• ঢাকা
  • সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৫৪ পূর্বাহ্ন

করতলব খান মসজিদ: গৌরবময় অতীতের সাক্ষী


প্রকাশের সময় : জুন ১৯, ২০১৭, ৩:১৬ PM / ৪১
করতলব খান মসজিদ: গৌরবময় অতীতের সাক্ষী

 

মাওলানা মিরাজ রহমান : ঢাকার ঐতিহ্য নিদর্শনের মধ্যে মসজিদ যে অন্যতম, তা বলাই বাহুল্য। এ-কারণেই ঢাকা এক সময় মসজিদের শহর নামে পরিচিতি পেয়েছিল। মোঘল সুলতানেরা মসিজদ নির্মাণের ক্ষেত্রে সীমাহীন আগ্রহ দেখিয়েছিলেন এবং তাদের নির্মিত একেকটি মসজিদও ছিল অনুপম শিল্পের প্রতিকৃতি। বেগম বাজার মসজিদও তেমনই একটি সুপ্রাচীন মসজিদ এবং ঐতিহাসিক স্থানও বটে।

১৭০১-০৪ খ্রিস্টাব্দে দেওয়ান মুর্শিদকুলী খান ওরফে করতলব খান এই মসজিদ নির্মাণ করেন এবং মসজিদটি তাঁর নামেই নামকরণ করা হয়েছে। তবে বেগমবাজারে অবস্থানের কারণে স্থানীয়রা মসজিদটিকে বেগমবাজার মসজিদ নামেও ডেকে থাকে। কেউ কেউ বেগমবাজার শাহী মসজিদও বলে। এমনকি বর্তমানে খুব কম মানুষই মসজিদটিকে করতলব খান মসজিদ নামে চেনে।

সে সময়কার অন্যান্য মসজিদের মতো করতলব খান মসজিদটিও উঁচু ভিত্তির উপর নির্মাণ করা হয়। পাঁচ গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদের উত্তরদিকে একটি কক্ষের মতো বর্ধিত দোচালা রয়েছে। সংযোজিত দোচালা অংশসহ মসজিদটি একটি উঁচু ভল্টেড প্লাটফর্মের পশ্চিমের অর্ধেক অংশ দখল করে আছে। প্লাটফর্মের পূর্বে রয়েছে একটি বাব বা বাউলি (ধাপকৃত কুয়া)। উত্তর-দক্ষিণে ৩৯.৬২ মি এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১৩.৪১ মি প্লাটফর্মের উত্তর প্রান্ত খিলানাকৃতির। প্লাটফর্মের খিলানাকৃতির অংশটির মাঝ বরাবর কেটে একটি সমাধির জন্য জায়গা করা হয়েছে। সারকোফেগাসে মসজিদের প্রথম ইমামের নাম উৎকীর্ণ। প্লাটফর্মটির নিচে সারিবদ্ধভাবে একাধিক বর্গাকার ও আয়তাকার কক্ষ বিদ্যমান, যা এখন দোকানঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্লাটফর্মের পূর্ব দিকে নতুন করে নির্মিত সিড়ি সম্বলিত একটি খিলানপথ রয়েছে। এ পথেই প্লাটফর্মের উপর নির্মিত মসজিদে প্রবেশ করা যায়। তুলনামূলকভাবে বড় একটি বাউলি নির্মিত হয়েছিল সম্ভবত অজু করার জন্য। একটি কক্ষের মধ্য দিয়ে সিড়ির কয়েকটি ধাপ বেয়ে নিচে নেমে এর পানি স্তরের নিকট পৌঁছা যায়। বাইরে থেকেও পানি উত্তোলনের ব্যবস্থা আছে।

মসজিদের আয়তন ৫.৬০ মিটার × ৫.১৮ মিটার। এর অভ্যন্তরভাগে আড়াআড়িভাবে স্থাপিত চারটি চতুর্কেন্দ্রিক খিলান দ্বারা পাঁচটি ‘বে’তে বিভক্ত। কেন্দ্রীয় বে’টি বর্গাকার এবং পার্শ্ববর্তী অন্যান্য ছোট ছোট আয়তাকার বে’গুলি থেকে অপেক্ষাকৃত বড়। প্রত্যেকটি বে গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত। গম্বুজগুলি অষ্টভুজাকার ড্রামের উপর স্থাপিত এবং পদ্ম ও কলস চূড়ায় শোভিত। গম্বুজের ভার বহনে যে পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে তা ঢাকার লালবাগ দুর্গ মসজিদ ও সাত গম্বুজ মসজিদে ব্যবহৃত কৌশলের অনুরূপ। চার কোণের চারটি অষ্টভুজাকার কলস ভিত্তি শোভিত কর্ণার টাওয়ার অানুভূমিক প্যারাপেটকে ছাড়িয়ে উপরে উঠে গেছে। কর্ণার টাওয়ারগুলি নতুন করে নির্মিত ছোট গম্বুজসহ (cupola) বদ্ধছত্রী (kiosk) এবং পদ্ম ও কলস শোভিত শীর্ষচূড়া দ্বারা আচ্ছাদিত। সবগুলি টাওয়ারেরই ডান ও বাম উভয় পার্শ্বে সংযোজিত হয়েছে সরু মিনার যা প্যারাপেট থেকে উচু এবং ছোট গম্বুজ ও কলস ফিনিয়াল দ্বারা আচ্ছাদিত।

মসজিদের উত্তর পার্শ্বের আয়তাকার সম্প্রসারিত অংশটি বাঙালি দোচালা কুঁড়েঘর স্টাইলের ছাদ দ্বারা আচ্ছাদিত, যার প্রান্তগুলি অত্যন্ত বাঁকা ও ঝুলে পড়া। সম্প্রসারিত অংশটিতে (৬.১০ মি × ২.১৩ মি) দুটি দরজা রয়েছে; একটি পূর্ব দেওয়ালের মাঝ বরাবর, বর্তমানে নতুন করে নির্মিত এবং অন্যটি দক্ষিণ দেওয়ালের মাঝে। শেষোক্ত এ দরজা দিয়েই সম্প্রসারিত অংশের সাথে মূল মসজিদ সংযোজিত। সম্প্রতি সম্প্রসারিত অংশের উত্তর দেওয়ালে একটি জানালা স্থাপন করা হয়েছে। এ কক্ষটির অভ্যন্তর ভাগের চারদিকের দেওয়ালে বেশ কিছু আয়তাকার ও বর্গাকার কুলুঙ্গি রয়েছে, সম্ভবত সেলফ হিসেবে ব্যবহারের জন্য এগুলি নির্মিত। বাঁকানো ছাদটি বাইরের দিকে নিয়মিত বিরতিতে পাঁচটি কলস ফিনিয়াল দ্বারা শোভিত। এ সম্প্রসারিত অংশটিকে সমাধিসৌধ মনে করা হলেও সম্ভবত এটি ইমামের বসবাসের জন্যই প্রাথমিকভাবে নির্মিত হয়েছিল, কারণ এটি এখনও এ কাজেই ব্যবহৃত হচ্ছে।

মসজিদ ভবনটির অলংকরণে এর স্থাপত্যিক বিষয়ের ওপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, বিশেষ করে প্রবেশপথগুলির পার্শ্ববর্তী অলংকৃত ক্ষুদ্র মিনার, অভিক্ষিপ্ত মিহরাব, ছত্রী, ছোট গম্বুজ এবং পদ্ম ও কলস শোভিত ফিনিয়াল। প্রবেশপথ ও মিহরাবগুলি ফ্রেমের মধ্যে স্থাপিত এবং এদের শীর্ষ মেরলোন শোভিত। প্যারাপেট ও গম্বুজ ড্রামের গায়েও রয়েছে উন্নত মেরলন মোটিফ। গম্বুজগুলির ভেতরের দিক পত্র নকশাকৃত এবং এদের শীর্ষবিন্দু বিশাল মেডালিয়নের মাঝে একটি রোসেট দ্বারা অলংকৃত। কেন্দ্রীয় খিলানপথটির অর্ধ-গম্বুজ ভল্ট মুকারনা নকশায় স্টাকো করা, যা এখন নষ্ট হয়ে গেছে। এগুলি ছাড়া সমস্ত ভবনটি সাধারণ প্লাস্টার করা যা কিনা বাংলায় মুগল স্থাপত্যের এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। ঢাকায় বিদ্যমান মুঘল স্থাপত্যের ধর্মীয় ইমারত গুলোর মধ্যে বেগম বাজার মসজিদ অন্যতম। একই সাথে এই মসজিদটি বাংলার নবাবী আমলের প্রতিনিধিত্বকারি ইমারত।

রাজধানীর পুরান ঢাকার বেগম বাজার এলাকায় এই মসজিদ অবস্থিত। এক সময় বুড়িগঙ্গা নদীর অববাহিকা এই মসজিদের কোলঘেষে প্রবাহিত হত বলে ধারণা করা হয়। বর্তমানে নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে প্রায় ১.৫ কি.মি. দূর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর প্রাচীন স্থাপত্য সৌন্দর্য দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে, বিস্মিত করে। পূর্ব দেয়ালে ৫টি প্রবেশপথ বরাবর কিবলা দেয়ালে ৫টি অবতল মিহরাব রয়েছে। ক্ষুদ্রাকৃতির মিহরাবগুলো আয়তাকার প্যানেলে আবদ্ধ। মাঝখানের প্রবেশ পথ বরাবর মিহরাবটি তুলনামূলকভাবে বড় সেটিই মসজিদের প্রধান মিহরাব। প্রধান মিহরাবের উত্তর ও দক্ষিণে ক্ষুদ্রাকার আরো ২টি মিহরাব আছে। প্রধান মিহরাবটি খাজ খিলান নকশায় অলংকৃত। খিলান পাশ্ববর্তী ত্রিকোণাকার ভূমি জ্যামিতিক নকশা ও ফুলেল নকশা সমৃদ্ধ। প্রতিটি মিহরাবের খিলান শীর্ষে ফুটন্ত ফুলের নকশা রয়েছে। মিহরাবের অবতল ভূমি তিনটি খিলান নকশাযুক্ত প্যানেলে অবদ্ধ। মূল মিহরাব বাদে বাকি ৪টি মিহরাবের আয়তকার ভূমির উপরে মারলোন নকশা রয়েছে। (প্রিয়.কম)
(ঢাকারনিউজ২৪.কম/এসডিপি/৩:০৫পিএম/১৯/৬/২০১৭ইং)