• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১১:৪৩ অপরাহ্ন

সুনামগঞ্জের হাওরে লক্ষাধিক কৃষক ও জেলেরা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত


প্রকাশের সময় : জুন ২২, ২০১৯, ৪:৩১ PM / ৩১
সুনামগঞ্জের হাওরে লক্ষাধিক কৃষক ও জেলেরা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত

সুনামগঞ্জ সংবাদদাতা : মৎস্য পাথর আর ধান হাওরের জেলা সুনামগঞ্জের মানুষের প্রাণ। কৃষি প্রদান এই জেলায় বছরের ছয়মাস সাধারনত কৃষকরা তাদের কৃষিজমি চাষাবাদ ও কর্তন নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও বিকল্প কোন কর্মসংস্থান না থাকায় ছয়মাস তাদের অলস সময় কাটাতে হয়। এই জেলার মানুষের বেচেঁ থাকার প্রধান উৎস হচ্ছে বোরো জমিন আবাদ করা ও বৈশাখ মাসে সোনালী ফসল ঘরে তোলা। তারপরে ফাল্গুন চৈত্র মাসে প্রাকৃতিক দূর্যোগ খড়া,অধিক বৃষ্টিপাত ,শিলাবৃষ্টি আর অকাল বন্যার আশংঙ্কা থেকেই যায়। এই জেলার মানুষজন যুগ যুগ ধরে প্রকৃতির সাথে মরণপণ লড়াই করেই বেচেঁ আছেন। এই প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে প্রতিবছর কৃষকদের ফসল রক্ষার জন্য সরকার কোটি কোটি টাকা বাধঁ নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দিয়ে থাকে। ফাল্গুন ও চৈত্রমাসে অধিক বৃষ্টিপাতের ফলে নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে হাওরগুলোতে পানি উপচে পড়ে ভেতরে প্রবেশ করে এই অঞ্চলের কৃষকদের একমাত্র বেচেঁ থাকার অবলম্বন সোনালী ফসল বোরো ধান পানিতে তলিয়ে যাওয়ার শংঙ্কা থাকে। তবে প্রতিবছর এই ফসলহানির পেছনে বড় কারণ হলো এই জেলায় অসংখ্য ছোটবড় নদী নালা খালবিল রয়েছে। ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে প্রতিবছরের বিপুল পরিমাণ পলি আসায় নদীগুলোর নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় বৃষ্টির পানি ধারন ক্ষমতা কমে গেছে। সরকার ঐ সমস্ত নদী ও হাওরবাওরগুলো খননের উদ্যোগ নিলে ও পুরোপুরি খনন না হওয়া পর্যন্ত কৃষকদের দু’চিন্তার যেন কমতি নেই। সরকার প্রতিবছর ফাল্গুন চৈত্র মাসে স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে ফসল রক্ষা বাধেঁর কাজ করে থাকেন। কিন্তু বর্ষার মৌসুম শুরু হওয়ায় এই বাধেঁর কারণে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া,রফিনগর ও চরনারচর এই তিন ইউনিয়নের প্রায় লক্ষাধিক মানুষ অবরুদ্ধ হয়ে আছেন।
স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা যায় উপজেলার বদলপুর হতে শ্যামারচর পর্যন্ত প্রায় ৫০ কিলোঃ সুরমা নদীর পাড়ে বাধঁ নির্মাণের ফলে এই অঞ্চলের মানুষজনের নদীর সাথে সংযোগ না থাকায় দিরাই উপজেলা সদরের সাথে নৌ-চলাচল বিছিন্ন রয়েছে। ফলে তিনটি ইউনিয়ন ভাটিপাড়া,রফিনগর ও চরনারচর ইউনিয়নের কিছু অংশের মানুষজনের মাঝে ভিজিডির চাল বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করা যাচ্ছে না। বাধেঁর কারণে এই সমস্ত অঞ্চলে নৌযান চলাচল না থাকায় চলতি বছর কৃষকদের নিকট হতে সরকার কর্তৃক ন্যায্য মূল্যে ধান সংগ্রহ ও বিক্রির সুযোগ থাকলেও কৃষকরা সরাসরি দিরাই উপজেলা সদরের খাদ্যগুদামে এসে ধান দিতে না পারার কারণে কৃষকরা তাদের ধানের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

গতকাল শনিবার সকালে সরেজমিনে ঘুরে স্থানীয় শ্যামরচর বাজারের কৃষক মোঃ আজিজুল হক,রুবেল তালুকদারসহ বেশ কয়েকজনের সাথে কথা হলে তারা জানান,হেমন্তের মৌসুমে আমাদের একমাত্র সোনালী ফসল বোরো ধান রক্ষায় সরকার ও পানি উন্নয়ন বোর্ড যে বাধঁগুলো নির্মাণ করে দেন সেটা সঠিক। তবে বর্ষার মৌসুমে আমাদের হাওরপাড়ের মানুষজনের জেলা ও উপজেলা সদর সদর যোগাযোগের একমাত্র বাহন হলো ছোটবড় নৌযান। কিন্তু উপজেলার রাজানগর ও শ্যামারচর অংশের হাতেগোনা কয়েকটি স্থানে বাধঁগুলো কেটে পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা করে দিলে এই অঞ্চলের কৃষকরা সরাসরি নৌকাযুগে ধান নিয়ে উপজেলা সদরের খাদ্যগুদামে এনে ধান বিক্রি করতে পারলে আামদের কষ্টার্জিত ফসলের ন্যায্য মূল্য পেতাম। অপরদিকে আমাদের এলাকার মৎস্যজীবিরা জীবন জীবিকার প্রয়োজন ছোট ছোট নৌকায় করে হাওর কিংবা নদীতে প্রবেশ করে মৎস্য আহরণ ও বিক্রি করার সুযোগ থাকতো। অবিলম্বে ঐ সমস্ত পয়েন্টে বাধঁ কেটে দিয়ে এই তিনটি ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষের নৌপথে চলাচলের পথটি সুগম করতে সরকার ও স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন দ্রæত পদক্ষেপ নেয়ার দাবী জানান।

এ ব্যাপারে চরনারচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রতন কুমার দাস তালুকদার জানান, আমরা জনপ্রতিনিধি হিসেবে জনগনের ভালমন্দটা দেখতে হয়। তিনি বলেন আসলেই এই তিনটি ইউনিয়নের প্রায় লক্ষাধিক মানুষজন বাধেঁর কারনে বর্ষার এই মৌসুমে অবরুদ্ধ হয়ে আছি। সরকার এই জেলার কৃষকদের কল্যাণে অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছেন যা প্রশংসার দাবী রাখেন। তবে বর্ষার মৌসুমে রাজানগর ও শ্যামারচর পয়েন্টের হাতেগোণা কয়েকটি স্থানে বাধঁ কেটে দিলে গ্রামের অসহায় কৃষক,দিনমুজুর ও গরীর মানুষজন সরকারের দেয়া ভিজিডির বরাদ্দকৃত চাল সহজপথে নৌকায় করে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে নিয়ে আসতে পারতেন। নৌকা চলাচল বন্ধ থাকার ফলে ইউনিয়ন পরিষদের বরাদ্দকৃত চাল উপজেলা খাদ্যগুদাম থেকে ইউনিয়ন পরিষদে নিয়ে আসতেও জনপ্রতিনিধিদের অতিরিক্ত পরিবহন ভাড়া ব্যয় করে শ্রমিকের মাধ্যমে নিয়ে আসতে হয়। পাশপাশি সাধারন মানুষজন পায়ে হেটে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ কিংবা উপজেলা সদর আসতেও দেখা যায়। তাই দ্রæত সময়ের মধ্যে এই অসহায় মানুষজন অবরুদ্ধ জীবন থেকে মুক্তি চায় বলে জানান তিনি।

এ ব্যাপারে ভাটিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহজাহান কাজি ও রফিনগর ইউপি চেয়ারম্যান রেজোয়ান হোসেন খান জানান,আমরা হাওরপাড়ের মানুষজন আজো উন্নত যোগযোগ ব্যবস্থা না থাকার কারণে স্বাধীনতা পরবর্তী আজো বর্ষার মৌসুমে ছয়মাস অবরুদ্ধ থাকি। ঐ সমস্ত এলাকায় একটি প্রবাদ আছে হেমন্তে পা আর বর্ষায় নাও। বর্ষার মৌসুমে গ্রামগঞ্জের মানুষজন তাদের বাড়ি হতে ইউনিয়ন পরিষদ কিংবা উপজেলা সদরে আসতে হলে নৌকার কোন বিকল্প নেই। কিন্তু এই মৌসুমে এই ফসল রক্ষা বাধেঁর কারণে এই তিনটি ইউনিয়নের মানুষজন অবরুদ্ধ আছি। সরকার বাহাদুর দ্রæত কিছু স্থানে বাধঁ কেটে দিলে এই অঞ্চলের সাধারন মানুষজন দীর্ঘপথ পায়ে হাটা থেকে রেহাই পাবে।

এ ব্যাপারে দিরাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ শরিফুল ইসলামের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা তিনি এই অঞ্চলের মানুষজন বাধেঁর কারণে অঅবরুদ্ধের কথা স্বীকার করে জানান,আমরা উপজেলা প্রশাসন ইতিমধ্যে উপজেলা চেয়ারম্যান প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের নিয়ে মিটিং করে ঐ অঞ্চলগুলো ভিজিট করে এসেছি। ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যে এই তিনটি ইউনিয়নের গাতুয়া খাল,রাজানগরের রন্নারচর খাল ও আলিপুর যে খালে বাধঁগুলো রয়েছে এই তিনটি অংশে বাধঁ দ্রæত কেটে দিয়ে অবরুদ্ধ সাধারন মানুষজনের জন্য নৌপথে চলাচলের পথ সুগম করার প্রতিশ্রæতি দেন তিনি।

এ ব্যাপারে দিরাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মজ্ঞর আলম চৌধরী অবরুদ্ধ তিনটি ইউনিয়নের মানুষজনের কষ্টের সাথে সহমত পোষন করে বলেন,আমি জনসাধারনের ভোটে যেহেতু জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছি তাই আমার নির্বাচনী এলাকার জনগনের সুখ দুঃখে পাশে থেকে তাদের কল্যাণে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। তিন বলেন আমি ইতিমধ্যে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও চরনারচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রতন তালুকদারকে নিয়ে গত ২০ জুন এই অঞ্চল পরিদর্শন করে এসেছি। আমরা চাই দ্রুত সময়ের মধ্যে এই তিনটি ইউনিয়নের প্রায় লক্ষাধিক মানুষজন বাধেঁর কারণে যে অবরুদ্ধ আছেন কোন কোন পয়েন্ট দিয়ে বাধঁ কেটে দিলে আশপাশের মানুষজন ক্ষতিগ্রস্থ হবেনা সেই দিকটি বিবেচনায় নিয়ে বাধঁ কেটে দিয়ে এই অঞ্চলের মানুষজনকে নৌপথে উপজেলা সদরে আসার ব্যবস্থা করে দেয়া এবং গরীব মৎসজীবিরা যেন ছোট ছোট নৌকায় করে হাওরে গিয়ে উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছ আহরণ করে বিক্রি করে জীবন জীবিকা চালাতে পারে সেই ব্যবস্থা করে দিবেন বলে জানান।
(ঢাকারনিউজ২৪.কম/কেএস/৪:৩০পিএম/২২/৬/২০১৯ইং)