• ঢাকা
  • শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ১২:০২ অপরাহ্ন

যিশু খৃষ্ট ছিলেন একজন ফিলিস্তিনি শরণার্থী


প্রকাশের সময় : ডিসেম্বর ২৭, ২০১৮, ২:২৪ PM / ৩৫
যিশু খৃষ্ট ছিলেন একজন ফিলিস্তিনি শরণার্থী

ঢাকারনিউজ২৪.কম, ডেস্ক : ‘যখন ফেরেশতাগণ বললো, হে মরিয়ম, আল্লাহ তোমাকে তাঁর এক বানীর সুসংবাদ দিচ্ছেন, যার নাম হলো মসীহ-মরিয়ম-তনয় ঈসা, দুনিয়া ও আখেরাতে তিনি মহাসম্মানের অধিকারী এবং আল্লাহর ঘনিষ্ঠদের অন্তর্ভূক্ত।’ (সূরা আলে-ইমরান, আয়াত: ৪৫)

ফেরেস্তারা মরিয়মকে ঈসার জন্মের বিষয়ে অবহিত করার ঘটনা কোরআনের যে জায়গায় বর্ণনা করা হয়েছে ওই অংশের কেমন একটা পবিত্র সৌন্দর্য আছে। ফেরেস্তারা তার কাছে সুসংবাদ নিয়ে আসেন এবং জানান, ‘তিনি মানুষের সাথে কথা বলবেন যখন তিনি মায়ের কোলে থাকবেন এবং পূর্ণ বয়স্ক হবেন। আর তিনি সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হবেন।’

এই খবরে মরিয়মের প্রতিক্রিয়ায় তার মহত্তম সরলতারই প্রকাশ ঘটেছে – ‘তিনি বললেন, হে পরওয়ারদেগার! কেমন করে আমার সন্তান হবে, আমাকে তো কোনো পুরুষ স্পর্শ করেনি? [জবাবে ফেরেশতা] বললেন, এভাবেই আল্লাহ যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। যখন কোনো কাজ করার জন্য ইচ্ছা করেন তখন বলেন যে, ‘হও’, অমনি তা হয়ে যায়।’ (সূরা আলে-ইমরান, আয়াত: ৪৭)

কোরআনে বলা আছে আল্লাহ নিজেই খৃষ্টকে ‘শিখিয়ে দেবেন কিতাব, হিকমত, তওরাত ও ইঞ্জিল।’ (সূরা আলে-ইমরান, আয়াত: ৪৮)

এগুলো এবং কোরআনের অন্যান্য আয়াতের ভিত্তিতে বলা যায় আল্লাহর প্রেরিত নবী হিসেবে ঈসার জন্মজয়ন্তী স্মরণ, উদযাপন ও আনন্দ প্রকাশে মুসলমানদের ধর্মীয় কোনও বাধা থাকার কথা নয়।

যুগে যুগে এক ‘ভিন্ন’ খৃষ্ট

ধর্মীয় গোঁড়ামি আর ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ এই পৃথিবীতে এই সবই আশ্চর্য ও বিজাতীয় মনে হতে পারে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ইউরোপীয়রা খৃষ্টকে নীল চোখ, কটা-চুলো শ্বেতাঙ্গ হিসবে চিত্রিত করার ফলে তার আসল পরিচয়টা এখন ইউরোপীয় বা উত্তর আমেরিকার খৃষ্টানদের পক্ষে মেনে নেয়া কঠিন। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন একটি ইহুদি ফিলিস্তিনি শিশু, যিনি বড় হয়ে অত্যুচ্চ বৈপ্লবিক এক ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।

প্রথিতযশা ইতিহাসবিদ জারোস্লাভ পেলিকান তার বই ‘জেসাস থ্রু সেঞ্চুরিজ: হিজ প্লেস ইন দ্য হিস্টোরি অফ কালচার (১৯৮৫)’- এ দেখিয়েছেন ইতিহাস জুড়েই খৃষ্টকে বিভিন্নভাবে চিত্রিত করা হয়েছে। ইহুদি র‍্যাবাই বা আইনজ্ঞ থেকে শুরু করে ‘বিধর্মীদের পথপ্রদর্শক’, ‘রাজাদের রাজা’, ‘আদমের সন্তান’, ‘পৃথিবীর শাসনকর্তা সন্ন্যাসী’, ‘বিশ্বজনীন মানব’, ‘শান্তির যুবরাজ’ প্রভৃতি অভিধায় ডাকা হয় তাকে। লেভ তলস্তয়, মহাত্মা গান্ধী ও মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রকেও অনুপ্রাণিত করেছেন তিনি।

বিশেষ করে লাতিন আমেরিকায় এবং মুক্তিবাদী ধর্মতাত্ত্বিকদের বর্ণনায় যিশু খৃষ্ট জগতের লাঞ্ছিতদের জন্য একজন বিপ্লবী নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।

পেরুর দার্শনিক, ধর্মতত্ত্ববিদ ও ডোমিনিকান যাজক গুস্তাভো গিতেরেজ যিশু খৃষ্ট সম্পর্কে আমাদের সমসাময়িক বোঝাপড়ায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছেন। আমি আমার ইসলামী মুক্তিবাদি ধর্মতত্ত্বেও ফাদার গিতেরেজের লেখনির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছি। প্রখ্যাত ইহুদি দার্শনিক ইমানুয়েল লেভিনাসের পর ফাদার গিতেরেজই বাইবেলের ভাষ্য থেকে ধর্ম প্রচারকদের বানী আমাদের সমসাময়িক জীবনে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন।

কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি বহু বছর ধরে ‘ডোন্ট বি অ্যাফ্রেইড: এ হন্ডুরান ওম্যান স্পিক্স ফ্রম দ্য হার্ট (১৯১৮৯)’ নামের একটি বই পড়াচ্ছি। এল্ভিয়া আলভারাদো নামের এক নারীর কাহিনী সমৃদ্ধ বইটিতে ‘যিশু একজন সংগঠক ছিলেন’ এই শিরোনামে চমকপ্রদ একটি অধ্যায় রয়েছে।

নাজারাথে জন্ম নেয়া ফিলিস্তিনি চলচ্চিত্র নির্মাতা এলিয়া সুলায়মান ‘সাইবার প্যালেস্টাইন’ নামের একটি স্বল্প দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বানিয়েছেন। এতে আমাদের সময়ে মেরি ও জোসেফের গাজা থেকে বেথলেহেমে যাওয়ার সংগ্রামের গল্প বলা হয়েছে। নিজেদের দেশেই ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার রুপক-কাহিনী ‘সাইবার ফিলিস্তিন’-এ ওই আমলে রোমান সেনাবাহিনী আর এখনকার জায়নিস্ট দখলদারিত্বের মধ্যেই খৃষ্টের জন্মগ্রহণের সাদৃশ্য ধরা পড়েছে।

খৃষ্টকে হন্ডুরাস থেকে আসা একজন ইহুদি ফিলিস্তিনি শ্রমিক সংগঠক শরণার্থী হিসেবে ভাবুন তো! ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টজেন নিয়েলসেন হয়ত তাকে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতেই দিবেন না।

প্রচলিত ইতিহাসের বিপরীতে

সুখের বিষয় হচ্ছে ইহুদি ধর্মমত ও ফিলিস্তিনের ওপর ভুয়া দাবী করা জায়নিজমের দিন এখন শেষ। ইউরোপের উপনিবেশবাদী বসতি স্থাপনকারীরা ইহুদিদের থেকে তাদের পূর্বপুরুষের ধর্মবিশ্বাস আর ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে তাদের ঐতিহাসিক জন্মভূমি লুণ্ঠনের চেষ্টায় যেসব মিথ্যা ছড়িয়েছে সেগুলো এখন বাতিল হচ্ছে। কারণ এখন ইহুদি ও ফিলিস্তিনিরা এবং ফিলিস্তিনি হিসেবে ইহুদিরা একত্রিত হয়ে জায়নবাদোত্তর এক দাবীতে তাদের প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস আর জন্মভূমির অধিকার জানান দিচ্ছে।

ঔপনিবেশিক দখলদারি আর স্বদেশ লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের লড়াইকে ‘ইহুদি আর আরবদের’ মধ্যে যুদ্ধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে এমন ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপে, যে ঈসাও যে একজন ফিলিস্তিনি ইহুদি র‍্যাবাই ছিলেন তা শুনলে তারা ভিমরি খান।

ফিলিস্তিনিরা যে ঐতিহাসিকভাবেই ইহুদি, খৃষ্টান ও মুসলমান এমন সাধারণ একটা সত্য এসব দেশের মানুষ হজম করতে পারে না। একইভাবে, যিশুখৃষ্ট আর মরিয়ম যে কোরআনের দুই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সেটাও তাদের কাছে অদ্ভুত মনে হয় এই গতানুগতিক মনোভাবের কারনে।

ঈসা একজন ফিলিস্তিনি ইহুদি ছিলেন যিনি আরামিক ভাষায় কথা বলতেন। এটা হিব্রু ও আরবির মতো একই ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।

তবে, কোরআনে যেভাবে ঈসার বর্ণনা দেয়া হয়েছে আর খৃষ্টধর্মে তার দৈব গুণাবলী সম্পর্কে যে ধারণা প্রচলিত আছে সেগুলোর মধ্যে মতবাদ-সংক্রান্ত পার্থক্য অবশ্যই রয়েছে। এখানে এটা মনে রাখা খুবই জরুরী যে ফার্সি কবিতা আর ইসলামি অতীন্দ্রিয়বাদ উভয়েই খৃষ্টকে ঐশ্বরিক কৃপার প্রতিমূর্তি হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে।

প্রখ্যাত সুফি দার্শনিক ইবনে আরাবি (১১৬৫-১২৪০) তার লেখায় ঈসা সম্পর্কে মুসলিম ও খৃষ্টানদের উপলব্ধির মধ্যে ঐকতান সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। তার সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘বেজেলস অফ উইজডম (ফুসুস আল হিকাম)’-এর অন্তর্ভুক্ত অধ্যায় ‘দ্য উইজডম অফ প্রফেসি ইন দ্য ওয়ার্ড অফ উইজডম’ এই ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

খৃষ্টধর্মে ঈশ্বরের পুত্র হিসেবে যিশু খৃষ্টের বর্ণনাকে ইবন আরাবি তার ‘অস্তিত্বের অখণ্ডতা’ মতবাদের মাধ্যমে সমন্বয়বিধান করেছেন: ঈসা আবির্ভূত হয়েছেন একজন ‘নিখুঁত মানব’ হিসেবে। ঈসা কর্তৃক মাটির পাখিতে প্রাণসঞ্চার করার যে বর্ণনা কোরআনে রয়েছে, সেটিকে তিনি উদ্ধৃত করেছেন তার ‘দৈব শক্তি’ নিদর্শন হিসেবে।

খৃষ্ট সম্পর্কে মুসলিম সুফিদের মতবাদ মতামত দেখলে আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারি ফিলিস্তিনের বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে যে বিদ্বেষের কথা বলা হয় সেটা একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত মিথ্যা। আমাদের প্রয়োজন সাহিত্যিক জ্ঞান, ইতিহাস সচেতনতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক দায়িত্ববোধ যা দিয়ে আমরা জাতিবিদ্বেষের পুরু দেয়াল ভেঙ্গে ফেলতে পারি। অজ্ঞ, ঘৃণা উদ্রেককারী ব্যক্তিরা আমাদের মধ্যে এই দেয়াল দাঁড় করিয়ে যাচ্ছেন।

সবাইকে ক্রিসমাসের শুভেচ্ছা! মনে রাখবেন যিশু খৃষ্ট একজন ফিলিস্তিনি শরণার্থী ছিলেন – একজন ইহুদি ফিলিস্তিনি শরণার্থী, যিনি খৃষ্টধর্মের প্রতিষ্ঠাতা এবং মুসলিমদের একজন প্রিয় নবী। বাকি সব ব্যাখান।

[আলজাজিরায় প্রকাশিত হামিদ দাবাশির কলাম ‘Remember: Christ was a Palestinian refugee’ অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ মামুনূর রশিদ। কোরআনের আয়াতগুলোর অনুবাদ দিয়েছেন মুহাম্মদ ফয়জুল্লাহ। ইরানে জন্মগ্রহণকারী হামিদ দাবাশি যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে ইরানিয়ান স্টাডিজ ও কম্পারেটিভ লিটারেচার বিষয়ে অধ্যাপনা করেন।]
(ঢাকারনিউজ২৪.কম/আরএম/২:২২পিএম/২৭/১২/২০১৮ইং)