• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৫৩ অপরাহ্ন

সাতক্ষীরার কালিগঞ্জে ‘ওঠাও বাচ্চা’ লটারী ও নৃত্যের আসর নিঃস্ব মানুষ!


প্রকাশের সময় : জানুয়ারী ১৬, ২০২৩, ১০:৫২ AM / ১০৩
সাতক্ষীরার কালিগঞ্জে ‘ওঠাও বাচ্চা’ লটারী ও নৃত্যের আসর নিঃস্ব মানুষ!

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ বাসটার্মিনাল সংলগ্ন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুস সামাদ স্মৃতি সংঘের মাঠে “ওঠাও বাচ্চা” লটারী ও নৃত্যের আসর রমরমিয়ে চলছে। জেলা প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই সাতক্ষীরা-৩ আসনের নির্বাচনীয় সীমান্ত এলাকায় কালিগঞ্জ থানা হতে কয়েকগজ দুরে বিজয় মেলা নামে এ আসর বসানো হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় প্রশাসন, ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও কতিপয় জনপ্রতিনিধিকে ম্যানেজ করেই মেলার মুল ফটকে দেওয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি। শীর্ষ ২ মহান ব্যক্তির ছবি লাগিয়ে লটারীর জুয়া খেলায় প্রায় ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রটি।

এছাড়া মেলার প্রধান ফটকের বাম দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সাবেক স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী ডাঃ আ.ফ.ম রুহুল হকের ছবি রয়েছে। ডান দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও কালিগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এনামুল হোসেন ছোট এর ছবি শোভা পাচ্ছে। মেলা শুরুর প্রথম আট দিনে একটি লটারী টিকিটের মূল্য ১০ টাকা ও তারপর থেকে লটারী টিকিটের মূল্য ২০ টাকা ধার্য করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে আসর জমাতে প্রতিদিন ব্যাটারী চালিত ইজিবাইকে চটকদারি পুরষ্কারের ঘোষণা দিয়ে চলছে লটারীর মাইকিং। লটারীর প্রতিদিনের টিকিট মূল্য ২০ টাকা। যদিও প্রচার ইজিবাইকের পিছনে লেখা আছে প্রবেশের টিকিটের উপর পুরষ্কার বিতরনী অনুষ্ঠান।
রবিবারের আকর্ষণ হিসেবে ৬১টি পুরষ্কারের মধ্যে প্রথম পুরষ্কার সুজুকী ১৫৫সিসি মটর সাইকেল, ৩১তম ও শেষ পুরষ্কার হিসেবে একটি করে ৮০ সিসি রানার মটর সাইকেল একজোড়া করে দুজনের সোনার কানের দুল ও ১০টি মোবাইল সেট পুরষ্কার হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে।
রবিবার টিকিট ফেলার জন্য ৭৬টি বক্স ও প্রচারণার জন্য ২৮টি ইজিবাইকের এর ব্যবস্থা করেছেন “ ওঠাও বাচ্চা” লটারীর পরিচালক মানিক শিকদার। কালিগঞ্জ উপজেলার মধ্যে প্রচারনার জন্য একজন ইজিবাইক চালককে দেওয়া হচ্ছে এক হাজার টাকা। উপজেলার বাইরে গেলে দেড় হাজার। এক একজন প্রচারকারি পাচ্ছেন প্রায় হাজার টাকা। যারা বিভিন্ন স্থানে বসে টিকিট বিক্রি করছেন তারা প্রতিদিন পাচ্ছেন ৫-৭শত টাকা। রাত ১০টার পরপরই লটারী শুরুতেই দর্শণার্থী এক বাচ্চাকে মঞ্চে ডেকে নিয়ে তার চোখে কালো কাপড় বেঁধে চারকোনায় চারজনকে দাঁড় করিয়ে কাপড় টানিয়ে ঢালা হয় বিক্রিত টিকিটের মুড়ি বা ছোট অংশ। এরপর ওই বাচ্চা একএক করে নির্ধারিত পুরষ্কারের আলোকে সেই কয়টি লটারীর টিকিটের মুড়ি অংশ তুলে ধরে সকলের সামনে। পরে ওই লটারীর নাম্বার মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়।
কালিগঞ্জের বাজারগ্রাম রহিমপুরের ওমর ফারুখ, তেঁতুলিয়া গ্রামের সাজ্জাত আলী ও নলতা আহছানিয়া মিশন এলকার রফিকুল ইসলাম জানান, গত ৩০ ডিসেম্বর রাত সাতটায় কালিগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মাষ্টার নরীম আলী মুন্সির সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক এনামুল হোসেন ছোট এর সঞ্চলনায় এক মাস সাত দিনব্যাপি বিজয় মেলার উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সাবেক স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী ডাঃ আ.ফ.ম রুহুল হক।
জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদনের প্রেক্ষিতে গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর এক মাস সাত দিনের এ মেলার চালানোর অনুমতি দেন সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের নেজারত শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট (এনডিসি) বাপ্পি দত্ত রণি। গত ৩০ ডিসেম্বর থেকে অনুমোদন পাওয়া মেলায় যাত্রাপালায় নগ্ন নৃত্য, লটারী, জুয়া ও হাউজি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ কালিগঞ্জসহ সাতক্ষীরার ক্ষমতাসীন দল ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতা, কয়েকজন বড় মাপের জনপ্রতিনিধি, সংবাদকর্মীদের ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই প্রতিদিন চলছে এ রক্তচোষা জুয়া চলছে। গত এক সপ্তাহের পুরষ্কারের হিসাব করে তারা বলেন, প্রতিদিন গড়ে তিন থেকে চার লাখ টাকার পুরষ্কার দেওয়া হয়। অথচ প্রতিদিন ২২ থেকে ২৫ লাখ টাকার টিকিট বিক্রি হয়।
সেক্ষেত্রে এক মাস সাত দিন মেলা চললে প্রথম ৮ দিনের ১০ টাকা টিকিট ও পরবর্তী একমাসের বিক্রিত টিকিট মূল্য থেকে পুরষ্কার মূল্য, ইজিবাইক, প্রচারকারি, ডেকরেটরসহ আনুষঙ্গিক খরচ বাদ দিয়ে মোট ৬০ কোটি টাকার বাণিজ্য হবে আয়োজক কমিটির।
তারা আরো জানান, লটারী টিকিট কেটে পুরষ্কারের নামে বাড়ছে চুরি ও ছিনতাই। বাড়ি থেকে জিনিসপত্র ও টাকা চুরি করে লটারী টিকিট কিনতে বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের টাকা দিয়ে প্রতিদিন মোটা অংকের লটারীর টিকিট কিনতে যেয়ে অনেকেই হচ্ছেন সর্বশান্ত। আবার ঘটছে পারিবারিক অশান্তি। অবিলম্বে এ লটারী বন্ধের দাবি জানান তারা।
কালিগঞ্জ উপজেলার মুকুন্দ মধুসুধনপুরের ইসমাইল হোসেন পেশায় ভ্যানচালক। ভ্যান চালিয়ে প্রতিদিন যে টাকা আয় হয় তা দিয়ে মেলা উদ্বোধনের পরদিন থেকে ২০ থেকে ২৫ টি করে টিকিট কিনেছেন। শনিবার পর্যন্ত ১৫ দিনে একটি পুরষ্কার পাননি। অথচ বাড়িতে চাল ও বাজার কম করার প্রতিবাদ করতে যেয়ে স্ত্রী রমেছা খাতুনকে টিপিয়ে কোমরের হাড় ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তাকে সাতক্ষীরার একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে গত বুধবার।
সাদপুরের রুবেল হোসেন। পেশায় বাসের হেলপার। প্রতিদিন যে আয় হয় তাতে ১০টির বেশি টিকিট কেনা যায় না। বন্ধুর কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েও বেশি টিকিট কিনেছেন। টিকিট কিনেও পুরষ্কারের ভাগ্য খোলেনি রুবেলের।
কাঁকশিয়ালী গ্রামের ইমান আলীর ছেলে নজরুল ইসলাম নজু পুরষ্কারের লোভে প্রতিদিন ১০০ থেকে দেড়শত টিকিটি কিনেছেন। বিক্রি করেছেন একটি গাভী ও কয়েকটি হাঁস মুরগি। গত ১৫ দিনে লটারীর পিছনে খরচ করেছেন ৭০ হাজার টাকা। প্রতিবাদ করে লাভ না হওয়ায় শনিবার সকালে স্ত্রী বাপের বাড়ি চলে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন।
একইভাবে কালিগঞ্জ বাস টার্মিনালের সৈনিক হোটেলের মালিক অবসরপ্রাপ্ত বিডিআর সদস্য মিলন হোসেনের ছেলে সেলু প্রতিদিন বড় অংকের টিকিট কেটেছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বন্ধুদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে। এখন চলছে প্রতিনিয়ত অশান্তি। একইভাবে কালিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মোড়ে আজগার আলীর ছেলে চায়ের দোকানদার সিরাজুল ইসলাম সিরাজ স্ত্রী ও ছেলেকে দোকানে বসিয়ে ছুটেছেন লটারীতে মোটর সাইকেল পাওয়ার আশায়। প্রতিদিন কিনেছেন ৭০ থেকে ১০০ টি লটারী। এখন তার হাঁড়ি না জ্বলার উপক্রম। উড়ে গেছে সংসারের শান্তি নামের সাদা পায়রাটি।
লটারী কিনে পুরষ্কারের লোভে পূর্ব নলতার আজগার আলী, কুশুলিয়ার রাজিব, শ্যামনগরের বাধঘাটার রুহুল আমিন, সখীপুরের আবুল বাসারসহ অনেকে এ পর্যন্ত ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার টিকিট কিনেও তাদের কপাল বড় হয়নি।
এ ব্যাপারে কালিগঞ্জ শহীদ আব্দুস সামাদ স্মৃতি সংঘের মাঠে বিজয় মেলা উপলক্ষে লটারীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মানিক শিকদার বলেন, লটারী না হলে মেলা চলে না। তিনি দেখা করার অনুরোধ জানান।
মেলার দায়িত্বে থাকা কালিগঞ্জ সড়ক ও পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মনিরুল ইসলাম মনি ও সামাদ স্মৃতি সংঘের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হামিদ বলেন, মেলা চলছে ঠিকই তবে অনুমোদন বিহীন লটারী চলছে না একথা বলা যাবে না। তবে এটি একটি আনন্দের বিষয় বলে সেখানে যাওয়ার আহবার জানা তারা।
কালিগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এনামুল হোসেন ছোট জানান, মেলায় প্রবেশের টিকিট দিয়ে লটারী করা হয় বলে তিনি জানেন। তবে প্রকাশ্যে লটারী বিক্রির কথা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহোদয় তাকে অবহিত করলে তিনি বিষয়টি মানিক শিকদারকে ডেকে সতর্ক করেছিলেন। তবে আওয়ামী লীগ বা তার অঙ্গ সংগঠণের কোন নেতা লটারী নিয়ে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত নন দাবি করে তিনি বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
কালিগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ মামুন রহমান বলেন, অনুমতি ছাড়াই লটারী চলছে। তিনি বিষয়টি নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
কালিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রহিমা সুলতানা বুশরা জানান, বিষয়টি নিয়ে তিনি জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। যে কোন সময় লটারী বন্ধ করে দেওয়া হবে।
এ বাপারে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোঃ হুমায়ুন কবীরের সঙ্গে রবিবার বিভিন্ন সময়ে মোবাইলে যেগোযোগ করেও তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে মেলার অনুমতিপত্রে সাক্ষরকারি নেজারত শাখার নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট বাপ্পি দত্ত রণি বলেন, বিষয়টি তিনি খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেবেন।