• ঢাকা
  • শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০২:১৪ পূর্বাহ্ন

গ্রামের মানুষ বলতেই সহজ-সরল নয় …


প্রকাশের সময় : ফেব্রুয়ারী ১২, ২০২২, ১১:৪৬ AM / ৩৮
গ্রামের মানুষ বলতেই সহজ-সরল নয় …

সোনিয়া দেওয়ান প্রীতি : ছোটবেলা থেকে বইয়ে পড়েছিলাম-‘গ্রামের মানুষ খুব সহজ সরল আর অতিথিপরায়ন সহ আরও কত কত পজেটিভ হয়….’। তবে একান্ত ব্যক্তি অভিজ্ঞতা হয়েছে ভিন্ন। আমাদের বিয়েটা প্রেমের বিয়ে নয়, বরং প্রেম হয়েছে বিয়ের পরে। অর্থাৎ মেয়ে দেখা থেকে শুরু করে এ বাড়ি ওই বাড়ি দেখা সহ সকল নিয়ম মেনে নানা জটিলতার পরে অবশেষে এরেঞ্জ ম্যারেজ। তবে লোকটা তার বাবা মায়ের পছন্দে নয়, বরং বাবা মা আত্মীয় স্বজনকে নানা কৌশলে রাজি করিয়ে নিজের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করেছে। কিন্তু তবুওতো প্রবাসী উপার্জনক্ষম ছেলের পছন্দকে প্রাধান্য দিতে নিজেদের পছন্দ না হওয়া মেয়েকে বৌ করে আনার কষ্টটাতো তাদের দৈনন্দিন আচরণে বের হতেই পারে। পৃথিবীর সব মানুষ তো আর সহজ বিষয়কে সহজে মেনে নিতে পারেনা। গ্রামের মানুষ বলতেই যে সবাই একচেটিয়াভাবে সহজ আর সরল নয়, তা গ্রামে বৌ হয়ে গিয়ে প্রথম বুঝেছিলাম সবার নেগেটিভ আচরণে। সময়ের সাথে সাথে নিজেই শিখে নিয়েছিলাম- বাড়ির কাজের বুয়ার সামনে নতুন বৌকে তার গায়ের শ্যামলা রং আর যৌতুক না নিয়ে আসার জন্য কটু কথা বলার পরেও কিভাবে সেই কটুকথা বলা মুরব্বি নারীর বুকে ঝাপিয়ে পরে তার গালে চুমু দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে হয়। ধীরে ধীরে নিজের সরলতা আর ভালোবাসা দিয়ে এভাবেই প্রায় সবার মনে জায়গা করে নিয়েছি। তবে নিজের জন্য একেবারেই ভিন্ন এ পথটা অতোটা সহজ ছিলনা, যতটা সহজে দু’কলম লিখে ফেললাম। নিজের সোসাইটিতে আদর, যত্ন আর সম্মানের সাথে থাকা এবং সেই সময় পেশাগত জায়গায় ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্টে থাকা অবস্থায় সমস্ত কিছুকে পেছনে ফেলে এবং অসংখ্য নির্যাতিত নারীদের পাশে দাঁড়ানো মানুষটাকে একটা ভিন্ন পরিবেশে গিয়ে প্রতিনিয়ত অসম্মান আর কটু কথার মাঝে প্রতিটা দিন প্রতিটা রাত পাড় করার যে মানসিক যন্ত্রণা তা উৎরে উঠে টিকে থাকতে পেরেছি বলেই আজ সবাইকে নিয়ে সংসার জীবন সুন্দর হয়েছে বলে মনে করি। আমার শাশুড়ি মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমার বন্ধুর মতো ছিলেন। ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য সে আমার কাছেই থাকতেন। তাকে নিজ হাতে গোসল করানো, খাওয়ানোর পাশাপাশি তার মনকে উৎফুল্ল রাখতে সাজিয়ে গুছিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, শপিং করে দেয়া, সে সুস্থ হয়ে যাবে বলে বলে তার মানসিক শক্তি বাড়ানো, আবার যখন একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে গেলো, তখন তার মলমূত্রাদি নিজ হাতে পরিষ্কার সহ সব করার চেষ্টা করেছি নিজের সাধ্য অনুযায়ী। আমিতো শহরের শিক্ষিত ও পেশাগতভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত একজন মেয়ে। প্রশাসনের লোক থেকে শুরু করে মাদক ব্যবসায়ী, অপরাধী অনেকেই আমার লেখনীকে ভয় করে। কই, আমি পারতাম না আমাকে কটু কথা বলা কিংবা আমার সাথে বাজে আচরণ করা লোকজনকে শায়েস্তা করতে? পারতাম না সমস্ত সম্পত্তির মালিক আমার শাশুড়ির সকল সম্পত্তি কৌশলে নিজের নামে লিখে নিতে? আসলে পারিবারিক শিক্ষা এবং নিজের মনুষ্যত্ব আমাকে যে কোনো পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার সক্ষমতা দিয়েছে এবং সবচেয়ে বেশি সক্ষমতা দিয়েছে সব কিছুকে পজেটিভ দৃষ্টিতে দেখার। আজকের মূল কথা আসলে এখনও শুরু করিনি। শাশুড়ি মারা যাওয়া এবং নিজের স্ট্রোক সহ নানা ঝামেলা শেষে সেদিন শশুরের অবস্থা খারাপ শুনে গ্রামের বাড়ি যাবার পর জেঠি শাশুড়ি মারা গেলো। যে মানুষটিকে বিয়ের পর থেকে এত বছর নিজের ঘরেই দেখেছি, সেই বয়সের ভারে ন্যুইয়ে পরা মানুষটির লাশ আসতে দেখলাম ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে। এরপর তার লাশের কাছে একমাত্র পুত্রবধূকে কেউ আসতে দিচ্ছিলো না, এই নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড! শেষে জানলাম- বয়সের ভারে বিছানায় শয্যাশায়ী জেঠিকে তার মেয়েরা নিয়ে গিয়েছিল। কারণ, আমার মৃত জেঠা শশুরের স্ত্রী হিসেবে তার নামে যে ২ আনা সমতুল্য সামান্য জমিখানা ছিল, তার শারীরিক দুর্বলতার সুযোগে তার একমাত্র ছেলের বৌ কৌশলে নিজের নামে লিখিয়ে নিয়েছে। অথচ তার ছেলে প্রবাসে থাকা অবস্থায় ছোট ছোট দুই নাতি নাতনি সহ ছেলের বৌ অন্য লোকের সাথে বিয়ে করে চলে যাওয়ার পর খুব শখ করে এই ভদ্র মহিলাকে বিয়ে করিয়ে এনেছিল সে এবং তার মেয়েরা। মোটামুটি বয়স্কা এই ছেলের বৌ তখন তার সাবেক মৃত স্বামীর ঔরসজাত দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে নানী হয়েছে। সে গ্রামের মেয়ে, লেখাপড়া করার সুযোগ হয়নি হয়ত। সাবেক স্বামীর মৃত্যুতে পরনির্ভরশীল তথা নিজের ভার উত্তলনে অক্ষম নিরূপায় মহিলাটিকে তাই সবাই পড়ন্ত সময়ে একটা মাথা গুজার ঠাঁই করে দিয়েছিল বিয়ের মাধ্যমে। কিন্তু তার বুদ্ধি তার বিবেক কত নিম্ন শ্রেণীর ভাবুন! সে কত দুঃসাহসিকতার সহিত একটা গ্রামের মধ্যে বসে থেকে সবার অগোচরে কত বড় একটা ক্রাইম করে ফেলল! আসলে ‘গ্রামের মানুষ বলতেই যে সহজ সরল নয়’- বইয়ের ভাষার বাইরে তা আবার বুঝলাম। এমন আরও অনেক উদাহরন আছে আমার বাস্তব অভিজ্ঞতায়। সব লিখতে গেলে মাসের পর মাস যাবে, লেখার শেষ হবে না। পুঁথিগত শিক্ষা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। আসলে গ্রাম কিংবা শহর বলে কথা নয়, আমরা কতটা মানুষ হবো আর কতটা অমানুষ হবো তা নির্ভর করে আমাদের পারিবারিক শিক্ষা, নৈতিক শিক্ষা ও মনুষ্যত্বের উপর। মহান আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে সঠিক পথে চলার তৌফিক দিক।