• ঢাকা
  • শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ১০:১৫ অপরাহ্ন

‘রক্তের দাগ এখনো শুকায় নি’


প্রকাশের সময় : অগাস্ট ১৪, ২০১৮, ৭:৫৪ PM / ৩৯
‘রক্তের দাগ এখনো শুকায় নি’

মোঃ রাকিবুল ইসলাম : ‘রাত পোহালে যদি শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই’ সত্যিই যদি ৬ ফুট উচ্চতার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের মাঝে বেঁচে থাকতেন! যদি ৭ ই মার্চের কলরেডি মাইকের মতো প্রায় জনসভা করে এদেশের মানুষকে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক মুক্তির জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন, ন্যায় বিচার, সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে বলতেন আর মুক্তি পাগল বাঙালি যার যা আছে তাই নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তো তাহলে আজ বিশ্ব মানচিত্রে জাতির পিতা বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে যেতেন?

১২ জানুয়ারী ১৯৭২ থেকে ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ মাত্র ৩ বছর ৭ মাস ৩ দিনে বঙ্গবন্ধু একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তুলেছিলেন আপন মহিমায়। সমসাময়িক সময়ে যখন সমাজতন্ত্রের দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে দেশ গঠনে পার্শ্ববর্তী অনেক দেশ নিমগ্ন ছিল বঙ্গবন্ধুও পিছিয়ে ছিলেন না। শিক্ষা, অর্থনীতি, সমাজ নীতি, রাজনীতি কোনো সূচকেই যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পিছিয়ে রাখেন নি। দেশ স্বাধীনের মূল উদ্দেশ্য নিয়ে যখন এগিয়ে যাচ্ছিলেন এক দল হায়েনার তা সহ্য হয় নি।

বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যিঁনি দেশ দিলেন, যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গঠনে অপরিসীম অবদান রাখলেন তার প্রতিদান ছিল খুবই নির্মম। একদল উচ্ছৃঙ্খল সেনাবাহিনী অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারসহ ১৬ জনকে হত্যা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন সরলমনা, তিনি বিশ্বাস করতে পারেন নি যে জাতিকে জীবনের মূল্যবান ৪৬৮২ দিন জেলের নির্মম নির্যাতন নিপীড়ন সহ্য করে মুক্তির পথ দেখিয়েছিলেন তারা তাঁকে হত্যা করবে। ঘাতকরা এতোই নির্মম ছিল দোতলা থেকে নেমে যখন শেখ কামাল তাদের বলেছিলেন তোমরা কারা আমি রাষ্ট্রপতির ছেলে শোনা মাত্র ব্রাশ ফায়ারে শেখ কামালের কণ্ঠ নিঃস্তব্ধ করে দিয়েছিল। জাতির পিতা নিজেও বিশ্বাস করতে পারেন নি তাঁকে কেউ হত্যা করবেন এজন্যই কঠিন মূহুর্তেও ঘাতকদের বলেছিলেন -‘এখানে কি চাস তোরা, চলে যা’। সেদিন ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুর কাছে কিছু চাই নি কিন্তু আমাদের ৬ ফুট উচ্চতার বাংলাদেশকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। যে বাংলাদেশ আর কখনোই কলরেডি মাইক কাপিয়ে মুক্তি পাগল জনতাকে স্বপ্ন দেখতে শেখাতে পারে নি। একে একে জাতির পিতার পরিবারসহ ১৬ জনের রক্তপান করে সেদিনের ঘাতকেরা। ১০ বছরের শিশু রাসেলের আর্তনাদও সেদিন ঘাতকের কানে পৌছে নি। নিষ্পাপ রাসেল সেদিন মায়ের কাছে যেতে চেয়েছিল!

৩২ নম্বরের বাসভবন সেদিন রক্তে প্লাবিত করেছিল ঘাতকেরা। ঘাতকেরা সে রাতেই বঙ্গবন্ধুকে কবর দেবার জন্য গোপালগঞ্জের টঙ্গীপাড়া তে নিয়ে যায়। ঘাতকেরা সিদ্ধান্ত নেয় গোসল ছাড়াই দাফন করবে বঙ্গবন্ধুকে। কিন্তু পরবর্তীতে জাতির পিতাকে দ্রুত গোসল করাতে বলেন। ৫৭০ সাবান দিয়ে গোসল করানো হয় বঙ্গবন্ধুকে আর পার্শ্ববর্তী রেডক্রস হাসপাতাল থেকে রিলিফের সাদা কাপড় দিয়ে বানানো হয় কাফনের কাপড়। যে বঙ্গবন্ধুর ১৮ মিনিটের ৭ই মার্চের ভাষণ শোনার জন্য রেসকোর্স ময়দানে ১০ লক্ষ জনতা ভীড় করেছিল। ঘাতকের ভয়ে সেদিন বঙ্গবন্ধুর জানাযায় অংশ নিয়েছিল মাত্র ৩০ জনের মতো মানুষ।

৭৫ পরবর্তী সময়ে খোন্দকার মোস্তাক ইমডেমনিটি আদেশ জারি করে জাতির জনকের খুনিদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পুরস্কার স্বরূপ বিভিন্ন দূতাবাসে রাষ্ট্রদূত হিসেবে পাঠান। ৭৫ পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে দেবার জন্য সকল অপকর্মই অব্যাহত রাখে সামরিক জান্তারা। ২১ বছর পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী দেশরত্ম শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে ১২ নভেম্বর,১৯৯৬ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করেন। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী আ ফ ম মহিতুল ইসলাম বাদী হয়ে ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মামলা করেন। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর থেকে ২০০৯ সালের ২৪ আগস্ট পর্যন্ত বাদী-বিবাদীর আপিলের প্রেক্ষিতে চার দফায় রায় প্রকাশ হয়। সর্বশেষ আপিল বিভাগ ২০০৯ সালের ৫ অক্টোবর থেকে টানা ২৯ কর্মদিবস শুনানি করার পর ১৯ নভেম্বর ১২ জনের চূড়ান্ত মৃত্যুদন্ডাদেশের রায় ঘোষণা করেন। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর পাঁচ  খুনি লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর বজলুল হুদা, লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহম্মেদ (আর্টিলারি) ও লে. কর্নেল একেএম মহিউদ্দিন আহম্মেদ (ল্যান্সার) এর ফাসির রায় কার্যকর করা হয়। এছাড়ও এখনো ১২ জনের মধ্যে ছয়জন বিদেশে পালিয়ে রয়েছেন। পলাতকরা হলেন কর্নেল খন্দকার আব্দুর রশিদ, লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম, লে. কর্নেল এএম রাশেদ চৌধুরী, রিসালদার মোসলেম উদ্দিন, লে. কর্নেল এসএইচ নূর চৌধুরী ও অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আব্দুল মাজেদ। পলাতক আব্দুল আজিজ পাশা নামে পলাতক বঙ্গবন্ধুর খুনি ২০০১ সালে মারা যান।

জাতির জনকের পলাতক জীবিত ৬ জন আত্ম স্বীকৃত খুনিকে দেশে ফিরিয়ে এনে ফাসির রায় কার্যকর করার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে। চতুর্দশ লুই খ্যাত জাতির জনককে হত্যার পর বাঙালি কে আর বিশ্বাস করা যায় না। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম কবিতা লেখেন কবি অন্ন দাশঙ্কর রায়।  তিনি কবিতায় বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এভাবেই লিখেছেন- ‘নরহত্যা মহাপাপ, তার চেয়ে পাপ আরো বড় করে যদি তাঁর পুত্রসম বিশ্বাসভাজন’। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের ১৬ জনকে হত্যা করেই ঘাতকেরা থেমে থাকে নি জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে তাঁরই যোগ্য কণ্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী দেশরত্ম শেখ হাসিনাকেও ১৯ বার হত্যা করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়েছে ঘাতকেরা। ১৫ আগস্টের একটি বুলেট প্রতিনিয়ত করছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কে। সমস্ত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতিক জনকের ডিজিটাল সোনার বাংলা গড়ার জন্য দিন রাত পরিশ্রম করে চলেছেন। ৩২ নম্বর বাড়ির সিড়িতে পড়ে থাকা ১৮ টি বুলেট বিদ্ধ জাতির জনক ও তার পরিবারের রক্তের ছাপকে শক্তিকে পরিণত করে দেশ সেবা করে চলেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। ৭ ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে জাতির জনক বলেছিলেন- ‘রক্তের দাগ এখনো শুকায় নি’। মুজিব হত্যার রক্তের দাগ বাঙালির হৃদয় থেকে কখনোই মুছে যাবে না। বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা এই মহান মানুষটির সমস্ত ত্যাগ শক্তিতে পরিণত করে বাঙালি বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ কে একদিন সেরাদের সেরা বানাবে তা কেবল সময়ের অপেক্ষা মাত্র।

লেখক : মোঃ রাকিবুল ইসলাম
সাবেক শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

(ঢাকারনিউজ২৪.কম/এসডিপি/৭:৫৫পিএম/১৪/৮/২০১৮ইং)