন্য ২৫০শয্যায় উন্নতি হওয়া কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতাল। এই সদর হাসপাতালসহ ৯টি উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১০টি এ্যাম্বুলেন্সে ১০জন চালক রয়েছে। তারা নিয়মিতভাবে রোগীদের সেবা নিশ্চিত করছেন। তাদের মধ্যে এ্যাম্বুলেন্স চালক ফজলুল হক সিনিয়র ও দক্ষ। সে সৎ-নিষ্টার সাথে তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন। তার দায়িত্ব নিয়ে লিখিত কিংবা মৌখিক কোন অভিযোগ আসেনি আমার কাছে।

 

(ঢাকারনিউজ২৪.কম/এসডিপি/৫:২৫পিএম/৬/৫/২০১৮ইং)