• ঢাকা
  • শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০৮:২৫ অপরাহ্ন

সৌদিতে নারী গৃহকর্মীদের নিরাপত্তার দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারকেই নিতে হবে


প্রকাশের সময় : সেপ্টেম্বর ৬, ২০১৮, ৩:১০ PM / ৭৩
সৌদিতে নারী গৃহকর্মীদের নিরাপত্তার দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারকেই নিতে হবে

সোনিয়া দেওয়ান প্রীতি : অর্থ উপার্জন করে সাবলম্বি হবার আশায় বিদেশ-বিভূইয়ে পাড়ি জমানো ঝুমুর, সেতারা, সুফিয়া, নাজমা, মাজেদা, সালমা’রা প্রাণপণ লড়াই করে যাচ্ছে অন্তত বেঁচে দেশের মাটিতে ফেরার জন্য। কি আকুতি, কি করুণ ও নির্দয় অবস্থা তাদের তা একবার চোখে না দেখলে, তাদের সাথে কথা না বললে বোঝার উপায় নেই। তাদের মতো আরো অন্তত ৫০ থেকে ৬০ জন বাংলাদেশী নারী গৃহশ্রমিক হাফারবাতানি এলাকার হামেল থানায় আশ্রয় নিয়েছে। দাম্মাম থেকে প্রায় সাড়ে ৪শ’ কিলোমিটার দুরে কুয়েত বর্ডারের কাছাকাছি তাদের এ অবস্থান। এদের মধ্যে সেতারা ও সুফিয়া সম্ভবত মরার পথে। সৌদিতে গৃহকর্তার দ্বারা অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়ে এসব নারীর স্থান হয়েছে এখানে। বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন দেশ থেকে সবাই তারা গৃহ শ্রমিকের কাজে গেছে অনেক আশা ও সাবলম্বী হবার স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু সেই স্বপ্নের সাগরে ঝড় তুলে এদের কাউকে অমানুষিক নির্যাতনের পর সৌদির পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে গেছে মালিক, কেউ কেউ নির্যাতনের শিকার হয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় শুধুমাত্র প্রাণ নিয়ে বাঁচার আশায় নিজেরাই পুলিশের কাছে ছুটে এসেছে আশ্রয়ের জন্য। কিন্তু সৌদি আরবের এই আশ্রয়স্থলও কি তাদের জন্য নিরাপদ? না, কোনোভাবেই নিরাপদ নয়। দালাল-এজেন্সি থেকে শুরু করে, দূতাবাস কতৃপক্ষ কেউ নেই তাদের সাহায্যে। অথচ তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব সেখান অবস্থানরত বাংলাদেশ সরকারের নিযুক্ত কর্মকর্তাদের। কিন্তু সচিত্র তথ্য দেখেও তারা বরাবরই বিষয়গুলো এড়িয়ে যেতে চান। রাতটাকে তারা দিন বলে জোড়পূর্বকই চালিয়ে দিতে চান।

৪ সেপ্টেম্বর নাকি তাদের মধ্য থেকে আরো ৩০ জনকে দাম্মাম শহরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে দেশে পাঠানোর উদ্দেশ্যে। কিন্তু দেশে না পাঠিয়ে তাদের উপর চলছে আরো অমানুষিক নির্যাতন। রুখবে কে এ জাহান্নামকে? বাংলাদেশ সরকার কি এখনো এজেন্সিগুলোর সাথে বসে এই বৃহত্তর সমস্যার সমাধানে কোনো যুগপোযুগি সুষ্ঠু পদক্ষেপ নিতে পারেনা? অনেকেই কটাক্ষ করে বলে থাকেন- এরা খারাপ নারী, এরা কেনো যায় বিদেশে? তাদেরকে বলব- একবার চলুন আমার সাথে, দেখুন কতটা দারিদ্রের মাঝে তাদের পরিবারের বাস। কি খায় তারা, কি পরিধান করে তারা। এদের কেউ কৃষক/দিনমজুর/অসুস্থ্য শয্যাশায়ী অক্ষম স্বামী/পিতার স্ত্রী/কন্যা। যাদের ঘরে একাধিক সন্তান রয়েছে, রয়েছে বৃদ্ধ বাবা মা। তাদের পেটে দু’মুঠো অন্ন তুলে দিতে, লজ্জা ঢাকতে শরীরে কাপর তুলে দিতে এই নারীরা সৌদি আরবের মতো নবী করিম হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর দেশে পাড়ি জমায় অন্তত ধর্মীয়ভাবে নিরাপদে কিছু অর্থ উপার্জন করতে পারবে বলে। অথচ কি হয় তাদের সাথে সেখানে? ডিজিটাল সুবিধার কারণে তা আপনি-আমি-আমাদের কারোরই অজানা নয় এখন। প্লিজ, হয় এদেরকে দেশে ফিরে আসতে সাহায্য করুন, আর না হয় একটু দোয়া করুন। তবু তিরস্কার করবেন না। সেতারার নিঃশ্বাস চলছে না। কিন্তু পুলিশ বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে রেখেছে। ওদের কান্না শুনেও পুলিশ ভেতরে এসে একটাবার দেখছে না যে একটু হসপিটালে নিয়ে গেলে মেয়েটা বাঁচতে পারে কি না। কি নির্দয় আমার প্রিয় নবীর দেশের মানুষগুলো! পুলিশ হেফাযতে থেকেও নিরাপদে নেই বাংলাদেশী নারী গৃহ শ্রমিকরা। সে দেশের মালিকদের সাথে মিলে এখানেও মেয়েদের মারধর করে ফের মালিকদের সাথে নরকেই ফিরে যেতে বাধ্য করছে তারা। সবশেষে প্রশ্ন একটাই- সেতেরা, সুফিয়ারা কি বাঁচবে? নাকি সত্যিই মরে যাবে? ঝুমুর (পাসপোর্ট নং BQ 0638962), জন্ম বরিশালে হলেও ঢাকার মগবাজারে দুই সন্তান ও ছোট বোন মুক্তাকে নিয়ে বসবাস। এদেরকে মানুষ করার জন্য চলতি বছর ২০ জানুয়ারি বিজয় নগরের ফ্যালকন ইন্টারন্যাশনাল এর মাধ্যমে সৌদি আরবে পাড়ি জমায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিনত হয় তার। গৃহকর্তার দ্বারা অমানুষিক নির্যাতন ও খাবারের অভাবে নিজেই আধমরা হয়ে এখন পুলিশ হেফাজতে ঝুমুর। দিন-রাত কান্না আর চেষ্টা করে চলেছে দেশে সন্তানদের কাছে ফেরার জন্য। কিন্তু প্রতি মুহুর্ত ভয় তাকে তাড়া করে বেরাচ্ছে না জানি কখন সাথের অন্যান্য নারীদের মতো তাকেও সেই রাক্ষুসে মালিকের হাতে তুলে দেয় এখানকার পুলিশ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কয়েকদিনের চেষ্টায় আমাকে খুঁজে বের করেছে সাহায্য চাইবার জন্য, দেশে ফেরার জন্য। একই অবস্থা বাসিরুনের (পাসপোর্ট নং BC 0365415)। জামালপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চল দেওয়ানগঞ্জের হারুয়াবাড়ি মধ্যপাড়ার দরিদ্র ওমর ফারুকের স্ত্রী সে। সরকার নারীদের জন্য বিদেশে চাকরির সুযোগ করে দেয়ার কথা শুনে স্থানীয় দালালের সহযোগিতায় এজেন্সির মাধ্যমে উপার্জনের আশায় সৌদি আরব পাড়ি জমায়। কিন্তু এখানে এসে উল্টো কপাল পুড়েছে বাসিরুনের। সেকি কান্না তার স্বামী ও সন্তানদের…। তাদের মতোই সেতারা (পাসপোর্ট নং BK 0055924)। ঝিনাইদহের সেতারা স্থানীয় দালাল দিপুর সহযোগিতায় ঢাকার এক এজেন্সির মাধ্যমে সৌদি পাড়ি জমায় কিছুদিন আগে। কিন্তু যথেষ্ট পরিমানে খাবার না পেয়ে, গৃহকর্তা দ্বারা অত্যধিক মারধরের শিকার হয়ে সেতারা এখন মৃত্যু পথে। আশ্যয় হয়েছে হামেল থানায়। কাল(৫ সেপ্টেম্বর) রাতে ‘সেতারা মারা গেছে, নিঃশ্বাস চলছে না’ আতঙ্কে সে কি কান্নার রোল পড়েছিল এই হামেল থানায়, তা ওরা আমাকে দেখিয়েছে সরাসরি ভিডিও কলে। পুলিশ বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে রেখেছিল। একবারও এসে দেখেনি মানুষটাকে বাঁচানো যায় কি না। একই পরিনতি হবিগঞ্জের চনারঘাট থানার আসামপাড়া চনখলা এলাকার আবুল খায়েরের মেয়ে সুফিয়ার (পাসপোর্ট নং BM 0549128)। অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়ে সেও বন্দ্বী হয়েছে হামেল থানায়। বা পায়ের হাটুর উপরে, চেহারায়, শরীরে নির্যাতনের ছাপ স্পষ্ট। যেনো যে কোনো সময় দমটুকু বেরিয়ে যাবে। কিন্তু তবুও দয়া-মায়া হয়না নির্দয় পাষান লোকগুলোর। এই মৃতপ্রায় নারী শ্রমিককেও বাসার কাজের জন্য পূনরায় জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যেতে চাইছে গৃহকর্তা। পুলিশও অন্যান্য নারীদের মতো সুফিয়াকেও মারধর করে মালিকের হাতেই তুলে দিবে হয়ত যে কোনো সময়। কিন্তু এরা কি কাজ করবে? যে মানুষগুলোর এই মুহুর্তে চিকিৎসা দরকার, পরিবারের সেবা-শুশ্রুষা একান্তই দরকার, তারা কি করে গৃহকর্মীর কাজ করবে? প্রিয় নবীর দেশের মানুষ এতটা নির্দয় কেনো? একই অবস্থা সিলেটের জালালাবাদের আব্দুস সালামের স্ত্রী নাজমা(পাসপোর্ট নং জানা নেই) ও চাঁদপুরের মাজেদার(পাসপোর্ট নং জানা নেই)।

ওইদিকে সৌদির হারিয়াল এলাকা থেকে সালমা আক্তার মিলি নামে এক গৃহ শ্রমিক জানালো- নানা প্রতিকূলতার মধ্যদিয়ে প্রায় আড়াই বছর কাজ করার পরও এখনো তাকে দেশে ফিরতে দিচ্ছে না গৃহকর্তা। একবার পালিয়ে গেলেও তাকে ফের ধরে নিয়ে এসেছে পুলিশ কর্মকর্তা মালিক। সে চাঁদপুরের মতলব এলাকার মেয়ে। অথচ চুক্তি অনুযায়ী ২ বছর শেষ হলেও তাকে দেশে ফিরতে দেয়ার কথা। না এখন এজেন্সি কতৃপক্ষ সাহায্য করছে, না দালাল। সবশেষে আমার নাম্বারটিই পেয়েছে  সাহায্যের জন্য।

জীবনে একটিবার জীবীত অবস্থায় দেশে ফেরার জন্য কি আকুতি এসব নারীদের, তা চোখে না দেখলে, তাদের কান্না না শুনলে বোঝার উপায় নেই।

সৌদিতে অবস্থিত বাংলাদেশী দূতাবাস কতৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করেছি। লেবার কাউন্সেলর সারোয়ার সাহেব বললেন, ‘গতকালও ওই এলাকার এক থানায় দূতাবাস কতৃপক্ষ ভিজিট করেছে, কিন্তু এমন কোনো খবর আমরা পাইনি। তবে কমপ্লিন পেলে অবশ্যই সেখানে লোক পাঠানো হবে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য।’

দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি আসাদুজ্জামান বললেন, ‘আমি বর্তমানে এই এলাকাতেই রয়েছি। আগামীকাল সকালে সেখানে গিয়ে খোঁজ নিব।’ যদিও সে এখনো পর্যন্ত আমাকে কিছুই জানান নি কিংবা আমার ফোনটি আর রিসিভ করেন নি।

এদিকে তাদের কথা অনুযায়ী সেখানে বিপদগ্রস্থ কয়েকজনের নাম, ফোন নাম্বার ও পাসপোর্ট নাম্বার যোগার করে সেন্ড করেছি। অনেকের পাসপোর্ট নাম্বার পরিবার কিংবা তারা নিজেরাও বলতে পারছে না। তাদের পরিবারের লোকজন প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করছে, কান্নাকাটি করছে, তারাও। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে অতি সত্তর সৌদি আরবে পাঠানো  আরো জোড়ালো না হলে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে সময় লাগবে না। কি হবে এই ডিজিটাল বাংলাদেশ দিয়ে, যদি দেশ তাদেরকে নিরাপত্তা দিতে না পারে? সৌদিতে নারী গৃহকর্মীদের নিরাপত্তার দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারকেই নিতে হবে।

সোনিয়া দেওয়ান প্রীতি
সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী
preity077@gmail.com
01671335277, 01768360507

(ঢাকারনিউজ২৪.কম/এসডিপি/২:৫৫পিএম/৬/৯/২০১৮ইং)