জুবায়ের আল মাহমুদ : রাষ্ট্রহীন বিশ্বনাগরিকের ভূখণ্ড কোথায়? চলুন জেনে নিই।
এক
বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রহীন নাগরিকের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলছে । জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রতিদিন ৪৪,৫০০ জন মানুষ বাস্তুচ্যুত নাগরিকে পরিনত হচ্ছে । সবমিলিয়ে বিশ্বে রাষ্ট্র ছেড়ে আসা বাস্তুচ্যুত নাগরিকের সংখ্যা এখন প্রায় ৬ কোটি ৮০ লাখ । এই দশকে বিশ্ব করুন এক শরণার্থী সমস্যার শিকার ।বাস্তুচ্যুত মানুষের ভিড় যেন বিশ্বের আনাচে কানাচে লেগেই আছে । বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে রাজনৈতিক, সামরিক, জাতিগত ও মতাদর্শের নানা সংকট মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছে জাতি পরিচয়, বেঁচে থাকার অধিকার। রাষ্ট্রহীন বিশ্বনাগরিকদের মধ্যে শরণার্থী হিসেবে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে ২ কোটি ৫৬ লাখ মানুষ । শরণার্থীদের মধ্যে অধিকাংশের বয়স ১৮ এর নিচে । এই শিশু কিশোরদের চোখে বিশ্ব আজ বিভীষিকাময় । সবচেয়ে বড় আশ্চর্যের বিষয় ১ কোটি মানুষের তো কোন পরিচয় নেই , তাদের কোন ভূখণ্ড নেই , নেই কোন দেশের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি । এইসব মানুষজন এই গ্রহের প্রাণী , তারা আজ বিশ্ব নাগরিক ।
দুই
বাংলাদেশ এখন অমানবিক অত্যাচারের শিকার রাষ্ট্র পরিচয়হীন ১১ লাখ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল । তার মধ্যে ৭ লাখ আশ্রয় নিয়েছে ২০১৭ সালের ২৫ শে আগস্ট এর পর । এক দশকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢল ই বিশ্বে সবচাইতে বড় শরণার্থী ঢল । সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশ মানবিক হতে গিয়ে আরও নানা সমস্যার সন্মুখীন হচ্ছে । অস্থায়ী ক্যাম্পের খুপরি ঘরে বসবাস করা রোহিঙ্গাদের খাদ্য , বস্ত্র , শিক্ষা , চিকিৎসা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল । রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভবিষ্যৎ পৃথিবীর অন্য শরণার্থীদের চেয়ে সবচেয়ে অনিশ্চিত । মানবিক বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গা এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা । বিশেষ করে কক্সবাজার , উখিয়া ও টেকনাফে সামাজিক ও পরিবেশগত বিপর্যয় বেড়েই চলছে । এদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য মিয়ানমার এর আলোচনা বা প্রস্তুতি একেবারেই অপ্রতুল । জাতিসংঘ বা বিশ্বচাপ কোন কিছুতেই মিয়ানমারের ভ্রুক্ষেপ নেই । মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় শক্তি চীনের সমর্থন । চীন তার মানবতাকে দক্ষিন চীন সাগড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ভূরাজনৈতিক স্বার্থের কারনে অন্ধভাবে মিয়ানমারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে ।বিশ্বব্যাপী রোহিঙ্গা সমস্যা সম্পর্কে বিশ্ব নেতারা যথেষ্ট অবগত আছেন । কিন্তু চীনের কারনে এ সমস্যার আশু সমাধান হচ্ছে না । বাংলাদেশকে একটা দীর্ঘসময় এই ১১ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা বইতে হতে পারে, সেটাই আপাতদৃষ্টিতে প্রতীয়মান । বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ১১ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে অর্ধেকই শিশু কিশোর । এই নিগৃহীত শিশু কিশোর এর বহুলাংশ বড় হয়ে যদি হতাশা , বিদ্বেষ ও বঞ্চিত মনোভাবের কারনে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের পথ বেছে নেয় তা শুধু বাংলাদেশ নয় , চীন , মিয়ানমার ও ভারত সহ পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হবে । আঞ্চলিক শান্তি বিনষ্টের কারন হয়ে দাঁড়াবে ।
তিন
সিরিয়ার শরণার্থী সমস্যা আজ গোটা বিশ্বকে ভাবিয়ে তুলছে । ২০১১ সালে সিরিয়া সরকারের সাথে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর যুদ্ধ শুরু হলে সে বছরই বাস্তুচ্যুত হয় ১০ লাখ মানুষ । শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয় পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে । ছয় বছরেও সিরিয়া সংকটের সমাধান হয়নি । এর মধ্যে শরণার্থী হয়েছে ৫৫ লাখ মানুষ। তুরস্ক আশ্রয় দিয়েছে ২৫ লাখ সিরিয়ান শরণার্থীকে । সিরিয়ান শরণার্থীরা গোটা বিশ্ব জুড়ে আশ্রয় নিয়েছে । যারা নিবন্ধনকৃত সিরিয়ান শরণার্থী তারা আশ্রয় নিয়েছে লেবানন, জর্ডান, জার্মানি, সৌদি আরব, ইরাক, কুয়েত, ইজিপ্ট, সুইডেন, হাঙ্গেরী, কানাডা, ক্রোয়েশিয়া, গ্রিস, অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, সার্বিয়া, সিঙ্গাপুরসহ আরও বেশ কয়েকটি দেশে । গোটা বিশ্বজুড়ে শরণার্থী ছড়িয়ে পড়ার এমন ঘটনা বিশ্ব আগে কখনও দেখেনি । উন্নত দেশগুলো যে অর্থ ও ত্রাণ সহায়তা করছে তা খুব সামান্য। সিরিয়ান শরণার্থীদের দুর্দশা চরমে পৌঁছেছে। শুধু তাই নয় আন্তর্জাতিকভাবেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করে চলছে সিরিয়ান শরণার্থীরা। উত্তর-পূর্ব নাইজেরিয়ায় সন্ত্রাসী সংগঠন বোকো হারামের হত্যাযজ্ঞ, লুটপাট প্রবল আকার ধারণ করে ২০০৯ সালে। ঠিক তখন থেকেই আফ্রিকার লেক চাঁদ বেসিন অঞ্চলের মানুষ দেশ ছেড়ে পালাতে শুরু করে। আফ্রিকার লেক চাঁদ বেসিন অঞ্চল থেকে প্রায় ২০ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়ে দুঃসহ জীবনযাপন করছিল । খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে তা ২৬ লাখ ছুঁয়ে যায় । ক্যামেরুন, চাঁদ, নাইজার ও নাইজেরিয়ার এ শরণার্থীদের অবস্থা করুণ। খাদ্য ও চিকিৎসাসেবার সংকট সেখানে মানবিক বিপর্যয় তৈরি করেছে। অর্ধ লক্ষ মানুষ দুর্ভিক্ষের শিকার হয়েছে। বিশ্বমানবতা ভুলে গেছে দক্ষিন সুদানকে । বর্তমানে দক্ষিণ সুদানের শরণার্থী সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখের ঘরে । সেই ২০১৩ সালের ডিসেম্বর থেকে দক্ষিণ সুদানে শরণার্থী হয়েছে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। তারা গৃহহীন,খাদ্যহীন । তাদের মধ্যে ২০ লাখ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে। প্রাণে বেঁচে গেলেও চিকিৎসা ও খাদ্য সংকটে তারা মৃত্যুর প্রহর গুনছে , যাদের মধ্যে ১ লাখ মানুষ না খেয়ে আছে । খাদ্য সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে দক্ষিন সুদানের ৫০ লাখ মানুষের মধ্যে । গৃহযুদ্ধ , জাতিগত বিরোধ , প্রাকৃতিক বিপর্যয়ই মূলত আফিকার দেশগুলোতে শরণার্থী সংকট বাড়িয়ে তুলেছে । বিশ্বমানবতা বা মানবিক দেশগুলোর নেতাদের কোন দৃষ্টিই যেন নেই আফ্রিকার এসব দেশগুলোর প্রতি । জাতিসংঘের UNHCR এর সাহায্য একেবারে অপ্রতুল । প্যালেস্টাইনে যেন শরণার্থী তৈরির এক মহড়া চলছে । ২০১৭ সালে সবচাইতে বেশি বাস্তুচ্যুতি ঘটেছে প্যালেস্টাইনে। ভারতের আসামে সম্প্রতি প্রকাশিত নাগরিকত্বের খসড়া তালিকা অনুযায়ী সম্ভবত ৪০ লাখের বেশি মানুষ তাঁদের ভারতীয় নাগরিকত্ব হারাতে যাচ্ছেন।যার সিংহভাগই মুসলিম।যদি তা বাস্তবায়িত হয়, তবে তার জন্য বাংলাদেশকে চাপে পড়তে হতে পারে । নিদিষ্ট ভূখন্ড ও রাষ্ট্রহীন বিশ্বনাগরিকদের মিছিলে আরও যোগ হবে ৪০ লাখ মানুষ । বিশ্বনাগরিকদের এ মিছিলের শেষ কোথায় ? এখনই উপযুক্ত সময় এর লাগাম টেনে ধরতে হবে ।
চার
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে বিশ্বব্যাপী জাতিগত দ্বন্দ্ব সংঘাত , যুদ্ধ , গৃহযুদ্ধ , জঙ্গি সংঘগঠনগুলোর আগ্রাসী উত্থান , হামলা , প্রাকৃতিক বিপর্যয় ইত্যাদি মূলত বিশ্বব্যাপী শরণার্থী সমস্যার মূল কারন । বিশ্বব্যাপী সংঘাত বন্ধ করতে জাতিসংঘের ভূমিকা যেমন গৌণ, তেমনি এর ফলে বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য সাহায্যের ভূমিকাটাও স্বল্প ।আঞ্চলিক শান্তি রক্ষায় জাতিসংঘ তদুপরি বিশ্বনেতাদের সচেতন হতে হবে । শরণার্থী সমস্যা সমাধানে একেবারে সুনির্দিষ্ট হয়ে এবং ধাপে ধাপে এগুতে হবে । ইউরোপের সীমানাগুলোতে মুক্তনীতি যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় সে জন্য ইইউ কে আইন করতে হবে এবং নজরদারি করতে হবে । হাঙ্গেরির মত কোন দেশ যাতে সীমান্তে কাঁটা তারের বেড়া না দেয় সেদিকে নজর দিতে হবে । ইউরোপের কম জনসংখ্যার দেশগুলোতে শরণার্থীদের স্থানান্তর করে তাদের পূর্ণ মানবীয় মর্যাদা দিয়ে বসবাস ও কাজকর্মের ব্যবস্থা করে দিতে । রোহিঙ্গাদের মত যেসব শরণার্থী একেবারে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিহীন , নাগরিকত্বহীন তাদের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র , রাশিয়ার মত দেশগুলোকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে ।শরণার্থী সমস্যার মূলোৎপাটন করার জন্য জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা এবং সর্বোপরি জাতিসংঘকে আরও বেশী কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে । শরণার্থীদের অধিকার সুরক্ষার মোক্ষম হাতিয়ার ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশন এবং ১৯৬৭ সালের প্রটোকলের সঠিক ব্যবহার করতে হবে । ১৯৪৮ সালের ইউনিভার্সাল ডিক্লায়ারেশন অব হিউম্যান রাইটস UDHR এর ঘোষণার বাস্তবায়নও জরুরি হয়ে পড়েছে । একবিংশ শতাব্দিতে যে সক্ষমতায় যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব মোড়লনের আসনে আসীন , সে সক্ষমতায় যুক্তরাষ্ট্র আরও মানবিক বিশ্বের জন্য কাজ করবে এবং শরণার্থী সমস্যার সমাধান করবে ,সেটাই বিশ্ববাসীর এটাই প্রত্যাশা ।
লেখক : জুবায়ের আল মাহমুদ
কবি ও শিক্ষার্থী IBA এমবিএ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
৩৭ তম বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত
(ঢাকারনিউজ২৪.কম/এসডিপি/৫:৩৪পিএম/২৫/৯/২০১৮ইং)
আপনার মতামত লিখুন :