• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ০৯:৫১ পূর্বাহ্ন

সাহস… সমাজ পরিবর্তনের সাহস


প্রকাশের সময় : জুলাই ১৯, ২০২২, ১২:৩৫ AM / ৮৪
সাহস… সমাজ পরিবর্তনের সাহস

সোনিয়া দেওয়ান প্রীতি : মাঝে মাঝে একেবারেই সামান্য কোনো কাজের সাফল্যে কেউ কেউ বলে ফেলেন- ‘আপনারতো অনেক সাহস’। তাদের দিকে তাকিয়ে শুধু একটা ছোট্ট হাসি দেই, আর কোনো কথা বলি না। কেননা তখন মনে মনে অতিত স্মৃতিতে ফিরে যাই। এটাতো ২০২২ সাল, ডিজিটাল সময়। যখন কারও ধারনাও ছিল না এক সময় হাতে হাতে মোবাইল হবে, সেই মোবাইলে সিনেমা দেখা যাবে, ক্যামেরার মতো ছবিও তোলা যাবে, ভিডিও করা যাবে; ঘরে ঘরে ইন্টারনেট-কম্পিউটার থাকবে, যখন সাধারন ঘরের নারীদের জন্য সর্বোচ্চ ১০ম শ্রেণীতেই বিয়ের পিড়ি নির্ধারিত। অর্থাৎ এসএসসির পর মেয়ের বিয়ে হবে- এটা যেনো সাধারন ঘরের বাবা মায়েরা মানতেই পারত না। সেই সময় একলা নারী হিসেবে এমন একটা পেশাকে বেছে নিয়েছিলাম, যেখানে শত শত পুরুষের সাথে দিনের পর দিন নিজেকে টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ করেছি। কাজের যুদ্ধ নয়, একজন নারী হিসেবে নিজের অস্তীত্বকে টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ। অফিস কিংবা অফিসের বাইরে পুরো শহর জুড়ে কোথাও ছিলনা নিজের পেশার কোনো একজনও নারী সহকর্মী। এত এত পুরুষের ভীরে একমাত্র নারীকে যেনো পুরুষ মানুষগুলো কোনোভাবেই সহ্য করে নিতে পারছিল না। তাদের দেমাগে/ব্যক্তিত্বে যেনো বেশ বড়সড় আঘাত করে বসেছিলাম আমি এই পেশায় এসে। তাই আমাকে নানা ধরনের ভয় দেখিয়ে, নানা ধরনের নোংরা টিপ্পনি কেটে, আমার সম্পর্কে আজগুবি সব আজেবাজে মন্তব্য ছড়িয়ে আমাকে এই পেশা থেকে সড়িয়ে দেয়াই ছিল তাদের একমাত্র লক্ষ্য। একবার এক পত্রিকা অফিসে আমার সিনিয়র এক সহকর্মী আমাকে নিউজ এসাইনমেন্টে পাঠানোর বাহানায় বাজেভাবে একটা ঘটনার জন্ম দিতে চেয়েছিল। যাতে করে ভয় পেয়ে সরে যাই তাদের পৃথিবী থেকে। না, তার সেই নোংরা মানসিকতার বিষয়টি জানতে পেরে সেই পত্রিকার কাজ ছেড়ে দেই, কিন্তু পেশা ছাড়ি না। এর কিছুদিন পরেই এক মাদক ব্যবসায়ীর থেকে নিয়মিত চাঁদা নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে কলম বন্ধ করে রাখা এক সহকর্মী যখন আমাকে দেখল তার সেই তেলমারা লোকের কুকর্ম তুলে ধরে একের পর এক সিরিজ নিউজ করে যাচ্ছি, তখন সে বাজে নাটক সাজালো। আমি কোথায় আর যাকে দিয়ে জড়াচ্ছে সে কোথায় কে জানে তখন, অথচ পাবলিক প্লেসে কাজ করার সময় একটা হিউমার ছড়িয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা করল। সেদিন খানিকটা ভয় পেয়েছিলাম, সেই ভয়টা ছিল শুধুই কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে একজন নারী হয়ে পুরষদের সমানে সমান হয়ে কাজ করছি, অথচ এই অবস্থায় যদি কোনো পুরুষকে জড়িয়ে বাজে কথা ছড়ানো হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ জীবনে কি হবে? শুধুমাত্র মান সম্মান এর ভয় পেয়েছিলাম সেদিন। কেননা মানুষতো জানবে না কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যে, তারা নারীর সম্পর্কে একটা নেগেটিভ কথা শুনলেই তার সাথে ৯৯ গুণ লাগিয়ে প্রচার করে বেরাবে। সেদিন কাঁদতে কাঁদতে বাসায় ফিরে গিয়ে বাবাকে বলেছিলাম- আর সাংবাদিকতা করব না, পুরুষ সহকর্মীগুলো খুব নোংরা মনের। সমস্ত ঘটনা শুনে বাবা সেদিন শান্তনা দেয়ার বদলে উল্টো বলেছিল- ‘সাংবাদিকতা এত সহজ না, তোমাকে এসবের মোকাবেলা করেই টিকে থাকতে হবে, পেশাটা খারাপ না, খারাপ হচ্ছে এই পেশায় থাকা কিছু খারাপ মানুষ। সুতরাং বাঘের বাচ্চার মতো সোজা নিজের কাজে ফিরো।’ মনের সমস্ত সাহস নিয়ে আগের চেয়েও দ্বিগুন আত্মবিশ্বাসে ফের কাজ শুরু করলাম। তবুও পেশা ছাড়লাম না। কেননা ছাত্র জীবন থেকে এই একটাই লক্ষ্য আমার। তাই কারও নোংরা চিন্তা ভাবনা কিংবা কারও দেখানো ভয়ে নিজের লক্ষ্য থেকে ছিটকে পরার মানুষ আমি ছিলাম না এবং আজও নই, যার উৎকৃষ্ট প্রমান-আন্তর্জাতিকভাবে নারীদের নিরাপত্তায় করা আমার স্বীকৃত কাজগুলো, যা করে যাচ্ছি মানসিক তৃপ্তি সহকারে। কই, সেইসব পুরুষ নামের কালপিটগুলোকে তো দেখলাম না দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য নিজের জীবন বাজি রেখে কোনো কাজ করতে? কথায় আছে- ধৈর্য্য ও সৎ সাহস এবং ভাল কিছু করার লক্ষ্য থাকলে সেখানে সফলতা অনেক দেরিতে এলেও একদিন আসতে বাধ্য। আর এসবের জন্য লাগে সাহস(courage), সৎ সাহস(honest courage)। হ্যা, শত কাটার মাঝেও ফুলের মতো কয়েকজন পুরুষ সহকর্মীকে পেয়েছিলাম বলেই হয়ত পথটা একেবারে কাটায় পরিপূর্ণ হলেও টিকে থেকেছি। কত দুঃস্বপ্নময় ছিল সেইসব দিনগুলো…। প্রতিটা দিন পেশাগত কাজে নতুন নতুনভাবে নিজেকে দক্ষ করে তোলার চেয়ে বেশি কঠিন ছিল সেইসব নোংরা মনের পুরুষদের সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে সমান তালে এগিয়ে চলা। যেখানে প্রতিটা মুহুর্ত নারী হিসেবে আমাকে কটাক্ষ করা হতো, নিচু দেখানোর চেষ্টা করা হতো। একটা সময় নারী সহকর্মীদের দেখা পেলাম, তাও নিজ জেলা নারায়ণগঞ্জে না, ঢাকাতে ম্যাস্ লাইন মিডিয়া সেন্টার (এমএমসি) তে সাংবাদিকতার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে একের পর এক প্রশিক্ষণ ও সেমিনারে যোগ দিতে দেশের অন্যান্য জেলা থেকে আসা নারী সহকর্মীদের পেলাম। নিজেদের স্ব স্ব জেলায় নারী হিসেবে কাজ করতে যেয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলো শেয়ার করতে গিয়ে প্রায় সবার সমস্যাগুলোই মিলে যেতে দেখে সবাই আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলাম। সাহস…. সাহস যে কি জিনিষ তা ২০২২ সাল আমাকে কি শেখাবে, তা শিখে এসেছি সেই হাতে হাতে মোবাইল/ইন্টারনেট/কম্পিউটার না থাকার সময় থেকে। এখন অনেক শিক্ষিত (কোথাও কোথাও নামধারী সংবাদকর্মী হিসেবে অশিক্ষিত নারীদেরও দেখা যায়) নারী এই শহরে এই পেশায়, এমনকি রাজধানী সহ সারা দেশময় আনাচে কানাচে এই পেশায় নারীর সংখ্যা বেড়েছে তুলনামূলকভাবে। কিন্তু একলা একজন নারী হিসেবে বাপ-দাদা/মামা-চাচা/স্বামীর পরিচয়ে নয়, বরং নিজের পরিচয়ে সেই সময়ে গোটা একটা পুরুষশাসিত সমাজে সমানে সমান কর্ম দক্ষতা দিয়ে টিকে থাকতে পারার সাহস এর পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ণের তালিকা কেমন তা হয়ত কেউ দেখেনি! সেই সাহসে আমি সাহসী। যে সময়ে এই একই সাহসের আর কোনো ভাগিদ্বার ছিল না। সুতরাং অন্য অনেক ইচরেপাকাদের মতো নিজেকে জাহির করে বড় বড় বাক্য বলে বেড়াই না মানেই এই নয়- আমি ভিতূ। কে ভুল বলছে, কে বানিয়ে বানিয়ে একটু বেশিই বলছে, কে কাজের চেয়ে বেশি ভাব নিয়ে বলে যাচ্ছে – এ সবই আমি বুঝি, তবুও চুপ থাকি, নিরব থাকি। কেননা এই বেলায় এসে নিজের কর্মের বাইরে একেবারেই নির্ঝঞ্ঝাট থাকতে পছন্দ করি, তাই যতটুকু সম্ভব নিজেকে গুটিয়ে রাখার চেষ্টা করি। আর সাহসের এওয়ার্ডতো অর্জনের থলেতে সংরক্ষিত রয়েছেই। সবচেয়ে বড় সাহস হচ্ছে- মানুষ হিসেবে মানুষের প্রয়োজনে নিজের জীবন বাজি রেখে বিনা লাভে কিছু করতে পারা। সেই সাহসে আমি একজন স্বীকৃতি প্রাপ্ত সাহসী মানুষ। courage, Not everyone has the courage to change of society.

লেখক :
সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী