• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ০১:০৪ পূর্বাহ্ন

শিক্ষাবৃত্তি-বয়স্ক ভাতার টাকা আত্মসাৎকারী চক্রের ৯ সদস্য গ্রেপ্তার


প্রকাশের সময় : এপ্রিল ৪, ২০২৪, ২:২১ AM / ৭২
শিক্ষাবৃত্তি-বয়স্ক ভাতার টাকা আত্মসাৎকারী চক্রের ৯ সদস্য গ্রেপ্তার

লিখন রাজ : মোবাইল ব্যাংকিং (বিকাশ, নগদ) প্রতারণার মাধ্যমে শিক্ষা বৃত্তি, বয়স্ক ভাতা ও বিধবা ভাতা প্রদানের নামে লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে প্রতারক চক্রের ৯ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের এলিট ফোর্স র‌্যাব।

মঙ্গলবার(২ এপ্রিল) রাতে ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ ও ফরিদপুরের ভাঙ্গা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে তাদের গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-১০ এর একটি দল।

বুধবার(৩ এপ্রিল) দুপুরে কারওয়ান বাজারে অবস্থিত র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‍্যাব-১০ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন।

তিনি বলেন, সম্প্রতি কতিপয় প্রতারক চক্র রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ মানুষকে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, ছাত্র-ছাত্রীদের উপবৃত্তি প্রদান ও মোবাইল ব্যাংকিং (বিকাশ/নগদ) ব্যবসায় অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে বিকাশ/নগদের মাধ্যমে প্রতারিত করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় র‌্যাব-১০ প্রতারক চক্রকে আইনের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি ও নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে আসছিল। কক্সবাজার জেলার পেকুয়া থানায় বসবাসকারী ভুক্তভোগী ইসতাহাদ উদ্দিন সোহানের (১৯) মোবাইল নম্বরে গত ২২ মার্চ ৩টা ৩৬ মিনিটে কল দিয়ে তার নম্বরে উপবৃত্তির টাকা পাঠাবে বলে কৌশলে তার বিকাশের পিন নম্বর নিয়ে নেয় তারা। পরবর্তীতে ৩৮ লাখ ২৫৮ টাকা তার অ্যাকাউন্ট থেকে সরিয়ে ফেলে। এ ঘটনায় তিনি কক্সবাজার জেলার পেকুয়া থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।

 

এছাড়া গত ২৪ মার্চ কক্সবাজার জেলার পেকুয়া থানায় জান্নাতুল ফেরদৌস নামে এক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে একই চক্র ২০ হাজার ৪০০ টাকা ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী থানা এলাকার লোকমান হোসেন (৪৪) এর কাছ থেকে তার ছেলের নামে উপবৃত্তির কথা বলে ১৬ হাজার ৩০০ টাকা হাতিয়ে নেয়।

গতকাল রাতে র‌্যাব-১০ এর একটি দল গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকা জেলার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে অভিযান পরিচালনা করে চক্রের অন্যতম মূল হোতা ইসমাইল মাতুব্বরসহ (২১) চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার ইসমাইল ফরিদপুর জুমুরকান্দার দেলোয়ার মাতুব্বরের ছেলে। গ্রেপ্তার অন্যরা হলেন, ছোট ভাই ইব্রাহীম মাতুব্বর (২৭), সহযোগী মো. মানিক ওরফে মতিউর রহমান (১৯) ও সিনবাদ হোসেন (২৪)। এ সময় তাদের কাছ থেকে ২২টি মোবাইল ফোন, ৩৫টি সিম কার্ড, ৫টি মোবাইলের চার্জার, ১টি ল্যাপটপ, ১টি ব্যাগ ও নগদ ৩০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়।

তদন্তকালে র‌্যাব-১০ আরও জানতে পারে অন্য আরেকটি প্রতারক চক্র গত ১৩ ফেব্রুয়ারি আব্দুল মমিন (৪২) নামে একজন নতুন বিকাশ এজেন্টের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে ৪২ হাজার ৭৭৭ টাকা হাতিয়ে নেয়। প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে ডিএমপি ঢাকার ডেমরা থানায় তিনি একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।

জিডির সূত্র ধরে একই তারিখ রাতে র‌্যাব-১০ এর দুটি পৃথক দল ঢাকা জেলার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ ও ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে মোবাইল ব্যাংকিং (বিকাশ/নগদ) ব্যবসায় অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে এজেন্টদের কাছ থেকে বিকাশ ও নগদের মাধ্যমে প্রতারিত করে বিপুল অর্থ আত্মসাৎকারী চক্রের অন্যতম মূল হোতা সুমন ইসলাম (২০), মাহমুদুল হাসান পলক (২০), সাব্বির খন্দকার (১৯), মো. সাকিব (১৯), ও রাসেল তালুকদারকে (২৩) গ্রেপ্তার করে। এ সময় তাদের নিকট হতে ১৪টি মোবাইল ফোন, ৯১টি সিম কার্ড, ১টি ব্যাগ, ১০৪ পিস ইয়াবা ও ৫২ হাজার ৫০০ টাকা উদ্ধার করা হয়।

র‍্যাব-১০ এর অধিনায়ক ফরিদ বলেন, গ্রেপ্তার ইসমাইল মাতুব্বর সাধারণ মানুষকে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা ও ছাত্র-ছাত্রীদের উপবৃত্তি প্রদানের নামে বিকাশ ও নগদের মাধ্যমে প্রতারিত করে অর্থ আত্মসাৎকারী চক্রটির মূল হোতা। তার নেতৃত্বে পরস্পর যোগসাজশে চক্রটি প্রায় দুই বছর ধরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে অর্থ আত্মসাৎ করে আসছিল। নিরিবিলি স্থান হিসেবে তারা দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ এলাকায় বেছে নেয় যাতে নির্বিঘ্নে প্রতারণার কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে।

তারা প্রথমে উপবৃত্তির ওয়েবসাইট থেকে উপবৃত্তির তালিকা সংগ্রহ করত। পরবর্তীতে ইসমাইল প্রথমে বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে ক্লোন করে বিকাশ/নগদ অ্যাকাউন্ট খোলা ভিকটিমদের বিভিন্ন মোবাইল নম্বরে ফোন দিয়ে নিজেকে শিক্ষা অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পরিচয় দিয়ে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা ও ছাত্র-ছাত্রীদের উপবৃত্তি প্রদানের কথা বলে প্রলুব্ধ করে।

 

এরপর বিশেষ মোবাইল অ্যাপসের সহায়তায় টার্গেট করা ভুক্তভোগীদের মোবাইলে ফোন করে সিরিয়াল নম্বরের কথা বলে অথবা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে বিকাশ/নগদের ওটিপি সংগ্রহ করত। ওটিপির মাধ্যমে তারা ভিকটিমদের বিকাশ/নগদ অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে অন্য অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করার মাধ্যমে ভিকটিমদের টাকা আত্মসাৎ করত।

একইভাবে তারা একাধিক ভুক্তভোগীর বিকাশ বা নগদ অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড সংগ্রহ করে রাখত এবং একটি মোবাইলে একাধিক বিকাশ বা নগদ অ্যাপস ডাউনলোড করে অ্যাকাউন্টে লগইন করে রাখত। তারপর অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা প্রবেশ করা মাত্র ইসমাইল মোবাইলে নোটিফিকেশনের মাধ্যমে তা জানতে পারে এবং সাথে সাথে টাকা তার অন্যান্য সহযোগী ইব্রাহীম, মানিক ও সিনবাদের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করে।

পরবর্তীতে সিনবাদ হোসেন টাকা তাদের আশপাশের অথবা দূরবর্তী বিভিন্ন এলাকা হতে ক্যাশআউট করে ইসমাইলের কাছে নিয়ে আসার ভাগ-বাটোয়ারা হতো।

গত এক বছরে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে শতাধিক সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা ও উপবৃত্তি প্রদানের প্রলোভন দেখিয়ে প্রায় ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছে তারা।

অন্যদিকে গ্রেপ্তার সুমনকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের বরাতে অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন বলেন, সুমন ইসলাম মোবাইল ব্যাংকিং (বিকাশ/নগদ) ব্যবসায় অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে এজেন্টদের কাছ থেকে বিকাশ ও নগদের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎকারী চক্রটির মূল হোতা। তার নেতৃত্বে চক্রটি প্রায় ৮-৯ মাস ধরে বিভিন্ন বিকাশ বা নগদ ব্যবসায়ী এজেন্টদের সঙ্গে প্রতারণা করে অর্থ আত্মসাৎ করে আসছিল।

এজেন্টদেরকে হাজারে ৪ টাকার পরিবর্তে ৮-১০ টাকা লাভ করার বিভিন্ন অফার সম্পর্কে অবহিত করত। এক্ষেত্রে এজেন্টরা অফার সম্পর্কে অবগত নন বললে সুমন এজেন্টদের নিকট হতে বিকাশ/নগদের এসআরের ফোন নম্বর নিয়ে ক্লোন করে এজেন্টদের ফোন করে সার্ভিস রিপ্রেজেনটেটিভের (এসআর) পরিচয় দিয়ে বলত উনি আমাদের বস। উনি যা বলেন সেভাবে কাজ করেন। তারপর সুমন মোবাইলে ওটিপি প্রেরণের মাধ্যমে কৌশলে এজেন্টদের কাছ থেকে বিকাশ/নগদের এজেন্ট নম্বরের পাসওয়ার্ডটি সংগ্রহ করত।

একইভাবে একাধিক ভিকটিমদের পাসওয়ার্ড সংগ্রহ করে একটি মোবাইলে একাধিক বিকাশ/নগদ অ্যাপস ডাউনলোড করে এবং প্রত্যেকটি অ্যাকাউন্টে লগইন করে রাখত। অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা প্রবেশ করা মাত্র সুমন সহযোগীদের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করে নিত। চক্রটি ২ বছরে দেশের বিভিন্ন এলাকার প্রায় ৬০-৭০ জন বিকাশ/নগদ এজেন্ট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।