• ঢাকা
  • বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ০২:২৯ অপরাহ্ন

রেমিট্যান্সের ইতিবাচক পরিবর্তনে কিছু প্রস্তাব : এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ


প্রকাশের সময় : সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৮, ৩:৪০ PM / ১১০
রেমিট্যান্সের ইতিবাচক পরিবর্তনে কিছু প্রস্তাব : এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ

সাকিব সারোয়ার : ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশের রপ্তানি আয় ছিলো ৩৪.০২বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তার বিপরীতে আমদানি ব্যয়ছিলো ৪৩.৪৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ফলে দেখা যাচ্ছে, বৈদেশিক বাণিজ্যে একটা বড় পরিমাণ ঘাটতি থেকেযাচ্ছে। এই পরিস্থিতি বিরাজমান থাকলে দেশেরঅর্থনীতিতে বড় ধরনের ধস নেমে আসতে পারত। কিন্তুএই বাণিজ্য ঘাটতি পুরণে ভূমিকা রাখছে বৈদেশিকরেমিট্যান্স খাত। বর্তমানে আমদানি ব্যয়ের ৩৯% পুরণকরা হচ্ছে বৈদেশিক রেমিট্যান্স দিয়ে। ২০১৬-১৭অর্থবছরে দেশের জিডিপিতে রেমিট্যান্সের অবদান ছিলোপ্রায় ৭.২৪%। তাই বিনা-বাক্য-ব্যয়ে স্বীকার করে নেওয়াযায়, দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে অন্যতম প্রধানভূমিকা পালন করছে প্রবাসী আয়। বিভিন্ন জাতীয়দৈনিকের মতে বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ১১ লক্ষ শ্রমিকবিভিন্ন দেশে কাজ করছে এবং প্রতিবছর এই সংখ্যাটাবেড়েই চলেছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ থেকে পৃথিবীরবিভিন্ন দেশে ১০ লাখের বেশি শ্রমিক বৈধ পথে কাজকরতে গেছেন। এটা জনশক্তি রপ্তানিতে কোনো একটিবছরের সর্বোচ্চ সংখ্যা। সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স অর্জনকারীদেশ হিসেবে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের অবস্থানসবার শীর্ষে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তাদের আয় প্রায় ৬৯বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তার পরেই আছে চীন, তাদেরঅর্জন ৬৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরেপ্রবাসী বাংলাদেশিরা প্রায় ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলাররেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরেরেমিট্যান্স আসে প্রায় ১৩.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এরপূর্বের চার বছরে, অর্থাৎ ২০১৪-১৫, ২০১৩-১৪, ২০১২-১৩ও ২০১১-১২ অর্থবছরে যথাক্রমে প্রায় ১৫.৮০, ১৫.১০, ১৩.৮৬ এবং ১৪.২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্সদেশে এসেছিল। দেখা যাচ্ছে, বিগত কয়েক বছর ধরেআমাদের বৈদেশিক আয় কমে আসছে। তবে এইঅর্থবছরে প্রবাসী আয় ইতিবাচক অবস্থায় ফিরে এসেছে।আগের বছরের তুলনায় ১৬% আয় বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৭-১৮অর্থবছরে প্রবাসী আয় এসেছে ১৫ বিলিয়ন মার্কিনডলার।
বিদেশে কর্মরত আমাদের দেশের শ্রমিকদের কাছ থেকেএকটা অভিযোগ প্রায়ই পাওয়া যায়, একই কোম্পানিরএকই পদে কাজ করে অন্যান্য দেশের শ্রমিকদের তুলনায়তারা অনেক কম বেতন পেয়ে থাকেন। তাদের এইঅভিযোগ মোটেই অগ্রাহ্য করার মত নয়। প্রায় ১ কোটি১০ লক্ষ ফিলিপিনো শ্রমিক ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩৩বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে তাদেরদেশে। ৭৬ লক্ষ পাকিস্তানি শ্রমিকের রেমিট্যান্স আয় ২০বিলিয়ন মার্কিন ডলার; ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলাররেমিট্যান্স অর্জন করেছে মাত্র ৬০ লক্ষ ভিয়েতনামি।অন্যদিকে আমাদের ১ কোটির বেশি শ্রমিকের কাছ থেকে২০১৬-১৭ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছে ১৩ বিলিয়নমার্কিন ডলার। তবে শুধু কম বেতনের জন্যই নয়; হুন্ডি সহঅন্যান্য অবৈধ উপায়ে টাকা পাঠানো এবং প্রায়োগিকজ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা কম হওয়া ছাড়াও আরোনানাবিধ কারনে আমাদের বৈদেশিক রেমিট্যান্সতুলনামুলকভাবে কম হচ্ছে।

বৈদেশিক রেমিট্যান্স কমে গেলে আমাদের অর্থনীতিএকটা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হবে। তাই প্রবাসী আয়বৃদ্ধিতে আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ শীঘ্রই নেয়াদরকার। সর্বপ্রথমে, আমাদের দেশের কর্মীরা যেনওসরকার নির্ধারিত খরচে দেশের বাইরে কাজ করতে যেতেপারেন, তাদের অর্থ লেনদেন সহ ভিসা-পাসপোর্ট সংক্রান্তহয়রানি এবং আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।যদিও কোন দেশে যেতে কত টাকা প্রয়োজন, রিক্রুটিংএজেন্সী গুলোকে সরকার সেটা নির্ধারন করে দিয়েছে।কিন্তু বাস্তব চিত্র সম্পূর্ন ভিন্ন। অধিকাংশ সময়েই দেখাযায় দালাল এবং অবৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি গুলোর মাধ্যমেমানুষ প্রতারিত হচ্ছে। যেখানে সরকার নির্ধারিত খরচবিভিন্ন দেশের জন্য ৫০ হাজার থেকে আড়াই লাখ টাকারমধ্যে, সেখানে দালাল এবং অবৈধ রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো তিন লাখ থেকে দশ লাখ টাকা চেয়ে বসে। এইসবসমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবেসরকারকে। প্রয়োজনে রুরাল এলাকায় এ বিষয়েজনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কর্মশালা করতে হবে, প্রবাসগমনে ইচ্ছুক কর্মীরা যেন দালাল এড়িয়ে সরাসরি বৈধরিক্রুটিং এজেন্সি গুলোর সাথে যোগাযোগ করতে পারেসেই ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রবাসী বাংলাদেশী কর্মীদের মধ্যে প্রায় ৫০% কর্মী অদক্ষ।এদেশের কর্মীদের বেতন তুলনামূলক কম হওয়ার জন্যযে কয়টা কারন বিদ্যমান, তার মধ্যে কর্মীদের অদক্ষতাইপ্রধান কারন। বর্তমানে বিদেশগামী কর্মীদের প্রশিক্ষণেরজন্যে প্রায় ৭১ টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে।তাছাড়াও প্রবাসগামী শ্রমিকদের জন্য সরকার তিনদিনের বাধ্যতামূলক কর্মশালার আয়োজন করেছে। কিন্তুঅধিকাংশ সময়েই দেখা যায়, রিক্রুটিং এজেন্সি গুলোরমাধ্যমে প্রবাসগামী শ্রমিকেরা এসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকেটাকা দিয়ে প্রশিক্ষণ ছাড়াই সনদ কিনছে। এই সমস্যাগুলো খুব গুরুত্ব সহকারে নিয়ে যথাযত সমাধান করেচাহিদা অনুযায়ী দক্ষ শ্রমিক পাঠাতে হবে। তাদেরবৈদেশিক ভাষার নুন্যতম শিক্ষা এবং আত্মিক উন্নয়নেরদিকটিও খেয়াল রাখতে হবে। অন্যান্য দেশের তুলনায়আমাদের রেমিট্যান্স কম হওয়ার আরেকটি প্রধান কারনআমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের অধিকাংশই অপেশাদারএবং প্রায়োগিক জ্ঞান সম্পন্নহীন। একটু পরিষ্কার করেবললে, অন্যান্য দেশের নারীরা যেখানে নার্সের কাজকরার জন্য যাচ্ছেন, আমাদের দেশের নারীরা সেখানেগৃহকর্মীর কাজ করতে যাচ্ছেন। দেশে বর্তমানে প্রায় ৪৯টি সরকারি এবং ৭৯ টি বেসরকারি পলিটেকনিকইন্সটিটিউট এবং সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ম্যাটসেরসংখ্যা প্রায় ২০০ টিরও অধিক। এসব প্রতিষ্ঠান থেকেপ্রতি বছর অনেক ছেলে-মেয়ে পাশ করে বের হচ্ছে।যাদের মধ্যে বেশ কিছু বেকার থাকছে এবং বাকিরা খুবস্বল্প বেতনে চাকরী করছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ গুলোতেএদের চাহিদা অনেক। কিন্তু সেই বাজারটা ফিলিপাইন, ভারত সহ অন্যান্য কয়েকটা দেশ দখল করে আছে।বাংলাদেশের ম্যানেজমেন্টকে প্রয়োজনীয় এবং কার্যকরিপদক্ষেপ গ্রহণ করে দক্ষ প্রায়োগিক জ্ঞানসম্পন্ন কর্মীবিদেশে পাঠাবার পরিবেশ ও সুযোগ সুনিশ্চত করতেহবে।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য আমাদের প্রবাসী শ্রমিকেরাঅন্যান্য দেশের শ্রমিকদের তুলনায় অনেক অবহেলিত।দেশের বাইরে কাজ করতে গিয়ে কোনও সমস্যায় পড়লেতারা প্রায়ই কোনও ধরনের সাহায্য পান না কিংবাঅসচেতনার জন্য সাহায্য নিতে পারেন না বাংলাদেশএমবাসি থেকে। অন্যান্য দেশের শ্রমিকদের তুলনায়আমাদের শ্রমিকেরা একই কাজ করে তুলনামূলক কমবেতন পাওয়ার জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে, বিদেশেকর্মরত বাংলাদেশী ম্যানেজমেন্টের অবহেলা এবংঅসচেতনতাকেই দায়ী বলে মনে করি। প্রবাসী কর্মীরামাঝে মাঝে বাংলাদেশী ফোরম্যান দ্বারাও নির্যাতন এবংসমস্যার স্বীকার হয়ে থাকেন। অনেকেই প্রতারনার স্বীকারহয়ে চাকরী হারিয়ে বিভিন্ন যায়গায় পালিয়ে বেড়ান।আবার কেউ কেউ ফাঁদে পা দিয়ে অপরাধমূলক কাজেরসাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। আমাদের প্রবাসী নারীকর্মীরা প্রায়ই যৌন নির্যাতনের স্বীকার হন। যাদের রক্তে-ঘামে অক্লান্ত পরিশ্রমে দেশের অর্থনৈতিক ভিতটা দাঁড়িয়েআছে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদেরঅবশ্যকর্তব্য। প্রবাসে বাংলাদেশী ম্যানেজমেন্টকে আরোবেশি কার্যকরী ও সচেতন করে তোলার জন্য লোকবল ওদক্ষতা বৃদ্ধি এবং মনিটরিং সহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপনিতে হবে।
বিবিএসের তথ্যমতে রেমিট্যান্সের প্রায় ৩০% আসে হুন্ডিরমাধ্যমে। ব্যাংকিং সিস্টেমের জটিলতা, অতিরিক্ত খরচ, ডলারের বিপরীতে কম টাকা পাওয়া এবং দীর্ঘসূত্রিতারজন্যই প্রবাসীরা দেশে টাকা পাঠানোর জন্য হুন্ডি সহঅন্যান্য অবৈধ উপায় বেছে নেন। ফলে দেশের রাজস্বআয় এবং রিজার্ভ বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। শুধু কর্মীদেরপরিবারে অর্থ আসাটাই প্রবাসী আয়ের একমাত্র লক্ষ্যনয়, সেই অর্থ যেনও দেশের সার্বিক কাজে লাগতে পারেসেটাও অন্যতম লক্ষ্য। এ সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারইতিমধ্যে ‘রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ কমানো, দেশেকর্মরত ব্যাংকের শাখা ও এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোকেরেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে দক্ষ করে তোলা, প্রবাসীরাযেসব দেশে কর্মরত, সেসব দেশের স্থানীয় ব্যাংকগুলোরসঙ্গে এ দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ড্রয়িংব্যবস্থা জোরদার করা এবং প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংকেরমাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাতে উদবুদ্ধ করা’ সহ বেশ কিছুপদক্ষেপ গ্রহন করেছে। আরেকটা বিষয় হাস্যকর মনেহলেও একেবারে ফেলে দেবার মত নয়, ইউরোপের দেশগুলোর মুদ্রার মান মধ্যপ্রাচের দেশ গুলোর মুদ্রার মানেরচেয়ে অনেক বেশি। আমরা যদি ইউরোপের শ্রমবাজারেজনশক্তি রপ্তানি করতে পারি তাহলে একটা ভালো ফলপাওয়া যাবে। যদিও অস্থায়ী শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রেইউরোপিও ইউনিয়নে একটা জটিলতা চলছে তবুওসেখানকার শ্রমবাজারে শ্রমিকদের একটা ভালো চাহিদাআছে। একটা বড় সংখ্যার ফিলিপিনো এবং পাকিস্তানিশ্রমিক সেখানে কাজ করছে। কিন্তু ইউরোপের শ্রমবাজারে অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশের কোনোঅবস্থান একেবারে নেই বললেই চলে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছে। তবে তাদের আরোজোরদার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিত।

এই কয়েকটি প্রধান সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করলে একটাকাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যেতে পারে। তবে শুধু বড়সংখ্যার রেমিট্যান্স আসলেই আমরা এখান থেকে অনেকভালো কিছু করে ফেলতে পারব না। প্রবাসী কর্মীদেরশতকরা ৭৫ ভাগ অর্থ তাদের গৃহনির্মাণ সহ দৈনন্দিনপ্রয়োজনে শেষ হয়ে যায়। রেমিটেন্সের আয়েউৎপাদনমূলক খাতে বিনিয়োগ খুব কম হচ্ছে। শুধু ট্রেডিংনির্ভর অর্থনীতি দিয়ে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। নদীতেচর জেগে ওঠার মত আমাদের অর্থনীতি জেগে উঠেছে।কিন্তু উৎপাদনমূলক টেকসই অর্থনীতি গড়ে তুলতে নাপারলে এই চর একদিন নদীতে বিলীন হয়ে যাবে।রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা, অর্থলগ্নীকারি ব্যক্তিরব্যক্তিগত এবং আর্থিক নিরাপত্তা প্রদান, চাঁদাবাজী-টেন্ডারবাজী বন্ধ করে দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করার চেষ্টা করতে হবে। আমরা যদি দেশে সার্বিক সুস্থপরিবেশ সৃষ্টি করতে পারি তাহলে একটা উন্নত বাংলাদেশগড়ার লক্ষ্যে অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হতে পারে প্রবাসীআয়।

লেখক : সাকিব সারোয়ার
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

(ঢাকারনিউজ২৪.কম/এসডিপি/৩:৪০পিএম/১৪/৯/২০১৮ইং)