• ঢাকা
  • রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:১৫ অপরাহ্ন

কুড়িগ্রামে বেকার যুবকদের ৬ কোটি টাকা আত্মসাৎ : মুল হোতা মশিউর


প্রকাশের সময় : জুলাই ৭, ২০১৮, ১০:০৪ PM / ৫৬
কুড়িগ্রামে বেকার যুবকদের ৬ কোটি টাকা আত্মসাৎ : মুল হোতা মশিউর

ঢাকারনিউজ২৪.কম, কুড়িগ্রাম : চাকুরী ও ব্যবসার লোভ দেখিয়ে এক প্রতারক চক্র কুড়িগ্রাম থেকে হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ৬কোটি টাকা। এনিয়ে আদালতে মামলা গড়ালেও আসামী পক্ষের হুমকী-ধামকীতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে বিচার প্রার্থীরা। এইচ এম মশিউর রহমান মন্ডল পাপ্পু প্রতারক চক্রের মুল হোতা। তার নেতৃত্বে তিন সদস্যের প্রতারক চক্র। এরা সবাই একই পরিবারে সদস্য। অপর দু’সদস্য হলো- বাবা মতিউর রহমান মন্ডল ও ছোট ভাই হাসান আল মুলক। বে-সরকারি ব্যাংকে অফিসার পদে চাকুরী দেয়ার নাম করে কুড়িগ্রামে ৩৫জন শিক্ষিত বেকার যুবকের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে তিন কোটি ৬৭লাখ ৫০হাজার টাকা। এছাড়া অপর দুজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ব্যাংকের মাধ্যমে দুই কোটি ২৩লাখ ১০হাজার টাকা আত্মসাতের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এইচ এম মশিউর রহমান মন্ডল পাপ্পু ভদ্রবেশী ভন্ড ও প্রতারক। কুড়িগ্রামের ৩৫জন বেকার যুবকে এ বি ব্যাংকের নকল নিয়োগপত্র দিয়ে এ প্রতারণা করেন তিনি। এছাড়াও দু’জন ব্যবসায়ীকেও প্রতারণার ফাঁদে ফাঁসিয়েছেন। এ ব্যাপারে কুড়িগ্রামে পৃথক ৪টি মামলা দায়ের করেছে ভুক্তভোগীরা। পুলিশ মুল প্রতারক এইচ এম মশিউর রহমান মন্ডল পাপ্পুকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হলেও এ চক্রের অন্যতম হোতা মতিউর রহমান মন্ডল ও হাসান আল মুলক এখনও রয়েছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
শাহজাহান সিরাজ নামে এক অভিযোগকারী ১কোটি ১৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাৎ করার অভিযোগ আনয়ন করে কুড়িগ্রাম সদর থানায় ৪২০/৪০৬ ধারায় একটি মামলা রুজু করেন। কুড়িগ্রাম শহরের কাপড় ব্যবসায়ী ইত্তেখায়রুল আলম অপর একটি মামলায় ১কোটি ৭লাখ ৪০ হাজার টাকা আত্মসাত করার অভিযোগ এনে এইচ এম মশিউর রহমান মন্ডল পাপ্পু ও হাসান আল মুলক এর বিরুদ্ধে থানায় মামলা রুজু করেন। অপরদিকে মৃণাল কান্তি বর্ম্মণ কুড়িগ্রাম চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দায়েরকৃত মামলায় আসামী এইচ এম মশিউর রহমান মন্ডল পাপ্পু ও মতিউর রহমান মন্ডলকে চাকুরী দেয়ার নাম করে ১০লাখ ৫০হাজার টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ দাখিল করেন। একইভাবে প্রতারণার শিকার মাহমুদুল হাসান চাকুরী দেয়ার নাম করে সাড়ে ১০লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার বিশ্বাস ভঙ্গের অভিযোগ দায়ের করেন আদালতে।
প্রতারক চক্রের হোতা মশিউর রহমান পাপ্পু
এইচ এম মশিউর রহমান মন্ডল পাপ্পু (৩২)। নির্দিষ্ট কোন পেশা নেই। কিন্তু কয়েক কোটি টাকার মালিক তিনি। ঢাকায় গাড়ী-বাড়ি সবই আছে। আছে উপর মহলের সাথে দহরম মহরম। আছে সরকারি দলের এক প্রভাবশালী নেতার ছায়া। সুচতুর, স্মার্ট এ যুবকের পুঁজি কথার চাতুরতা। প্রতারণাই তার মুল ব্যবসা। তাঁর সহযোগী আপন ছোট ভাই হাসান আল মুলক এবং বাবা মতিউর রহমান মন্ডল। তাদের স্থায়ী ঠিকানা গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার ধনারুহা গ্রামে। আর বর্তমান ঠিকানা মাইস্টিক কনকর্ড টাওয়ার, কবি মমতাজ রেনু কনকর্ড প্যালেস, প্লট নং-১/৪, ব্লক-এ, লালমাটিয়া, মোহাম্মদপুর, ঢাকা। সহোদর দু’ভাই পিতাকে নিয়ে গড়ে তুলেছে প্রতারণার সিন্ডিকেট। ফাঁদ পেতে চালায় রমরমা বিনা পুঁজির ব্যবসা। বাবা ছেলে মিলে প্রথমে উচ্চাকাঙ্খি তরুণ ব্যবসায়ী ও বেকার যুবকদের টার্গেট করে কথার চালে মোহিত করে। বিশ্বাস অর্জন হলেই অফার দেয় স্বল্প মুল্যে কাপড়সহ বিভিন্ন মালামাল সরবরাহ এবং লোভনীয় চাকুরীর টোপ। শুরুতেই হাতিয়ে নেয়া হয় স্বাক্ষরিত ফাঁকা চেক। এরপর দফায় দফায় কিস্তি করে টাকা হাতিয়ে নেয়। ব্যবসায়ীরা মালামাল না পেয়ে চাপ দিলে প্রতারক চক্রটি কৌশলে সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঢাকায় ডেকে নিয়ে অস্ত্রের মুখে ফাঁকা নন-জুডিসিয়াল স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেয়। সাফ জানিয়ে দেয় পাওনাদি শোধ। এরপরও টাকার চাপ দিলে চেকের মামলায় ফাঁসিয়ে দিব।
আর চাকুরী প্রার্থীদের দেয়া হয় এবি ব্যাংক লিঃ এর কর্মকর্তা পদে ভুয়া নিয়োগপত্র। চাকুরীতে যোগদান করতে গিয়ে ভুল ভাঙ্গে। বুঝতে পারে প্রতারণা। ততদিনে সব টাকা হাতিয়ে নেয়া শেষ। ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায় বেকার যুবকদের স্বপ্ন। এতো কিছুর পরও বহাল তবিয়তে রয়েছে এই প্রতারক পরিবার। তাদের হাত অনেক লম্বা। একজন গ্রেপ্তার হলেও অন্য দু’জন এখনও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আইনের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে বাঁচতে তদবীর চলছে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে।
ভুক্তভোগীদের বক্তব্য
কুড়িগ্রাম শহরের কাপড় ব্যবসায়ী ইত্তেখায়রুল আলম জানান, কুড়িগ্রাম শহরের কয়েকজন প্রভাবশালী পরিবারের ছেলে বন্ধু’র সুত্র ধরে এইচ এম মশিউর রহমান মন্ডল (পাপ্পু) আমার সাথে পরিচিত হয় এবং নিজেকে বড় ধরণের ব্যবসায়ী এবং ব্যাংকিং সেক্টরের উচ্চ পর্যায়ে জানা শোনা আছে বলে পরিচয় দেয়। এক পর্যায়ে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। পরিচয় করিয়ে দেয় ছোট ভাই হাসান আল মুলক ও তার পিতা মশিউর রহমান মন্ডলের সাথে। এরপর পর্যাক্রমে আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মহানবী ক্লোথ স্টোরে সওদা করতে আসা ১১জন শিক্ষিত বেকার যুবককে টাকার বিনিময়ে ব্যাংকের অফিসার পদে চাকুরী দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। চাকুরী প্রার্থীরা আমাকে বিশ্বাস করায় আমার নামিয় জনতা ব্যাংক কুড়িগ্রাম শাখায় টাকা জমা করে। সে টাকা পর্যাক্রমে এইচ এম মশিউর রহমান মন্ডল (পাপ্পু) ২৪টি চেক মারফত এক কোটি ৭লাখ চল্লিশ হাজার টাকা ঢাকাস্থ জনতা ব্যাংক তাঁর নিজ নামীয় সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর-০১০০০১৮৫৯০০৪৭ এর মাধ্যমে উত্তোলন করেন। গত বছর মাঝামাঝি সময়ে এ টাকা লেনদেন হয়। এরপর ভুয়া নিযোগপত্র প্রদান করেন। চাকুরী প্রার্থীরা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে যোগদানে ব্যর্থ হলে টাকা ফেরতের চাপ শুরু করে ইত্তেখায়রুল আলমের উপর। আমার মাধ্যমে এবং আমার ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে এ টাকা লেনদেন হওয়ায় আমিও টাকা ফেরত দিতে চাপ দিতে থাকি। এক পর্যায়ে চতুর এইচ এম মশিউর রহমান মন্ডল ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে বিষয়টি মীমাংসার নামে আমাকে ঢাকায় ডেকে নেয়। এরপর অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ফাঁকা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিয়ে ছেড়ে দেয়। এ ব্যাপারে মামলা রুজু করার পর থেকে তাঁর বাবা মশিউর রহমান মন্ডল ও ছোট ভাই হাসান আল মুলক মামলা তুলে নিতে প্রাণনাশের হুমকী দিয়ে আসছে। আমি এখন পরিবার পরিজন নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।
অপর ব্যবসায়ী শাহজাহান সিরাজ লিখিত অভিযোগে জানান, এইচ এম মশিউর রহমান মন্ডল (পাপ্পু) বাবা ও ভাইয়ের সহায়তায় কাপড়ের ব্যবসায় বড় ধরনের লাভের লোভ দেখিয়ে ডাচ বাংলা ব্যাংকের ১৩টি এবং উত্তরা ব্যাংকের ৫টি মোট ১৮টি স্বাক্ষরযুক্ত চেকের পাতা গ্রহন করে। এবং এর মধ্যে বিভিন্ন সময় ১৬টি চেকের মাধ্যমে ১ কোটি ১৫ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা উত্তোলন করেন। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও কোন প্রকার কাপড় সরবরাহ করেননি তিনি। টাকাও ফেরত দিচ্ছেন না। টাকা চাইলেই প্রাণনাশের হুমকী দেয়। ফলে বাধ্য হয়ে কুড়িগ্রাম সদর থানায় মামলা দায়ের করি।
চাকুরী প্রার্থী মাহমুদুল হাসান বলেন, বেসরকারি ব্যাংকে অফিসার পদে চাকুরী দিতে ১৫লাখ টাকা চুক্তি করেন এইচ এম মশিউর রহমান মন্ডল (পাপ্পু)। এর মধ্যে ১০লাখ ৫০হাজার টাকা অগ্রিম গ্রহন করেন। পরে এবি ব্যাংক লিঃ এর কর্মকর্তা পদে’র একটি নিয়োগপত্র দেন। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে যোগদান করতে গেলে কর্তৃপক্ষ নিয়োগপত্রটি ভুয়া বলে সনাক্ত করেন। এখন টাকাও নেই চাকুরী নেই। সব হারিয়ে এখন মানবেতর জীবন-যাপন করছি।
চাকুরী প্রার্থী মৃণাল কান্তি বর্ম্মণ একই রকম অভিযোগ এনে আদালতে মামলা করেছেন। তিনি বলেন, এইচ এম মশিউর রহমান মন্ডল (পাপ্পু) ও তার বাবা মতিউর রহমান মন্ডল দুজন মিলে চাকুরী দেয়ার নাম করে আমার কাছ থেকে সাড়ে ১০লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে প্রতারণা করেছে। এ ঘটনার সাথে জড়িতদের বিচার চাই।
অজিৎ মজুমদার, মিজানুর রহমান, হাসানুজ্জামান, রিয়াজুল ইসলাম, সাজ্জাদ হোসেন, খায়রুল আলম নিজেদের প্রতারিত হওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, তাদের মতো ভুক্তভোগীর সংখ্যা ৩৫জন। তাদের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়ার টাকার পরিমান ৩কোটি ৬৭লাখ ৫০হাজার টাকা।
কুড়িগ্রাম সদর থানার অফিসার ইনচার্জ মাহফুজার রহমান জানান, এইচ এম মশিউর রহমান মন্ডল (পাপ্পু) এবং তার পরিবারের অর্থ জালিয়াতি সংক্রান্ত ৪টি পৃথক মামলা এখন তদন্তাধীন রয়েছে। এরমধ্যে এক কোটি ১৫লাখ ৭০হাজার টাকা আত্মসাৎ মামলায় নেয়া রিমান্ডে ১নম্বর আসামী এইচ এম মশিউর রহমান মন্ডল (পাপ্পু) স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি দিয়েছেন। পুলিশ প্রতারক চক্রের অপর দুই সদস্যকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

(ঢাকারনিউজ২৪.কম/এসডিপি/১০:০৫পিএম/৭/৭/২০১৮ইং)