• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ০৬:৪৬ অপরাহ্ন

২ বছর ৪ মাসে সৌদি থেকে ঢাকায় ফিরেছে ১৯৫৭টি লাশ!


প্রকাশের সময় : জুলাই ২, ২০১৮, ৬:০১ PM / ৬৫
২ বছর ৪ মাসে সৌদি থেকে ঢাকায় ফিরেছে ১৯৫৭টি লাশ!

আকবর হোসেন, ঢাকা : হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে গত দুই বছর চার মাসে সৌদি আরব থেকে ১ হাজার ৯শ’ ৫৭ টি মৃতদেহ ঢাকায় এসেছে বলে জানিয়েছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়।

সম্প্রতি নির্যাতনের শিকার হয়ে সৌদি আরব ফেরত কয়েকজনের অভিযোগ, শ্রমিক ভিসা নিয়ে যাওয়া মানুষদের উপর চলে অমানুষিক নির্যাতন, তাদের হত্যা ও গুম করা হয়। তবে অমানুষিক নির্যাতন, হত্যা ও গুমের বিষয়ে তেমন কোন তথ্য নেই বলে দাবি করেছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, গত দুই বছর চার মাসে ৮ লাখ ৩ হাজার ১৫৬ জন প্রবাসী ভিসা নিয়ে সৌদি আরব গেছেন। তবে নিখোঁজ, অত্যাচারের শিকার বা ভিসার মেয়াদ শেষ এবং অন্যান্য কারণে ফিরে আসা মানুষের সংখ্যা তিনি জানাতে পারেন নি।

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের সহকারী পরিচালক (আইপিআর) জাহিদ আনোয়ার জানান, গত দুই বছর চার মাসে ১ হাজার ৯ শ’ ৫৭টি মরদেহ ঢাকায় এসেছে। এ ছাড়া বিদেশেও কিছু সংখ্যক প্রবাসীর দাফন হয়। সেই সংখ্যা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জানা নেই। এছাড়া চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে আসা মরদেহ সংখ্যা জানাতে পারেননি তিনি।

তিনি আরো বলেন, নিহত কর্মীর নিয়োগ কর্তা খুঁজে না পেলে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড লাশগুলো দেশে ফিরিয়ে আনে। এসময় লাশের সাথে পরিবারের কাছে ৩৫ হাজার টাকা এবং ২ মাসের মধ্যে ৩ লাখ টাকা অনুদান দেয়া হয়। পরে বকেয়া বেতন, ইন্সুরেন্সের টাকা, দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে মামলা পরিচালনা করা হয় এবং প্রাপ্ত অর্থ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

অধিকাংশের মৃত্যুর কারণ স্ট্রোক, হৃদরোগ, দুর্ঘটনা, অসুস্থতা, খুন, সড়ক দুর্ঘটনা, কর্মস্থলে দুর্ঘটনা বলে জানান তিনি।

এদিকে প্রবাসী বাংলাদেশি মৃতদের স্বজনরা বলেন, বিভিন্ন কারণে প্রবাসী বাংলাদেশিরা স্ট্রোক ও হৃদরোগে আক্রান্ত হন। যে বিপুল টাকা খরচ করে বিদেশে যান, সেই টাকা তুলতে অমানুষিক পরিশ্রম করেন তারা। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে থাকা, তারা দীর্ঘদিন স্বজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা এবং সব মিলিয়ে মানসিক চাপে ভোগেন।

মৃত ব্যক্তিদের তালিকা থাকলেও, কী কী কারণে বিপুল সংখ্যাক প্রবাসী শ্রমিক নির্যাতনের শিকার বা মারা গেছে সে সর্ম্পকে তেমন কোন তথ্য দিতে পারেননি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তবে বেশ কিছু ভুক্তভোগী এবং তাদের পরিবারের সাথে কথা বলে উদ্বেগজনক নানান তথ্য জানা গেছে।

দেড় বছরের সন্তান রেখে সৌদি আরব গিয়েছিলেন নওগাঁ স্টেডিয়ামপাড়ার গাফফার শেখের মেয়ে লতা শেখ ছোঁয়া।

তিনি জানান, দুই জন দালাল রাজধানীর বানানীতে অবস্থিত আল-মনসুর ওভারসের্স অ্যান্ড ট্র্যাভেলসে তাকে নিয়ে আসে। তারা মেডিক্যাল ক্লিনার ভিসা দিয়ে তাকে সৌদি আরব পাঠায়। সেখানে গিয়ে দেখেন গৃহশ্রমিক ভিসা দেয়া হয়েছে। সৌদি আরবে কুরবানির পশুর বাজারের মতো একটি নারীদের বাজার রয়েছে, যেখানে তাকে তোলা হয়। পরে দাম্মামের এক বাড়ি মালিক তাকে কিনে নিয়ে যায়। ওই বাড়িতে পৌঁছানোর পর দুই দিন তারা তাকে খেতে দেয় নি। খাবার চাইলে বাড়ির লোকজন মারধর করেছে। এতে অসুস্থ হলে হাসপাতালে নিতে অনুরোধ করলে উল্টো টাকার কথা বলেছেন তারা।

এক পর্যায়ে তার অবস্থা খুব খারাপ দেখে কোম্পানি ক্যাম্পে পাঠান বাড়ির মালিক। কিন্তু সেখানে ড্রামা (নাটক) করছে বলে অত্যাচার শুরু করে ক্যাম্পের দায়িত্বশীলরা। পরে তারা ৫০ রিয়াল দিয়ে হাসপাতালে পাঠায়। চিকিৎসকরা স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার কথা বলেন, কিন্তু রিয়াল না থাকায় তা সম্ভব হয়নি। পরে দাম্মামের আল খোবার এলাকার এক নম্বর ক্যাম্পে আরো আট জনের সাথে তার ঠাঁই হয়। দিনে একবার সেদ্ধ আলু বা ময়লাযুক্ত তেলাপিয়া মাছ খেতে দেয়া হয়। পায়খানা-প্রস্রাব করতে ক্যাম্পের টয়লেট ব্যবহার করতে দেয়া হয় না তাদের। এছাড়া চলে নানা রকম অত্যাচার।

তিনি আরো বলেন, কিছু দিন আগে ক্যাম্পের লোকজন এক নারীর একটি স্তন কেটে নিয়েছে। এরপর তাকে হত্যা করা হয়। ওই লাশটি আরো তিন মাস পরে বাংলাদেশে পাঠানো হবে বলে শুনেছি। সেখান থেকে নারীদের গুমও করা হয় বলে শুনেছি। কারো সাথে কথা বলতে দেখলে অত্যাচারের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় তারা। আমাদেরও গুম করার চেষ্টা চলছিল। কিন্তু সোনিয়া দেওয়ান প্রীতি আপার (সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী) চেষ্টায় তা তারা করতে পারেনি। তবে দেশে আসার আগে কোম্পানির লোকজন স্থানীয় সময় ২৩ মে দুপুর ২টায় আমাদের বাধ্য করে কোম্পানির প্রশংসা করে একটি ভিডিও করতে। পরে ২৪ তারিখ দেশে ফিরেছি। এর আগে তারা আমাদের কাগজপত্র ছিনিয়ে নেয়।

ছোঁয়ার অনুরোধ দেশে ভিক্ষা করে খেতে হলেও যেন আর কেউ বিদেশ না যায়।

সৌদি আরবে গৃহকর্মীর কাজে গিয়ে ৭ মাস ধরে নিখোঁজ হন নারায়ণগঞ্জ বন্দরের নবীগঞ্জ বাগবাড়ী এলাকার স্বর্না আক্তার (২৬)।

স্বর্নার আত্মীয় মহিউদ্দিন সিদ্দীকি জানান, মৃত আফজাল মিয়ার মেয়ে স্বর্না আক্তারকে একই এলাকার সাঈদ মিয়ার স্ত্রী দালাল সেলিনা বেগম উচ্চ বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে ২০১৭ সালের নভেম্বর ২১ ফকিরাপুল এলাকার মেসার্স এম.এইচ.ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের (লাইসেন্স নং ১১৬৬) মাধ্যমে সৌদি আরব পাঠায়। বিদেশে পৌঁছে স্বর্না আক্তার বাড়িতে ফোন দিয়ে পৌঁছানোর কথা জানায়, তারপর থেকে তার ঠিকানা বা কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।

মানবাধিকার কর্মী সোনিয়া দেওয়ান প্রীতি বলেন, গত ৭ মাস ধরে স্বর্ণার কোনো খোঁজ পাচ্ছিল না তার পরিবার। দালাল সেলিনা মাসুদ ও এজেন্সি মালিক মকবুল নানা টালবাহানা করতে থাকে। এরই মধ্যে স্বর্ণাকে ফিরিয়ে আনতে ‘জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো’ বরাবর লিখিত অভিযোগ করা হয়। এজেন্সি কে ৩০ মে’র মধ্যে স্বর্ণাকে দেশে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দেয় ‘জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো’। কিন্তু এরপরও এজেন্সির পক্ষ থেকে কোনো ধরনের আশ্বাস পাচ্ছিল না পরিবারটি। শেষে গত ১০ জুন সন্ধ্যায় স্বর্ণার পরিবারকে সাথে নিয়ে মেসার্স এম এইচ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল-এর মালিক মকবুল সাথে দেখা করলে নানা নাটকীয়তার পর তারা এক পর্যায়ে স্বর্ণার সাথে মোবাইল ফোনে কথা বলিয়ে দেন। কিন্তু তারা মেয়েটির ঠিকানা জানায় নি। এরপর আমরা সরকারি-বেসরকারি ও মিডিয়ার সহযোগিতা নিয়ে বিভিন্নভাবে চাপ সৃষ্টির পর এজেন্সি কর্তৃপক্ষ গত ৩০ জুন দিবাগত রাত ৪টার ফ্লাইটে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনে স্বর্ণাকে। এরপর স্বর্ণার পারিশ্রমিক হিসেবে প্রাপ্ত ৯০ হাজার টাকা স্বর্ণা ও তার পরিবারের হাতে তুলে দেন তারা।

মেসার্স এম এইচ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল-এর মালিক এ বিষয়ে কোন কথা বলতে চাননি।

অপরদিকে, বনানীর আর মনসুর ট্র্যাভেল এন্ড ওভারসিস কোম্পানির পক্ষ থেকে দালাল তারেক ১৮ ও ২৪ মে সৌদি থেকে ফিরে আসা ৯ নারীকে নানা ভাবে হুমকি ধামকি দিয়ে তাদের কাছ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার করে টাকা দাবি করছে।
তবে ওই এজেন্সির মালিক শাহ ইমরানের কার্যালয়ে গিয়ে পাওয়া যায়নি। এছাড়া তার ফোন নাম্বারে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। এমনকি তার কার্যালয়ের কেউ সন্ধান দিতে চাননি।

ব্র্যাক মাইগ্রেশন সেন্টার জানিয়েছে, শুধু সৌদি আরবের জেদ্দা বিমানবন্দর থেকে প্রতি মাসে গড়ে ২৩০ জন প্রবাসী বাংলাদেশে ফিরে আসেন।

এদিকে এবিষয়ে কথা বলার জন্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নমিতা হালদারের কার্যালয়ে গিয়ে পাওয়া যায়নি।

গত ২৪ মে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফিরে আসা ৪ নারী গৃহ শ্রমিককে বুকে টেনে নেয়া সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী সোনিয়া দেওয়ান প্রীতি বলেন, আমি যেটুকু করেছি বিবেকের তাড়নায় করেছি। তবে সরকারের এ সব বিষয়ের উপর নজর দেয়া উচিত।

মানবাধিকারকর্মী ও রাজনীতিবিদ সুলতানা কামাল বলেন, যে সমাজে বাংলাদেশি গৃহকর্মীদের সাথে এমন আচরণ করা হচ্ছে; তা বন্ধ করার দায়িত্ব তাদেরও। তাদের সাথে যে আচরণ করা হচ্ছে, তা সভ্যতার মধ্যে পড়ে না। এটা অসংস্কৃত-অসভ্য আচরণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন। সেখানে কি পরিমাণ সাহায্য সহযোগিতা করা হয় তা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। তবে যতটুকু খবর পাওয়া যায় তাতে মনে হয় তাদের সংরক্ষণের কার্যকর ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। এরফলে নির্যাতন করেও ওই দেশের মানুষগুলো পার পেয়ে যাচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, অচিরেই এসব ভালোভাবে দেখা ও তদন্ত করা উচিত। সৌদি আরবের সাথে বাংলাদেশের যে গৃহকর্মী পাঠানো চুক্তি হয়েছে; তা অনতি বিলম্বে বাতিল করা হোক।

(ঢাকারনিউজ২৪.কম/এএইচ/এসডিপি/৫:৫৫পিএম/২/৬/২০১৮ইং)