• ঢাকা
  • সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:৪৬ পূর্বাহ্ন

সিয়ামের উদ্দেশ্য এবং জীবনের উপর এর প্রভাব


প্রকাশের সময় : জুন ১৪, ২০১৭, ৩:৫২ PM / ২৪
সিয়ামের উদ্দেশ্য এবং জীবনের উপর এর প্রভাব

 

মাওলানা মিরাজ রহমান : ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভ বা খুঁটির উপর প্রতিষ্ঠিত। রমজান মাসে সিয়াম সাধনা এ পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় সার্বিক জীবনের কল্যাণ এ সিয়াম সাধনার মধ্যে নিহিত। প্রকৃত প্রেম-ভালবাসা, মায়ামমতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, সহযোগিতা, সহনশীলতা, সহমর্মিতা, সহানুভূতি, তাকওয়া বা খোদাভীতি ও খোদাপ্রেম সৃষ্টির ক্ষেত্রে সিয়াম আল্লাহর পক্ষ থেকে এক অতুলনীয় ইবাদাত। সিয়াম আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য ফরজ করে দিয়েছেন যার মধ্যে রয়েছে এক মহান উদ্দেশ্য। মহান আল্লাহর অমৃত বাণী বিশ্লেষণ করলেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। ইরশাদ হচ্ছে, তোমরা যারা ঈমান এনেছ! তোমাদের উপর সিয়াম সাধনা ফরজ করা হয়েছে, যেমন করে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতদের জন্য, যাতে করে তোমরা (ইহা পালনের মাধ্যমে) মুত্তাকীন তথা খোদাভীরু থাকতে পারে।

তাকওয়া অর্জন: পবিত্র রমজান মাসের সিয়াম সাধনা করলে ব্যক্তির মনে আল্লাহর ভয় জন্মে, আর আল্লাহর ভয় জন্মালে মানুষ সৎ স্বভাবের অধিকারী হয়। লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, চাটুকারিতা, মওজুদদারিতা, ধন-সম্পদের স্পৃহা, যশ বা খ্যাতিমান হবার স্পৃহা, মিথ্যা, অন্যায়-অত্যাচার, অবিচার, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি ইত্যাদি সমাজ ও রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যকলাপসহ সকল মানবীয় দুর্বলতা দূরীভূত হয়। পক্ষান্তরে, সিয়ামের বদৌলতে মানুষের অন্তরে রহমতের ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হয়। তখন মহান তায়ালার পক্ষ থেকে রোজাদারদের মধ্যে লজ্জাশীলতা, আত্মসংযম, সত্যবাদিতা, সরলতা, ভদ্রতা, ধৈর্যশীলতা, সহনশীলতা, সাহস, সন্তুষ্টি, মানবপ্রেমসহ সৎগুণাবলীসমূহ সতেজ হয়।

আল্লাহর সাথে যোগসূত্রতা: আল্লাহ মানুষকে তার খিলাফতের দায়িত্ব দিয়ে এ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। তাই বান্দার পক্ষ থেকে আল্লাহর সাথে একটা যোগসূত্র থাকা বাঞ্ছনীয়। এ যোগসূত্রতা রক্ষা করতে হলে যেহেতু অন্তরের সংস্কার, মানসিক একাগ্রতা, আত্মনিবেদন ও আধ্যাত্মিক দুঢ়তা একান্ত প্রয়োজন, এতে কোনোরকম বিশৃঙ্খলা যেহেতু ক্ষতিকর, সেহেতু আল্লাহ তা’য়ালা রোজার মাধ্যমে সে ব্যবস্থাই করে দিলেন। যাতে বান্দা ও প্রভুর মাঝে প্রয়োজনীয় যোগাযোগের পক্ষে হিতকর গুণাবলী অর্জিত থেকে পারে এবং অহিতকর দোষ-ত্রুটি দূরীভূত হয়ে যায়। এজন্যই ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আদি পিতা হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে সবার জন্যই কোনো না কোনো উপায়ে বা পন্থায় রোজা ফরজ ছিল। এসব কিছু সামনে রাখলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামী শরিয়ত রোজা পালনের জন্য যেসব শর্ত আরোপ করেছে এবং নিয়ম পদ্ধতি নির্ধারণ করেছে, যথাযথভাবে তা পালন করলেই রূহানী তথ্য আধ্যাত্মিক, নৈতিক, মনস্তাত্বিক, সামাজিক, সামষ্টিক ও রাষ্ট্রীয় কল্যাণ সাধিত থাকতে পারে। যা মানব সৃষ্টির মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

ট্রেনিং কোর্স: পবিত্র রমজান মাস হচ্ছে মুসলিমের জন্য ট্রেনিং এর মাস। এ মাসের সিয়াম সাধনা হলো ট্রেনিং কোর্স। দুনিয়ার বাস্তব জীবনে যে কোনো পেশায় আগ্রহী ব্যক্তিকে সুনির্দিষ্ট বিষয়ে ট্রেনিং কোর্স সম্পন্ন করতে হয়। ট্রেনিং কোর্স সম্পন্ন করার পর পেশায় নিয়োজিত হয়। পেশায় নিযুক্তির পর প্রমোশন তথা পদোন্নতি বা অভিজ্ঞতা ধরে রাখার জন্য মাঝে মধ্যে কিছু প্রশিক্ষণ বা ট্রেনিং -এ অংশগ্রহণ করতে হয়। এসব ট্রেনিং-প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা পেশাগত জীবনে কাজে লাগাতে হয়। ঠিক তেমনি মাহে রমজান ১২ মাসের মধ্যে এক মাসের ট্রেনিং কোর্স। এ র্কোস সমাপ্ত করতে হবে দক্ষতার সাথে। আর অর্জিত দক্ষতা বাকি ১১ মাস কাজে লাগাতে হবে। সিয়াম পালনের মাধ্যমে যে সব গুণাবলী অর্জিত হবে তাই হবে আল্লাহর বান্দা হিসেবে দায়িত্ব পালনের দক্ষতা। এ দক্ষতা দ্বারা মহান আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করাই হচ্ছে মানুষের কাজ।

সংযম ও আত্মশক্তি অর্জন: একজন মানুষের জীবনের সার্বিক সফলতা ও বিভিন্ন মানবিক গুণাবলী বিকাশের জন্য সংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণ একান্ত প্রয়োজন। ব্যক্তিত্ব গঠনেও সংযমের গুরুত্ব অপরিসীম। যে ব্যক্তি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, যার মধ্যে সংযম অবলম্বনের শক্তি নেই, তার মধ্যে কোনো বলিষ্ঠ ব্যক্তিবোধ সৃষ্টি হতে পারে না। ব্যক্তিত্বের যথার্থ বিকাশের জন্য নিজের প্রবৃত্তি ও আবেগসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা অর্জন করা অপরিহার্য। নিজের পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলেও নিজেকে আগে নিয়ন্ত্রণ করতে সম্মত হতে হবে। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে একজন মানুষের মধ্যে সংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রনের গুণাবলী সৃষ্টি হয়।

পাপমুক্ত জীবন গড়ে তোলা: রমজানের সিয়ামের আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে মুমিনদের জীবন থেকে পাপ দূরীভূত করে তাকে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন করা। মুমিনদের গুনাহ মাফ করে দেয়ার ব্যবস্থা করা। সিয়াম পাপের পথে একটি প্রচণ্ড বাধার সৃষ্টি করে। একজন সায়েম পাপের পথ থেকে সহজে দূরে থাকতে পারে। এজন্য সিয়াম হাদিস শরীফে ঢাল বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

সবর বা ধৈর্যশীলতা অর্জন: সবর হচ্ছে মুমিন জীবনের এক অপরিহার্য গুণ। এ গুণটি থাকলে মানুষ যে কোনো বাধা-প্রতিবন্ধকতা ও বিপদাপদের মোকাবিলায় কর্তব্য পালন করে যেতে পারে। সত্য, কল্যাণ ও ন্যায়ের পথে চলা এবং টিকে থাকার জন্য সবর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে হলে বা জীবন সাধনায় জয়ী থেকে হলেও সবর বা চরম ধৈর্যের প্রয়োজন। সবরের গুণ ছাড়া সত্য-ন্যায়ের পথে দৃঢ়তার সাথে চলা ও টিকে থাকা সম্ভব নয়। তাই জীবন ও সত্যের সংগ্রামে প্রতি মুহূর্তে প্রয়োজন হয় সবরের। রমজানের সিয়াম সাধনা মানুষের মধ্যে সবরের গুণাবলী সৃষ্টি করে। সবরের গুণাবলী সৃষ্টির কার্যকর ক্ষমতা আছে বলেই মাহে রমজানকে বা সিয়ামের মাসকে মহানবী (সা.) শাহরুহ সবর বা সবরের মাস বলে আখ্যায়িত করেছেন। সিয়াম প্রতিটি মুহূর্তে মানুষের মধ্যে সবরের প্রশিক্ষণ দেয়।

দৈহিক সুস্থতা বিধান: সিয়ামের মূল উদ্দেশ্য নৈতিক, আধ্যাত্মিক, ঈমানী গুণাবলী সৃষ্টি। কিন্তু এসব গুণাবলী অর্জনের পাশাপাশি ভিন্ন উপকারিতা হিসেবে দৈহিক কল্যাণের দিকটি একদম উপেক্ষা করা যায় না। চিকিৎসা বিজ্ঞানের মাধ্যমে এটি প্রমাণিত হয়েছে, দেহযন্ত্রের-পরিপাকযন্ত্রের ও মাঝে মাঝে বিশ্রামের প্রয়োজন। অব্যাহত ভোগ দেহযন্ত্রকে ক্লান্ত ও একঘেঁয়ে করে দিতে পারে। তাই মাঝে মাঝে উপবাস স্বাস্থ্যের জন্য হিতকর। তাছাড়া দেহকে ক্ষুৎপিপাসার মোকাবিলায় কার্যক্ষম ও সচল রাখারও অনুশীলন প্রয়োজন। মনের মধ্যে ক্ষুৎপিপাসা সহ্য করার শক্তি ও আত্মবিশ্বাস একজন সংগ্রামী মানুষের জীবনে একান্তই অপরিহার্য।

পবিত্র সুন্দর পরিবেশ গড়ে তোলা: মানুষের উন্নতি ও বিকাশের জন্য উত্তম পরিবেশ প্রয়োজন। পবিত্র ও পুণ্যময় জীবন যাপন করার জন্য পবিত্র ও সুন্দর অনুকূল পরিবেশ অপরিহার্য। পরিবেশ ভাল না হলে, সুন্দর না হলে মানুষের জীবনকে ভাল ও সুন্দররূপে গড়ে তোলা যায় না। রমজান মাস মুসলমানদের জন্য এক সুন্দর ও পবিত্র পরিবেশ নিয়ে আসে। পুণ্যময় জীবন যাপনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয় রমজানে। সহানুভূতি, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্বের পরিবেশ সৃষ্টি করে সিয়াম। রমজানে মানুষ পুণ্যের দিকে ধাবিত হওয়ার পরিবেশ পায়। পাপ থেকে দূরে থাকার শক্তি পায়। সর্বত্র যেন এক শান্ত- সৌম্য, পূত-পবিত্রতা বিরাজ করে। গোটা পরিবেশ যেন পুণ্যের আবেশে আবিষ্ট হয়ে উঠে। গোটা মাসটি যেন রহমতের ফলগুধারায় অভিষিক্ত হয়ে উঠে। এদিকে ইঙ্গিত দিয়েই মহানবী (সা.) বলেছেন, যখন রমজান মাস আসে, তখন জান্নাতের দরজা খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয় (অন্য বর্ণনায়) এবং রহমতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়।(প্রিয়.কম)

(ঢাকারনিউজ২৪.কম/এসডিপি/৩:৫০পিএম/১৪/৬/২০১৭ইং)