• ঢাকা
  • শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০৭:২২ পূর্বাহ্ন

জয় বাংলা থেকে বাংলাদেশ


প্রকাশের সময় : এপ্রিল ২১, ২০২২, ৬:০৫ PM / ৪১
জয় বাংলা থেকে বাংলাদেশ

নাসির উদ্দীন ইউসুফ : হ্যাঁ, জয় বাংলা ধ্বনি থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম। জয় বাংলা ধ্বনি গত শতকের ষাটের দশকে বাঙালী মাত্রই প্রাণে দোলা দিয়েছিল। স্বাধীনতা ও মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিল এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে বুকের রক্ত দিয়ে বাঙালী স্বাধীনতা অর্জন করে নেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠ থেকে নির্গত ‘জয় বাংলা’র মতো রাজনৈতিক ধ্বনি কিভাবে বাঙালীর জীবন, সংস্কৃতি ও রাজনীতির নিয়ামক শক্তি হয়ে উঠেছিল সে প্রসঙ্গে যাওয়ার পূর্বে দেখে নেই বাংলা বা বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের উৎপত্তি ও জয় বাংলা ধ্বনির প্রথম শ্রুত হওয়ার কথা।
দক্ষিণ এশিয়ায় প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানব বসতি গড়ে উঠেছিল। অন্তত ত্রিশ হাজার বছর আগে পাথর যুগের মানুষের বসবাস ছিল এ ভূখণ্ডে। কিন্তু প্রাচীন ইতিহাস থেকে বাংলাদেশকে বাদ রাখা হয়েছিল। বলা হতো ব-দ্বীপ বাংলাদেশ গড়ে উঠেছে সমুদ্র থেকে বড় জোর দুই হাজার বছর আগে। কিন্তু সাম্প্রতিক ও ভূতাত্ত্বিক গবেষণায় পাল্টে গেছে এ ধারণা। ভূ-তাত্ত্বিকরা জানাচ্ছেন, ব-দ্বীপের কোন কোন অঞ্চল গড়ে উঠেছে প্লায়োটেরিয়াস যুগে। নব্য প্রস্তর যুগের একটি বাটালি পাওয়া গেছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের পাহাড়ে। পুরোপলীয় ও নবোপলীয় যুগের হাতিয়ার পাওয়া গেছে ফেনীর ছাগলনাইয়া অঞ্চলে, কুমিল্লার লালমাইয়ে এবং সাম্প্রতিককালে উয়ারী-বটেশ্বর ও চুনারুঘাটে। এতো গেল প্রাগৈতিহাসিক কালের কথা। কিন্তু প্রাচীন বাংলা কী বলে? প্রাচীনকালে এ জনপদের ছয়টি অঞ্চল ছয়টি ভিন্ন নামে নির্ণীত হতো। ১. বঙ্গ ২. পুণ্ড্র ৩. রাঢ় ৪. গৌড় ৫.সমতট ৬. হরিকেল।
মহাকবি কালিদাসের লেখা রঘুবংশ কাব্যে বঙ্গের অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় এবং তা ভাগীরথী ও পদ্মার মধ্যবর্তী ত্রিভুজাকৃতি ভূমিটি হচ্ছে বঙ্গ। অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্বদিক। প্রাচীন বঙ্গও দুটি অংশে বিভক্ত এবং তা একটি বিক্রমপুর অন্যটি নব্য যা ফরিদপুর বাকেরগঞ্জ ও পটুয়াখালীর নিচু অঞ্চল। অন্যদিকে বর্তমানের রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর ও দিনাজপুর নিয়ে পুণ্ড্র (বরেন্দ্র) অঞ্চল। পুণ্ড্র জাতির বসবাসের কারণে নাম হয় পুণ্ড্র। রাঢ় অঞ্চল বর্ধমানের বীরভূমের পূর্বাঞ্চল এবং দামোদর নদীর উত্তরে ছিল বলে অনুমেয়। বর্তমানের হাওড়া, হুগলি রাঢ় অন্তর্ভুক্ত।
গৌড়-মালদহ, মুর্শিদাবাদ অঞ্চল নিয়ে গঠিত। সমতট অঞ্চল-বর্তমান কুমিল্লা, নোয়াখালী অঞ্চল নিয়ে গঠিত এবং বঙ্গের প্রতিবেশী অঞ্চল।
হরিকেল সম্পর্কে ব্যাপক মতভেদ আছে। তবে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও সিলেট অঞ্চল নিয়ে হরিকেল গঠিত বলে ইতিহাসবিদদের ধারণা। অনেকে হরিকেলকে বঙ্গের অংশ মনে করেন।
গ্রিক ইতিহাসে ‘গঙ্গারাড’ শক্তিশালী রাজ্যের কথা জানা যায়। রাজা বিজয়ের নামও জানা যায় এবং এর অবস্থান গঙ্গা অববাহিকায় এবং রাজধানীর নাম গাঙ্গে। কিন্তু বঙ্গ নামের উল্লেখ নেই। সেটি খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দ। তারপর মৌমর্যযুগ, কুষাণ যুগ, গুপ্তযুগ, স্বাধীন গৌড় রাজ্য এসবের কথা জানা যায়। কিন্তু ‘স্বাধীন বঙ্গ রাজ্য’ এর উত্থান ঘটে রাজা গোপচন্দ্রের নেতৃত্বে। বঙ্গ ও সমতট অঞ্চল নিয়ে গঠিত এ স্বাধীন রাজ্য। ৫২৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই স্বাধীন বঙ্গ রাজ্যের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন ছিল। এটি রাজা শশাঙ্কের স্বাধীন গৌড় রাজ্য প্রতিষ্ঠার কিছুকাল আগের ঘটনা।
১৩৩৮ থেকে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ঢাকার অদূরে সোনারগাঁকে রাজধানী করে স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাজ্যের উদ্ভব হয়। সুলতানী আমলে এ রাজ্যকে ‘বাংলা’ বলে অভিহিত করা হয়।
দীর্ঘ ইতিহাসে আমরা এভাবেই প্রত্যক্ষ করি নানা বহিঃশত্রুর দ্বারা বাংলাকে পদানত হতে, শাসিত হতে, নিপীড়িত হতে। এরই ধারাবাহিকতায় ইংরেজরা প্রথমে বাংলা পরবর্তীতে সমস্ত ভারতকে উপনিবেশ হিসেবে শাসন করা শুরু করে।
এর মাঝে ভারতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দুঃসময়ের বাঙালী তথা ভারতীয়দের সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন একটি রাজনৈতিক অভিপ্সা পায়। ব্যাপক গণঅসন্তোষ সৃষ্টি করে সমগ্র বাংলায় এবং ভারতের বিভিন্ন স্থানে। ব্রিটিশ শাসক দ্রুত বাংলাকে বিভক্ত করে এই গণঅসন্তোষ দমাবার ঘৃণ্য প্রক্রিয়া শুরু করে। ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন শুরু হয়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এর নেতৃত্বে চলে আসেন। পূর্ব ও পশ্চিম বাংলাকে গঙ্গা নদীর-পদ্মার বিচ্যুতি থেকে অনুমেয় রেখার ভিত্তিতে ভাগ করে। কেননা ইতোপূর্বে রেনেল (১৭৭৯) অঙ্কিত মানচিত্র তৈরি হয়ে গেছে।
প্রশাসনিক সুবিধার কথা বলে বাংলা ভাগ করে স্বাধীনতার আন্দোলন নস্যাত করা ছিল ব্রিটিশদের কূটকৌশল। এ সময় খুব বেগবান হয়ে ওঠে স্বদেশী আন্দোলন। এই স্বদেশী আন্দোলন চলাকালীন এবং বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের সময়েই প্রথম ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি উচ্চারিত হতে দেখা যায়। আন্দোলনের সময় ‘সোনার বাঙ্গালা’ নামে গোপন ইশতেহার প্রকাশ ও প্রচার ঘটেছিল। সেই প্রথম ১৯০৬ সালে ‘জয় বাংলা’ উচ্চারিত হয়েছিল। একই সঙ্গে আমাদের স্মরণে আসে যে ওই সঙ্কটকালে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হিসেবে ‘মুসলিম লীগ’ এর জন্ম হয়।
ঔপনিবেশিক শাসনের নিপীড়ন, নির্যাতন আর বঞ্চনার ইতিহাস আমাদের কমবেশি জানা। ফরাসী বিপ্লব ও শিল্প বিপ্লবের প্রভাব তখন সমগ্র বিশ্বে। ভারত বিশেষ করে বাংলা সেই প্রভাবমুক্ত থাকল না। ইউরোপীয় জ্ঞান আলোকে ও চর্চায় কিন্তু বাঙালী তরুণ পশ্চিমা জাতীয়তাবাদের আদর্শে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখলেন। রাজা রামমোহন রায়, মধুসূদন দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম প্রমুখ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীদের ব্যাপক তৎপরতায় স্বাধীনতা শব্দটি সামাজিক ভিত্তি পেতে থাকল। তখনও স্বাধীনতা ও ঔপনিবেশিক শক্তিবিরোধী রাজনীতির সাক্ষাত আমরা পাই না। বাঙালীর সংস্কৃতির এই আধুনিক ও নবতরঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আগমন একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ইতিহাস, ঐতিহ্য, পুরাণ, আধুনিকতা সকল বিষয়ের মিশেলে এক নব্য ভারতীয় বাঙালীর রূপ প্রত্যক্ষ করল বিশ্ব। রবীন্দ্রনাথের মধ্য দিয়ে আমরা প্রথমবারের মতো প্রত্যক্ষ করলাম একই অঙ্গে আধুনিক বাঙালী ও বিশ্বমানবের। রবীন্দ্রনাথের রচনায় অনেক অনেকবার বাংলাদেশ ও জাতীয়তাবাদ প্রশ্নে ব্যাপক মতবিরোধের কথাও আমরা জানি। রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় এবং এক জাতি- গান্ধীর এই তত্ত্বের বিরোধিতা করতেন এবং সঙ্গতভাবে ভারত যে বহুজাতির আবাসভূমি এ কথাও প্রমাণসহ বলেছেন।
ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, স্মৃতিসম্ভারের সমন্বয়ে জাতিসত্তার যে উদ্ভব তা বারবার উচ্চারণ করেছেন এবং সেই তত্ত্বের আলোকে বাঙালী, পাঞ্জাবী, মারাঠীসহ বিভিন্ন উন্নত জাতির উপস্থিতি মেনে একটি স্বাধীন আধুনিক ভারত রাষ্ট্র বিনির্মাণের কথা বলেছেন নির্ভয়ে এবং আমাদের এটিও স্মরণে থাকে যে, জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ এবং বহুল আদৃত ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ এই আন্দোলনের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন স্তিমিত হলো। লীগ-কংগ্রেস আন্দোলন গতি পেল। এরই মাঝে ভারতে তরুণ বাঙালী নেতা সুভাষ চন্দ্র বসুর আগমন ঘটে। বাঙালী নতুন করে স্বপ্ন দেখে। কিন্তু সুভাষ বসু জয় বাংলা নয়, বন্দে মাতরম নয়, হিন্দুস্তানের ঐক্যের কথা বিবেচনায় রেখে ‘জয় হিন্দ’কে জাতীয় সম্ভাষণ হিসেবে বেছে নিলেন। জাতিসত্তার আন্দোলন স্তিমিত হলো, ভারত রাষ্ট্রের আন্দোলন বেগবান হলো। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থান ঘটল এ সময়ে। মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের অপরিণামদর্শী রাজনীতির কারণে দুই ধর্মের মানুষদের মধ্যে সন্দেহ ও ঘৃণার সৃষ্টি হলো। ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন স্তিমিত হলো।
তারপর দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৪০-এর দশকে আমরা পুনরায় বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের একটা প্রচেষ্টা দেখি। আবুল হাশেম ও শরৎ বসুর যৌথ প্রস্তাবে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের আপত্তির কারণে তা ভেস্তে যায়। যদিও কংগ্রেসের একাংশ এই প্রস্তাবে সমর্থনও দেয়। কিন্তু জিন্নাহ প্রথমে দ্বিধান্বিত থাকলেও পরে বাংলাদেশ বিরোধিতায় সরব হয়ে ওঠেন।
হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে ১৯৪৭-এ দেশ ভাগ হলো। সৃষ্টি হলো পাকিস্তান নামক এক রাষ্ট্র এবং অন্যদিকে ভারত। বাংলাদেশের অংশ হলো পূর্ব পাকিস্তান। শুরুতেই ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের বিরোধ দেখা দিল।
বাঙালী জনগোষ্ঠীর মাত্র কয়েকমাস সময় লাগল। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে পূর্ব বাংলার বাঙালীরা সোচ্চার হয়ে ওঠে। প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তানের গনপরিষদে বাঙলাকে পাকিস্তানের অনতম রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দাবি করলেন। রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন নতুন গতি লাভ করলো। মুসলিম লীগের অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল অংশ দল ত্যাগ করে আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ গঠন করে বাঙালী জাতীয়তাবাদের পুনরুত্থান ঘটায়। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শামসুল হক এবং তরুণ রাজনীতিক শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ববাংলার জনগোষ্ঠী বাঙালী জাতিসত্তার প্রশ্নে অনড় থেকে পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্য আন্দোলন শুরু করে। ১৯৫২ সালে ভাষার প্রশ্নে জীবন দিয়ে বাংলার মানুষ তাদের চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করে। তারপর জাতিসত্তার প্রশ্নে পূর্ব বাঙালীর নেতৃত্বকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী অতি দ্রুত পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান করার ষড়যন্ত্র করলে বাঙালীর তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট পাকিস্তান গণপরিষদে বলেন, ÒWe would like to be called ourselve as `Bengali’.”

একই অধিবেশনে ১৯৫৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর অনলবর্ষী বক্তা শেখ মুজিবুর রহমান ভাষার অধিকারের প্রশ্নে বলেন, The Word `Bengali’ has a history, has a tradition of its own. You can change it only after the people have been consulted.”

তিনি জাতিসত্তার প্রশ্নে একই বক্তব্যে বলেন, “it is a very serious matter for us and here nobody can force us not to speak in our own mother language. I will will here and now, speak in Bengali and nobody can prevent me from doing that.”
তরুণ এই বাঙালী নেতা তখন ‘শেখ মুজিব’ থেকে বাঙালীর আদরের নেতা ‘মুজিবুর’ হয়ে উঠেছেন।
১৯৪৮-এ শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলনের শেখ মুজিবুর রহমানের সরাসরি নেতৃত্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রপিতা মোঃ আলী জিন্নাহর দম্ভোক্তি- Urdu-only urdu shall be the national language of Pakistan – এর বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ গড়ে তোলে। ১৯৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্কটকালে ভাষার দাবিকে ছিনিয়ে আনার জন্য জেলখানায় বন্দী অবস্থায় তার নির্দেশনা এবং এক তরুণ পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে খোদ পাকিস্তানের গণপরিষদে তার বক্তব্যসমূহ শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঙালীর আদরের নেতা ‘মুজিবুর’-এ রূপান্তরিত করেছে।
ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ ও জাতিসত্তারও প্রধান প্রবক্তা হয়ে উঠলেন তরুণ এই নেতা এবং সন্দেহ কি যে, অদূর ভবিষ্যতে এই বাঙালীর প্রিয়নেতা মুজিবুর বঙ্গবন্ধু হয়ে হাজার বছরের সংগ্রাম ও ইতিহাসের আলোকে বিশ্বকে জাতিরাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’ উপহার দেবে। কিন্তু তার জন্য যে সংগ্রাম, ত্যাগ ও তিতিক্ষার সময় এই জনপদের বাঙালী অতিবাহিত করেছে তা বর্ণনা করা এই স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। হয়তো বা শত শত পৃষ্ঠার রচনার প্রয়োজন।
তবু সংক্ষেপে এ কথা বলা যায় যে, ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে নতুন বাঙালী জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি হয় তা দমন করার লক্ষ্যে পাকিস্তান যতই নিপীড়ন চালিয়েছে বাঙালী ততই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে অনমনীয় থেকেছে।
ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি জীবনের সকল ক্ষেত্রে তখন বাঙালিত্বই অবদমিত পাকিস্তানীদের দ্বারা ততই ভাষার দাবিতে, সংস্কৃতির দাবিতে, অর্থনীতি ও গণতন্ত্রের দাবিতে বাঙালীর আন্দোলন বেগবান হয়েছে। আর শেখ মুজিব ততদিনে আন্দোলনের প্রধান নেতা হয়ে ওঠেন।
রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ, শিক্ষানীতিতে জাতিসত্তা বিলোপের ষড়যন্ত্র, সর্বোপরি অর্থনৈতিক বৈষম্য ও শোষণসহ নানা প্রশ্নে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে একটি জাতিসত্তার সার্বিক উত্থান পরিকল্পনায় তখন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ শেখ মুজিবুর রহমান একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। গঠিত হলো ‘স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস’ নতুন স্লোগানে মুখরিত হলো পূর্ব বাংলা। ‘জাগো জাগো বাঙালী জাগো’, তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা। সাংস্কৃতিকভাবে তখন বাঙালী তাদের জাতিসত্তার প্রশ্নে সম্পূর্ণ তৈরি। প্রয়োজন ছিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের। মুজিবুর সেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রকাশ করলেন- ১৯৬৪ সালে মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীতে বলেছিলেন, আজ থেকে পূর্বপাকিস্তান- বাংলাদেশ নামে অভিহিত হবে।
তিনি ড. এনামুল হক, আবুল ফজল প্রমুখ বুদ্ধিজীবীকে পূর্ব বাংলার একটি নাম ঠিক করার অনুরোধ জানান। তারা ঐতিহাসিক দিক বিচার-বিবেচনা করে কেউ ‘বঙ্গদেশ, কেউ বাংলা, কেউ বঙ্গ প্রস্তাব করেন। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তিনিই নিয়েছিলেন। আগরতলা মামলাসহ নানা নিপীড়ন-নির্যাতন-জেল-জুলুমকে তোয়াক্কা না করে প্রাজ্ঞ শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে জারি রেখেছিলেন। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাঙালী তাদের প্রিয়নেতাকে জেল থেকে মুক্ত করলেন।
হাজার বছরের ইতিহাসে এই প্রথম বাঙালী একটি জাতিরাষ্ট্রের তথা প্রজাতন্ত্রের অবয়ব দেখতে পেল। সাম্প্রদায়িক নয়-অসাম্প্রদায়িক ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জনগণের ‘বাংলাদেশ’। বঙ্গবন্ধু সভাশেষে ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ করলেন। পুরো জাতি যেন এই স্লোগানটির জন্য অপেক্ষা করছিল। শতবর্ষেও ধূলিচাদর সরিয়ে পূর্ব বাংলা যেন আবার হেসে উঠল-পুরো জাতি যেন নেচে উঠল। চুয়ান্ন হাজার বর্গমাইলের সাত কোটি মানুষের কণ্ঠে নিনাদিত হলো ‘জয় বাংলা’। ১৯০৬-এর ‘জয় বাংলা’ নতুনরূপে নতুন মানুষের কণ্ঠে উচ্চারিত হলো ১৯৭০-এ। ইতিহাসের এই এক অমোঘ রায়।
তারপরের ইতিহাস তো সবারই জানা। জয় বাংলা বলে বাঙালী ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করল। হাজার বছরের ইতিহাসে এই প্রথম বাঙালী তার নিজস্ব রাষ্ট্রের সন্ধান পেল। প্রজাতন্ত্রের মালিক হলো। ষষ্ঠ শতাব্দীতে যে ‘স্বাধীন বঙ্গ’ সৃষ্টি হয়েছিল সে তো সাম্রাজ্য। রাজার দেশ, সম্রাটের দেশ। জনগণের দেশ নয়। প্রজাতন্ত্র নয়। দেশের মালিক রাজা বা শাসকবর্গ, জনগণ নয়। ১৯৭১-এ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে বাংলাদেশ আমরা পেলাম তা জনগণের রাষ্ট্র। যে জয় বাংলা দিয়ে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন শুরু হয় সেই জয় বাংলা পরিণতি পায় পূর্ব বাংলার ‘বাংলাদেশ’ হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে।
তারপর স্বাধীন রাষ্ট্রের পথচলা দুর্গম রাস্তায়। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সাম্প্রদায়িক শক্তির ষড়যন্ত্রে যেন জয় বাংলা ও বাংলাদেশ প্রায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। পরাজিত শক্তির প্রধান শত্রু তখন জয় বাংলা ও মুজিব। তাই আমরা দেখব ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে প্রথমেই ঘাতকরা আঘাত হানে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনির ওপর। কেননা জানে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনির মধ্যে রয়েছে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, সংগ্রাম, ইতিহাস। ভবিষ্যতের জাতিরাষ্ট্রসমূহের প্রেরণা।
তাই ১৯৭৫-এর পর থেকে আমরা দীর্ঘ সময় দেখি রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘জয় বাংলা’র নির্বাসন। যদিও বর্তমানে খণ্ডিতভাবে ‘জয় বাংলা’ ফিরে এসেছে। এই খণ্ডিত প্রত্যাবর্তন যে দ্বিধার প্রকাশ ঘটিয়েছে সেই দ্বিধার সুযোগে একাত্তরের পরাজিত ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তি পুনরায় স্বাধীন দেশে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বিকাশে দেশের প্রায় সকল মানুষ যখন বাঙালীর অসাম্প্রদায়িক উৎসব ও সংস্কৃতির উদযাপন করছে তখন এই অপশক্তির ভয়ঙ্কর রূপ আমরা দেখছি। জঙ্গী হামলার মদদ দিয়ে এই শক্তি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। সম্প্রতি পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে এই সাম্প্রদায়িক শক্তি ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। বিভিন্ন ধর্মসভায় ঘৃণা উদ্রেককারী ফতোয়া দিচ্ছে। মঙ্গল শোভাযাত্রা ও নববর্ষ পালনকারীদের বিধর্মী বলে চিহ্নিত করছে। বহুমাত্রিক বাঙালী সংস্কৃতিকে নির্বাসন দিয়ে এরা এক ধর্ম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সর্ব আয়োজন সম্পন্ন করছে। আদালত প্রাঙ্গণে বিচারের প্রতীক স্থাপত্য মূর্তি বলে দাবি করে এর অপসারণ করার হুমকি দিয়েছে। ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছে। সরকার দুঃখজনকভাবে এই ধর্মান্ধ-মৌলবাদীদের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করছে।
কিন্তু আমরা মুক্তিযোদ্ধারা, সংস্কৃতি কর্মীরা আপস করবো না, সমঝোতা করবো না, হার মানবো না। এই দেশ আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত ও ৩০ লাখ শহীদের জীবনের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছে। বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের শক্তিতে লড়াই জারি আছে। অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতিই বাঙালীর জীবনীশক্তি। এই শক্তিতেই আমরা জয়ী হব শেষ অবধি। আমাদের এই মহা সঙ্কটকালে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে নির্ভীক হাঁটব আমরা। জয় বাংলা থেকে জিন্দাবাদে ফিরে যাব না কোনদিন। মৌলবাদকে চূড়ান্তভাবে নির্বাসিত করে আমরা সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠিত করব। জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।

(বক্ষমান রচনাটি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট-এর সেমিনারে উপস্থাপিত প্রবন্ধের পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ)