• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ০৭:২৯ পূর্বাহ্ন

ফারাজ-অবিন্তার নামে কক্ষ এমোরিতে


প্রকাশের সময় : এপ্রিল ২২, ২০১৭, ২:১৫ PM / ১০৪
ফারাজ-অবিন্তার নামে কক্ষ এমোরিতে

ঢাকারনিউজ২৪.কম:

 

‘হোসেন-কবির কক্ষ’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কক্ষের সামনে বক্তব্য দিচ্ছেন এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অক্সফোর্ড কলেজের ডিন ডগলাস এ হিকস (বাঁয়ে) এবং ফারাজের বড় ভাই যারেফ আয়াত হোসেন (ডানে)। ছবি: সংগৃহীত‘হোসেন-কবির কক্ষ’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কক্ষের সামনে বক্তব্য দিচ্ছেন এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অক্সফোর্ড কলেজের ডিন ডগলাস এ হিকস (বাঁয়ে) এবং ফারাজের বড় ভাই যারেফ আয়াত হোসেন (ডানে)। ছবি: সংগৃহীতগত বছরের ১ জুলাই গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন দুই বন্ধু ফারাজ আইয়াজ হোসেন ও অবিন্তা কবির। তাঁরা পড়তেন যুক্তরাষ্ট্রের এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁদের স্মৃতি ধরে রাখতে এবং সাহসিকতার প্রতি সম্মান জানাতে গত ২৯ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়টি তাদের অক্সফোর্ড কলেজ ক্যাম্পাসে উদ্বোধন করেছে ‘হোসেন-কবির কক্ষ’। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ফারাজ ও অবিন্তার পরিবারের সদস্যরা। সেই অনুষ্ঠান থেকে ফিরে এসে লেখাটি লিখেছেন ফারাজের বড় ভাই যারেফ আয়াত হোসেন

ফারাজ আইয়াজ হোসেনফারাজ আইয়াজ হোসেনযুক্তরাষ্ট্রের এমোরি বিশ্ববিদ্যালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা ফারাজ ও অবিন্তাকে শুধুই স্মৃতি হিসেবে ফেলে রাখবে না। ফারাজ ও অবিন্তার প্রেরণাকে তারা প্রতিষ্ঠানের বনিয়াদি মূল্যবোধের প্রতীক হিসেবে সম্মান দেবে বলে ঠিক করেছে। তাদের নিজেদের দুজন শিক্ষার্থী তাদের সংস্পর্শে আসা প্রত্যেকের অন্তরাত্মাকে স্পর্শ করেছে। এ দুই অবিশ্বাস্য ব্যক্তিকে তারা চিরকাল ধারণ করবে। এমোরি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের অক্সফোর্ড কলেজ ক্যাম্পাসে উদ্বোধন করেছে হোসেন-কবির কক্ষ। এটা হলো একটি হল ঘর। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট বা বড় অনুষ্ঠান হয়। তারা ঠিক করেছে, ফারাজ ও অবিন্তা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃদয়ের মণিকোঠায় চিরকাল ঠাঁই পাবেন।
কক্ষের নামকরণ উপলক্ষে এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অক্সফোর্ড ক্যাম্পাসে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আমি, মা (সিমিন হোসেন), নানাভাই (লতিফুর রহমান) ও নানুমা (শাহনাজ রহমান) যখন হাজির হই, তখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবার আমাদের সাদরে গ্রহণ করে। এমোরির প্রতিটি কলেজের সব ডিন উপস্থিত ছিলেন, উপস্থিত ছিলেন সব শিক্ষক। উপস্থিত শিক্ষার্থীরা আবেগে ছিলেন উদ্বেল। যে শিক্ষার্থীরা এই নামরকণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন, তাঁদের গায়ে নিজেদের নকশা করা টি-শার্ট; টি-শার্টে এমোরির অক্সফোর্ড ক্যাম্পাসের সবচেয়ে পুরোনো ভবন সিনেই হলের স্কেচ। হলের মাথায় উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা। মিত্র, বন্ধু, নেতা, অনুকরণীয় চরিত্র হিসেবে এই কমিউনিটির ওপর ফারাজ ও অবিন্তা যে প্রভাব ফেলেছে এবং সর্বোপরি তারা তাদের আনন্দ-উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে পুরো এমোরি কমিউনিটির ওপর যে প্রভাব রেখে গেছে, এটা তারই সত্যিকার সাক্ষ্য।
অনুষ্ঠানে কথা বলেন এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রুশে অমরনাথ। এই উজ্জ্বল তরুণ ফারাজকে তাঁর পরামর্শদাতা বলে গণ্য করতেন। তিনি বলেন, এতকাল তাঁর বিশ্বাস ছিল, সময়ের ডানায় উড়ে শোক অন্তর্হিত হয়, কিন্তু তিনি দেখছেন, এই শোক এই ক্যাম্পাস ছেড়ে যায়নি। মুছে না যাওয়া এই শোকই শুধু নয়, সেই সঙ্গে অসীম গৌরবের আবেগে চালিত হয়ে শিক্ষার্থীরা এত দিনকার অ্যাকিন কক্ষের নাম রেখেছেন হোসেন-কবির কক্ষ। কক্ষের এই নামকরণের মধ্য দিয়ে এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে ফারাজ ও অবিন্তার নাম খোদাই হয়ে গেছে। সেদিনই ফারাজ ও অবিন্তা হয়ে উঠেছে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ইতিহাসের অংশ।
অনুষ্ঠানে ফারাজ ও অবিন্তা সম্পর্কে কিছু কথাঅনুষ্ঠানে ফারাজ ও অবিন্তা সম্পর্কে কিছু কথাআগে যেটার নাম ছিল অ্যাকিন কক্ষ, এখন যেটা হোসেন-কবির কক্ষ, সেটা এই ক্যাম্পাসের হৃৎস্পন্দন হয়ে থাকবে। এই কক্ষের অবস্থান ক্যান্ডলার হলের ভেতরে। এই ভবনেই প্রথম পা রেখে শিক্ষার্থীরা তাঁদের আবাসিক হলের চাবি সংগ্রহ করেন, শিক্ষার্থী হিসেবে তাঁদের যাত্রা শুরু হয়। এখন প্রজন্মের পর প্রজন্ম নতুন আসা শিক্ষার্থীরা হোসেন-কবির কক্ষের দিকে একবার করে তাকাবেন। তাঁরা জানতে পারবেন সেই দুই বাংলাদেশির কথা, যাঁদের শিক্ষার্থীরা অনন্তকালের জন্য এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবিচ্ছেদ্য অংশ করে নেওয়ার জন্য বেছে নিয়েছেন। এই দুজনের প্রভাব এই কক্ষের গল্প জানতে পারা সবার জীবনেও প্রবাহিত হতে থাকবে।
অবিন্তা কবিরঅবিন্তা কবিরফারাজের ভাই ও এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে তাকে নিয়ে আমার গর্ব বেড়েই চলেছে। আমি সব সময় জেনে এসেছি, ও ছিল ব্যতিক্রমী একজন মানুষ, অনন্য ছাত্র, ওর মধ্যে সহজাত নেতৃত্বের গুণ ছিল। সে যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছে, তা অচিন্তনীয়। অনেককে ও কাঁদিয়ে গেছে বটে, তবে এই শোক ক্রমাগত ছাপিয়ে উঠে আসছে ওর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের গর্বের অনুভূতিতে। এঁদের অনেকের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখাই হয়নি তার। ১ জুলাই ফারাজ মানবিকতার যে স্বাক্ষর রেখেছে, সশস্ত্র সন্ত্রাসবাদীদের নির্দেশ সত্ত্বেও বন্ধু অবিন্তা কবির ও তারিশি জৈনকে ছেড়ে যেতে সে যেভাবে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল, সেটা ছিল সারা বিশ্বের এক তুরীয় মূল্যবোধের বহিঃপ্রকাশ। তার অটুট বন্ধুত্বের মূল্যবোধ, অটল সাহসিকতা ও মানবতার পক্ষে অনড় অবস্থান—এমোরি বিশ্ববিদ্যালয় এসব মূল্যবোধেরই প্রতিনিধিত্ব করে। এসব মূল্যবোধই লালন করে বাংলাদেশ। হোসেন-কবির কক্ষের নামকরণের মাধ্যমে ফারাজ ও অবিন্তা কবিরকে সম্মানিত করা এই দুজনের অবিশ্বাস্য অবদানের ব্যাপারে এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতিই শুধু নয়, অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে, অবিচারের বিরুদ্ধে এটা আমাদের সবার সংহতির ঘোষণাও বটে। এই ঘোষণা বলছে, আমরা সাহসিকতা, বন্ধুত্ব আর মানবিকতাকে মূল্য দিই।
ফারাজের কথা যতবার ভাবি, ততবারই মনে পড়ে জীবন কত অনিশ্চিত; এই পৃথিবীতে আমাদের আয়ুষ্কাল আমরা কেউ জানি না। যে চিহ্ন আমরা পেছনে ফেলে যাই, কালস্রোতে তা অক্ষয় নয়। বছরের সংখ্যা দিয়ে আমাদের বিচার হবে না, কে কত বছর বেঁচেছি, তা দিয়ে নির্ধারণ হবে না আমাদের জীবনের মহত্ত্ব, তা যত পরিপূর্ণভাবেই বাঁচা হোক না কেন। বিশ বছর বয়সেই ফারাজের জীবনের প্রভাব আমাদের দেশের সীমানা ডিঙিয়ে গেছে এবং জাতি-ধর্ম-জাতীয়তানির্বিশেষে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ রচনাকারী সব সীমানা অতিক্রম করে গেছে তার কীর্তি। যেখানেই যাই, সেখানে একটা ইতিবাচক প্রভাব রাখতে মা সব সময় ফারাজ ও আমাকে উৎসাহ জুগিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখার আগে আমরা দুজনেই লক্ষ্য স্থির করেছিলাম, আমরা তাঁকে গর্বিত করব। আজ ফারাজ যে তার নাম এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশ করে তুলেছে, শুধু তা-ই নয়, সে সারা বিশ্বেই তার নাম ছড়িয়ে দিয়েছে। যেদিন আমার নিজের সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় পা রেখে নিজেদের অনন্যতার স্বাক্ষর রাখার সময় আসবে, সেদিন আমি তাদের হোসেন-কবির কক্ষে নিয়ে যাব। আমি তাদের এ কথাই মনে করিয়ে দেব যে তারা ফারাজের অদম্য উত্তরাধিকারের ধারাবাহিকতা। আমার মতো তাদেরও কর্তব্য আছে: পৃথিবীতে যা ন্যায্য তার জন্য প্রতিটি মুহূর্ত সাহসিকতার সঙ্গে লড়াইয়ের কর্তব্য, ফারাজের আদর্শের জন্য লড়াইয়ের কর্তব্য।
উদ্বোধনী আয়োজনে এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন অবিন্তার মা রুবা আহমেদ (বাঁ থেকে দ্বিতীয়) এবং ফারাজের মা সিমিন হোসেন ও বড় ভাই যারেফ আয়াত হোসেন (ডান থেকে তৃতীয় ও দ্বিতীয়)উদ্বোধনী আয়োজনে এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন অবিন্তার মা রুবা আহমেদ (বাঁ থেকে দ্বিতীয়) এবং ফারাজের মা সিমিন হোসেন ও বড় ভাই যারেফ আয়াত হোসেন (ডান থেকে তৃতীয় ও দ্বিতীয়)

আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনের কথা চিন্তা করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য ডুলির প্রতি আবেগ পোষণ না করে পারছি না। এই কঙ্কালের মাসকটটি এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শের প্রতীক। ডুলির মন্ত্র হলো, ‘প্রেসিডেন্টরা আসবেন, যাবেন; অধ্যাপকেরা আসবেন, যাবেন; শিক্ষার্থীরাও আসবেন, যাবেন; কিন্তু ডুলি থেকে যাবেন চিরকাল।’
আমি বলি, ডুলি, ফারাজ ও অবিন্তা চিরকাল থাকবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত

 

  (ঢাকারনিউজ২৪.কম/এনএম ০২.১২পিএম/২২//২০১৭ইং)