• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ১১:৪৮ পূর্বাহ্ন

জাতীয় নির্বাচনের অতীত ইতিহাস


প্রকাশের সময় : মার্চ ৬, ২০২২, ৮:১৫ PM / ৫৪
জাতীয় নির্বাচনের অতীত ইতিহাস

মোঃআজিজুল হুদা চৌধুরী সুমন : আজকাল কিছু উদয়ন পণ্ডিত বলাবলি করছেন – দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব – আসুন জানি,বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাস কি বলে?

স্বাধীনতার পর প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো ৭ই মার্চ ১৯৭৩ সালে এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৮২ আসনে পেয়ে জয়ী হয়।আওয়ামী লীগের ছাত্রলীগ ভেঙে সিরাজুল আলম খানের তৈরি করা জাসদ বিরোধী দল হিসেবে ২৩৭ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ১(একটি) আসন পায়।

দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ সালে এই নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ২০৭ আসনে পেয়ে জয়ী হয়।আওয়ামী লীগ ৩৯টি আসন পেয়ে স্পিকার আঃ মালেক উকিল আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির লীডার নির্বাচিত হন এবং জিয়াউর রহমানের আমলে সংসদে বিরােধী দলের নেতার দায়িত্ব পালন করেন।

তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৭ই মে ১৯৮৬ সালে এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ১৫৩টি আসন নিয়ে জয়ী হয়।আওয়ামী লীগ ৫৭টি আসনে পেয়ে শেখ হাসিনা বিরােধী দলীয় নেতার দায়িত্ব পালন করেন।

চর্তুথ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৩রা মার্চ ১৯৮৮ সালে এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ২৫১টি আসন নিয়ে জয়ী হয়।এই নির্বাচনটি বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রধান দলই বর্জন করেছিল; যেমন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (মুজাফ্‌ফর) এবং বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি নির্বাচন বর্জন করলেও আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জাসদ তখন নির্বাচনে গিয়েছিল এবং রব বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন। জাসদকে তখন নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলো ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ বলে অভিহিত করে।

বাংলাদেশে প্রথম কেয়ারটেকার সরকারের অধিনে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ সালের এই নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ১৪০টি আসন নিয়ে জয়ী হয় এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৮৮টি আসনে জয়লাভ করে।ঐ নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে বলে আওয়ামী লীগ ক্ষীণ আপত্তি জানালেও নির্বাচনী ফলাফলকে মেনে নিয়ে সংসদে বিরােধী দলীয় নেতার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

মাগুরা জেলার মুহাম্মদপুর আসন থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ এমপি’র মৃত্যুতে শূন্য ঐ আসনটিতে ১৯৯৪ সালের এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে বিএনপি সরকার আসনটি দখল করে নেয়। এর প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত নেয় যে,বিএনপি সরকারের পরিচালনায় আর কোন উপনির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না।

ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালে এই নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ২৮৯টি আসন নিয়ে জয়ী হয় , বাংলাদেশ ফ্রিডম পার্টি ১টি ও সতন্ত্র থেকে ১০ জন নির্বাচিত হন।এ সংসদে কোন বিরোধী দল ছিল না।

অধিকাংশ প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল নির্বাচনটি বর্জন করেছিল।১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ ১২ দিন পর বিরোধী রাজনৈতিক দলের হরতাল অবরোধের ফলে সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়।বিএনপি কেয়ারটেকার সরকার আইন পাস করে কেয়ারটেকার সরকার কায়েমের সুযােগ করে দেয়।

সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১২ জুন ১৯৯৬ সালে এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪৬টি আসন নিয়ে জয়ী হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ১১৬ টি আসন পায়,জাতীয় পার্টি ৩২ আসন পায়, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ৩ আসন পায়, ইসলামী ঐক্য জোট ১ আসন পায়, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ১ আসন পায়। আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ না হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয় এবং জাতীয় পার্টির সমর্থনে ক্ষমতাসীন হয়।কেয়ারটেকার সরকার আন্দোলনের সুযােগ না পেলে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ী হওয়ার কোন সম্ভাবনাই ছিলাে না।

 

অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১ অক্টোবর ২০০১ সালে এই নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ১৯৩ আসন নিয়ে জয়ী হয়, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৬২ আসন পায়, ইসলামী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ১৪ টি আসন,বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ১৭ টি আসন,বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি ৪ আসন, ইসলামী ঐক্যজোট ২ আসন,কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ১ আসন,জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) ১ আসন পায়- নির্বাচনের দিন আওয়ামী লীগ সাংবাদিকদের নিকট সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন যে, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনী ফলাফল প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথেই আওয়ামী লীগ ফলাফলকে প্রত্যাখ্যান করে স্কুল কারচুপি’ হয়েছে বলে অভিযােগ করেন। নির্বাচিত সদস্য হিসেবে শপথ নেবেন না বলে ঘােষণা করেন। বিলম্বে হলেও শেষ পর্যন্ত শপথ নেন বটে, কিন্তু এক বছর পর্যন্ত তার দলীয় সদস্যদেরকে সংসদে যেতে দেননি।আওয়ামী লীগ নির্বাচনে তাদের দলকে পরাজিত করার জন্য পরিকল্পিতভাবে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে বলে দাবি করেন। তারা প্রেসিডেন্ট বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদ,কেয়ারটেকার সরকারপ্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এম এ সাঈদ, সেনাপ্রধান ও পুলিশপ্রধানকে ষড়যন্ত্রের জন্য দায়ী করেন।

২০০২ সাল থেকেই আওয়ামী লীগ জোট সরকারের পদত্যাগ দাবি করে আসছেন। ২০০৪ সালের মার্চ মাসে তার দলের পক্ষ থেকে দলের সাধারণ সম্পাদক ঘােষণা করলেন যে, ৩০ এপ্রিলের মধ্যে বেগম জিয়া পদত্যাগ করতে বাধ্য হবেন। গত ৩ অক্টোবর (২০০৪) পল্টন ময়দানের মহাসমাবেশে তিনি বেগম জিয়াকে পদত্যাগ করে নতুন নির্বাচন দেবার দাবি জানান।

প্রশ্ন হলাে, বর্তমান আওয়ামী যে বয়ান দিচ্ছে সেই একই বয়ান বিএনপি দিয়েছিল তারা বলেছিলো, আবার নির্বাচন হলেই আওয়ামী লীগ কে ক্ষমতাসীন হবার নিশ্চয়তা কে দেবে?যদি আওয়ামী লীগ বিজয়ী হতে না পারেন তাহলে আবার তিনি নির্বাচনী ফলাফল প্রত্যাখ্যান করবেন। আওয়ামী লীগ কে বিজয়ী করার যােগ্য প্রেসিডেন্ট, কেয়ারটেকার সরকার প্রধান,নির্বাচন কমিশন প্রধান, সেনা ও পুলিশ প্রধান তারা কেমন করে যােগাড় করবেন?সুতরাং নতুন করে নির্বাচনে কেমন করে তাদের বিজয় নিশ্চিত হবে?

কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত উক্ত নির্বাচন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ, অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে বলে দেশী ও বিদেশী সকল নির্বাচন পর্যবেক্ষক মযবুত সার্টিফিকেট দিয়েছে।

ব্যালট ডাকাতি করে চারদলীয় জোট বিজয়ী হয়েছে বলে একমাত্র আওয়ামী লীগ বার বার তাদের বক্তৃতায় বলেছিলো।

 

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ সালে এই নির্বাচনের আগে আওয়ামী ও এরশাদের জাতীয় পার্টি সহ চৌদ্দদলীয় মহাজোট গঠন করে, অন্যদিকে বিএনপি জামায়াতে ইসলামী দল সহ চারদলীয় জোট গঠন করে।এই নির্বাচনে মহাজোট ২৬৩ আসন নিয়ে জয়ী হয়
চারদলীয় জোট জাতীয়তাবাদী ৩৩ টি আসন নিয়ে বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন করে।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালে।এই নির্বাচনের আগে ৩০শে জুন ২০১১ সালে তত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাশ হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সহ মোট ২৩৪ আসনে বিজয়ী হয়,জাতীয় পার্টি ৩৪ টি আসন, ওয়ার্কার্স পার্টি ৬ টি আসন, জাসদ-ইনু ৫ টি আসন, জাপা-মঞ্জু ২ টি আসন,বিটিএফ ২ আসন, বিএনএফ ১ আসন, স্বতন্ত্র ১ আসন পায় -এ নির্বাচনটি নবম জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অধিকাংশ দলই বর্জন করে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ সালে মহাজোট ২৭৯ আসন নিয়ে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ ২৫৯ মহাজোটের শরীক দল জাতীয় পার্টি ২০ আসন দেওয়া হয়, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ২ আসন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ৩ আসন,বিকল্পধারা বাংলাদেশ ২ আসন
জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) ১ আসন,বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন ১ আসন,ঐক্য ফ্রন্ট থেকে নির্বাচিত গণফোরামের ২ জন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি কে ৫ আসন দেওয়া হয় আর সংসদে প্রধান বিরোধী জাতীয় পার্টি।

অতীতের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন কখনো সম্ভব না।