• ঢাকা
  • বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১২:০২ অপরাহ্ন

ধর্মযাজকের কন্যা থেকে ‘ইউরোপের সম্রাজ্ঞী’ অ্যাঞ্জেলা মার্কেল


প্রকাশের সময় : ডিসেম্বর ৮, ২০১৮, ২:০৫ PM / ৪১
ধর্মযাজকের কন্যা থেকে ‘ইউরোপের সম্রাজ্ঞী’ অ্যাঞ্জেলা মার্কেল

ঢাকারনিউজ২৪.কম, জার্মানির ক্ষমতাসীন দল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাট দলের প্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন দেশটির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল। একসময় মার্কেলকে বর্ণনা করা হতো ‘জার্মানির রানি’ হিসেবে। এমনকি কেউ কেউ তাকে ডাকতেন ‘ইউরোপের সম্রাজ্ঞী’ বলে।

৭ ডিসেম্বর, শুক্রবার এক আবেগময় বিদায়ী ভাষণে মার্কেল তার দেশের ভেতরে এবং বাইরে জার্মানির উদার মূল্যবোধকে বাঁচিয়ে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে এ সব তথ্য জানানো হয়েছে।

সুদীর্ঘকাল মার্কেল জার্মানির ক্ষমতায় আসীন রয়েছেন। নিজেকে তিনি একজন বিচক্ষণ ও বাস্তববাদী নেতা হিসেবে প্রমাণ করেছেন। আঠারো বছর তার দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন মার্কেল। পর পর চার মেয়াদে দেশটির চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি দলের নেতৃত্ব এখন ছাড়লেও চ্যান্সেলর হিসেবে তার চতুর্থ মেয়াদ শেষ করবেন ২০২১ সালে। তখন দেশটির প্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন মার্কেল।

কাজেই ইউরোপের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি জার্মানির নেতৃত্বে তিনি ২০২১ সাল পর্যন্ত থাকলেও এটা এক অর্থে হবে সাময়িক দায়িত্বপালন। মার্কেলের ক্ষমতার শক্ত ভিত প্রথম নড়ে যায় যখন শরণার্থীদের জন্য জার্মানির উন্মুক্ত-দ্বার নীতির নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার মুখে তাকে পড়তে হয়। তার এই নীতির ফলশ্রুতিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে দেশটির চরম ডান-পন্থিরা এবং তার দল প্রায় ৭০ বছরের নির্বাচনি ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ ফল করে ২০১৭ সালে।

মার্কেল বলেছেন, কোনো রাজনৈতিক পদ নিয়ে তার ভবিষ্যত কোনো পরিকল্পনা নেই। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে দুই জার্মানি একত্রিত হওয়ার পর থেকে তিনি কোরো না কোনো রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করেছেন এবং এখন পর্যন্ত একটার পর একটা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছেন।

জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল।
২০০৫ সালে জার্মানির প্রথম নারী চ্যান্সেলর নির্বাচিত হন মার্কেল। ছবি: সংগৃহীত
ধর্মযাজকের কন্যা থেকে রাজনীতির অঙ্গনে

অ্যাঞ্জেলা মার্কেল ১৯৫৪ সালের ১৭ জুলাই পশ্চিম জার্মানির হ্যামবুর্গে জন্মগ্রহণ করেন। মার্কেলের বয়স যখন মাত্র দুমাস, তখন তার বাবা হোর্স্ট কাসনারকে পূর্ব জার্মানির এক ছোট্ট শহরের এক গির্জার ধর্মযাজকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কম্যুনিস্ট পূর্ব জার্মানিতে বার্লিনের উপকণ্ঠে এক গ্রাম এলাকায় বড় হয়েছেন মার্কেল। পদার্থবিদ্যায় ডক্টরেট করে তিনি পূর্ব বার্লিনের একটি বিজ্ঞান অ্যাকাডেমিতে রসায়নবিদ হিসেবে যোগ দেন।

সহপাঠী উলরিখের সঙ্গে মার্কেলের বিয়ে হয় ১৯৭৭ সালে। কিন্তু চার বছর পর তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। ১৯৮৯ সালের পূর্ব জার্মানিতে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গতিশীল হয়ে উঠলে তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন মার্কেল। এর পর বার্লিন প্রাচীর যখন ভেঙে ফেলা হয়, তখন পূর্ব জার্মানিতে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পর তিনি পূর্ব জার্মান সরকারের মুখপাত্র হিসেবে কাজ নেন।

১৯৯০ সালে জার্মানির একত্রীকরণের দুমাস পর মার্কেল মধ্য দক্ষিণপন্থি ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাট পার্টিতে (সিপিইউ) যোগ দেন। পরের বছর চ্যান্সেলার হেলমুট কোলের সরকারে তিনি মহিলা ও তরুণবিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। ২০০০ সালে সিপিইউ দলের নেতা নির্বাচিত হন মার্কেল। ২০০৫ সালে তিনি জার্মানির প্রথম নারী চ্যান্সেলর হন।

জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল।
ইউরোজোনের আর্থিক সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে জার্মানিই সবচেয়ে বড় ত্রাতার ভূমিকায় ছিল। ছবি: সংগৃহীত
অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে জার্মানিকে টেনে তোলা

রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে মার্কেলকে দেখা হতো অনাকর্ষণীয় প্রাদেশিক সাদামাটা একজন নেতা হিসেবে। কিন্তু প্রথম থেকেই সেই ভাবমূর্তি তিনি ঝেড়ে ফেলতে উদ্যোগী হন তার পোশাক-আশাক ও চেহারার পরিবর্তন ঘটিয়ে। তিনি চুলের স্টাইল বদলান, উজ্জ্বল রঙের পোশাক পরতে শুরু করেন। তিনি ১৯৯৮ সালে ইয়োকিম সয়ারকে বিয়ে করেন।

মার্কেল প্রথম সরকার গঠন করেন মধ্য বামপন্থি সোস্যাল ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে একটা মহাজোট করে। এর পর ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত তিনি ব্যবসাবান্ধব ফ্রি ডেমোক্র্যাট দলের সঙ্গে জোট সরকার গঠন করেন। ইউরোপ যখন অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তখন মার্কেল ব্যয়সঙ্কোচের প্রতীক হয়ে ওঠেন। দক্ষিণ ইউরোপের উপর্যুপরি ঋণ সমস্যার মোকাবিলায় তিনি ব্যাপক বাজেট হ্রাস এবং কড়া নজরদারির সুপারিশ করেন।

সমালোচকরা বলেন, মার্কেল অর্থসঙ্কট সামাল দিতে বাড়তি অর্থসাহায্য দেওয়ার ব্যাপারে প্রথমদিকে অনীহা প্রকাশ করেন। কিন্তু ইউরোজোনের আর্থিক সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে জার্মানিই পরে সবচেয়ে বড় ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় এবং ইউরোর প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রয়াসের পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেন মার্কেল।

গ্রিস ও স্পেনে বিক্ষোভকারীরা ব্যয়সঙ্কোচন নীতি বলবৎ করার জন্য জার্মানিকে দোষারোপ করে এবং মার্কেলকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করে। কিন্তু এই সঙ্কটের মধ্যে জার্মানির শক্ত অর্থনৈতিক অবস্থান, বেকারত্বের নিচু হার এবং বেশ ভালো মাত্রার রফতানি দেশের ভেতর মার্কেলকে জনপ্রিয় করে তোলে। জার্মানির মানুষ ব্যাপকভাবে মনে করে কঠিন সময়ে তিনি দেশের জন্য নিরাপদ একজন নেতা।

২০১৩ সাল নাগাদ ব্যয়সঙ্কোচ নীতি সম্পর্কে মার্কেল অপেক্ষাকৃত নমনীয় মনোভাব নেন। তিনি বলেন, বেকারত্ব সমস্যা মোকাবিলার জন্য ইউরোপের শ্রমবাজার আরও উন্মুক্ত করা দরকার, যাতে তরুণরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কাজ খোঁজার সুযোগ পান।

জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘প্রকারান্তর নেতা’ ঘোষণা করা হয় মার্কেলকে। ছবি: সংগৃহীত
উন্মুক্ত দ্বার নীতি

মার্কেলের রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আসে যখন অভিবাসী ও শরণার্থীরা তাদের গন্তব্য হিসেবে বিপুল সংখ্যায় পাড়ি জমায় সফল অর্থনীতির দেশ জার্মানিতে। ২০১৫ সালের জুলাই মাসে দেখা যায় জার্মানিতে আশ্রয় পাবার জন্য কয়েক বছর ধরে অপেক্ষারত এক শরণার্থী নারীকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন মার্কেল। কেউ কেউ এটাকে ভালো চোখে দেখেনি। তারা মনে করেছে মার্কেল সহমর্মিতা দেখাননি।

কিন্তু দলে দলে নতুন শরণার্থী আসার স্রোত যখন বাড়তে থাকে জার্মানির সীমান্ত খুলে দেন মার্কেল। শরণার্থীরা ইইউর যে দেশ দিয়ে ইউরোপে ঢুকছে সেখানে তাদের আশ্রয়া প্রার্থী হিসেবে নাম নথিভুক্ত করার ইইউ নীতি তিনি সাময়িকভাবে স্থগিত করে দেন। জাতিসংঘ তার এই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গীর ভূয়সী প্রশংসা করে। তিনি টাইম সাময়িকীতে ওই বছরের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি নির্বাচিত হন এবং তাকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘প্রকারান্তর নেতা’ ঘোষণা করা হয়।

লক্ষ লক্ষ জার্মান নাগরিক মার্কেলের এই বার্তায় কণ্ঠ মিলিয়ে বলে ‘আমরা মানিয়ে নেব।’ কিন্তু এই উন্মুক্ত-দ্বার নীতিকে সবাই স্বাগত জানায়নি। চরম দক্ষিণপন্থিরা এই নীতির বিরোধিতা করে প্রচারণায় নামে। দেশের পূর্বাঞ্চলে তারা ইসলামবিরোধী প্রচারণায় তৎপর হয়ে ওঠে। প্রচারণা পূর্বাঞ্চলের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে দেশের অন্যত্রও।

এর পর নববর্ষের এক অনুষ্ঠানে অভিবাসীদের দিক থেকে যৌন হয়রানির অভিযোগ এবং গ্রীষ্মকালে ইসলামী চরমপন্থি গোষ্ঠীর হামলা এই প্রচারণাকে শক্ত ভিত্তি দেয়। ধাক্কা খায় মার্কেলের জনপ্রিয়তা। স্পষ্ট করে না বললেও এক রকম স্বীকার করতে বাধ্য হন যে, তিনি ভুল করেছেন। মার্কেল বলেন, ‘যদি পারতাম ঘড়ির কাঁটা কয়েক বছর পেছনে নিয়ে যেতাম, শরণার্থীর ঢল সামাল দেবার জন্য।’

জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল।
২০১৭ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর থেকে জোট গঠন ও নির্ভরযোগ্য সরকার গঠন নিয়ে নানা জটিলতার মুখোমুখি হয়েছেন মার্কেল। ছবি: সংগৃহীত
সেপ্টেম্বর ২০১৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে মার্কেলের সিডিইউ দল খুবই খারাপ ফল করে। ১৯৪৯ সালের পর এটাই ছিল দলের সবচেয়ে শোচনীয় ফল। যা ছিল মার্কেলের প্রতি জনসমর্থন তলানিতে যাওয়ার ইঙ্গিত। এর পর থেকে জোট গঠন ও নির্ভরযোগ্য সরকার গঠন নিয়ে নানা জটিলতার মুখোমুখি হয়েছেন মার্কেল।

প্রাদেশিক নির্বাচনগুলোতে দেখা গেছে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাট দলের প্রতি ও দলের নেতাদের প্রতি জনগণের আস্থা ও সমর্থনের অভাব। বেশ কয়েক মাস আগেই মার্কেল ঘোষণা করেছিলেন দলের প্রধানের পদের জন্য তিনি আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না এবং বর্তমান মেয়াদের পর চ্যান্সেলর পদের জন্যও তিনি আর দাঁড়াবেন না।

সমালোচকরা অনেকেই বলেছেন, দলের খারাপ ফল থেকে এটা পরিষ্কার আগামীতে মার্কেলের জেতার সম্ভাবনা সম্ভবত ক্ষীণ। কিন্তু কারণ যাই হোক ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাট দলের তিনিই সবচেয়ে বেশি মেয়াদে থাকা দলীয় প্রধান এবং আধুনিক জার্মানিতেও মার্কেলই সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতাসীন নেতা।
(ঢাকারনিউজ২৪.কম/কেএস/২:০৫পিএম/৮/১২/২০১৮ইং)