• ঢাকা
  • রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ০৬:১৪ অপরাহ্ন

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের সিন্ডিকেট সক্রিয়


প্রকাশের সময় : ফেব্রুয়ারী ৬, ২০১৯, ১২:০৯ PM / ৪৫
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের সিন্ডিকেট সক্রিয়

 
ঢাকারনিউজ২৪.কম, ডেস্ক: দুর্নীতির অভিযোগে বন্ধ থাকা মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য খোলার আগেই শুরু হয়ে গেছে সিন্ডিকেটের আনাগোনা। আগের বার যারা কাজ পেয়েছিল তাদের হটিয়ে এবার নতুন গোষ্ঠী মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর কাজ পেতে চেষ্টা করছে। তাদের সমর্থক জনশক্তি ব্যবসায়ীর দাবি, সব রিক্রুটিং এজেন্সি যেন কাজ পায়, তারা সেই চেষ্টা করছেন। বিরোধীদের অভিযোগ, সিন্ডিকেট করার পাঁয়তারা চলছে।

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার আবার কবে বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য উন্মুক্ত হবে, কোন প্রক্রিয়ায় কর্মী যাবে; তা নির্ধারণের আগেই কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য মেডিকেল সেন্টার দেখতে বাংলাদেশে এসেছে মালয়েশিয়ার জনশক্তি ব্যবসায়ীদের একটি প্রতিনিধি দল। যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মালয়েশিয়ান ব্যবসায়ী দাতো শ্রী আবু হানিফ মো. আবুল কাশেম।

প্রতিনিধি দলটি গতকাল মঙ্গলবার প্রবাসীকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী ইমরান আহমদের সঙ্গে দেখা করে। পরে প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, এই প্রতিনিধি দলটি সরকারের আমন্ত্রিত নয়। প্রবাসী কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষায় মালয়েশিয়া সরকারের কোম্পানি রয়েছে। যারা এসেছেন, তারা ওই কোম্পানির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। তিনি তাদের বলেছেন, কর্মীই যাচ্ছে না, স্বাস্থ্য পরীক্ষা দিয়ে কী হবে। যদি কম খরচে কর্মীরা মালয়েশিয়া যেতে পারেন, তাহলে তাদের প্রস্তাব ভেবে দেখবেন। প্রতিমন্ত্রী তার এমন বক্তব্যের ব্যাখ্যায় বলেছেন, এ মুহূর্তে মালয়েশিয়ার কাছ থেকে কোনো প্রস্তাব নেই। প্রস্তাব এলে সিদ্ধান্ত নেবেন। তিনি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে।

মালয়েশিয়ার বন্ধ শ্রমবাজার খোলার পথ খুঁজতে গত অক্টোবরে দুই দেশের যৌথ কমিটির সর্বশেষ বৈঠক সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়েছিল। প্রতিমন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেছেন, আগামী মাসে ফের আলোচনা শুরু হবে বলে তিনি আশা করছেন। এর জন্য শিগগির মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে চিঠি দেওয়া হবে।

সাধারণ রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকরা সমকালকে জানিয়েছেন, গতবার মালয়েশিয়ায় অনিয়মের হোতা ছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ী দাতো শ্রী আমিন নুর। এবার তাকে হটিয়ে নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছেন দাতো আবু হানিফ। ২০১৫ সালেও হানিফ রিয়েল টাইম নামের একটি প্রতিষ্ঠানের হয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন জিটুজি প্লাসে কর্মী নেওয়ার কাজ পেতে। দু’পক্ষ মালয়েশিয়ার রাজনীতিকদের ঘনিষ্ঠ।

জানা গেছে, গতবার যেসব বাংলাদেশি এজেন্সি কাজ পায়নি এবার তারা রয়েছে দাতো আবু হানিফের পক্ষে। গতবার যে ১০ এজেন্সি কাজ পেয়েছিল তাদের অধিকাংশ হানিফের বিপক্ষে। গতবার কাজ পেয়েছিল আমিন ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস (লাইসেন্স নম্বর-৯৮১), ইউনিক ইস্টার্ন প্রাইভেট লিমিটেড (লাইসেন্স নম্বর-২১), ক্যারিয়ার ওভারসিস রিসোর্স (লাইসেন্স নম্বর-৪০৩), আইএসএমটি হিউম্যান রিসোর্স (লাইসেন্স নম্বর-১১৯৪), শানজারি ইন্টারন্যাশনাল (লাইসেন্স নম্বর-৭৪২), রাব্বি ইন্টারন্যাশনাল (লাইসেন্স নম্বর-২৫৮), ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল (লাইসেন্স নম্বর-৫৪৯), প্যাসেজ অ্যাসোসিয়েটস (লাইসেন্স নম্বর-৪৬৮), আল ইসলাম ওভারসিস (লাইসেন্স নম্বর-১০৬), প্রান্তিক ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম (লাইসেন্স নম্বর-৩১০)।

ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের মালিক ও রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন স্বপন সমকালকে বলেন, দাতো হানিফের নেতৃত্বে যে প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে এসেছে, তারা মালয়েশিয়ার সরকারের অনুমোদিত নয়। বলা হচ্ছে, তারা স্বাস্থ্য পরীক্ষা কেন্দ্র পরিদর্শনে এসেছে। কিন্তু তাদের এই এখতিয়ার কে দিয়েছে? বাজার উন্মুক্ত হওয়ার আগে তাদের বাংলাদেশে আসা জনশক্তি রফতানিকারকদের মধ্যে অবিশ্বাস তৈরি করবে।

জিটুজি প্লাসে দাতো আমিন নুরের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটকে সমর্থন দিলেও নিজেরা বাদ পড়ায় বিরোধিতা করছেন কি-না- এ প্রশ্নে রুহুল আমিনের দাবি, শুধু ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা নয়, তাদের বিরোধিতা করা হচ্ছে শ্রমবাজারকে স্থিতিশীল রাখতে। তিনি আরও বলেন, বাজার উন্মুক্ত হওয়ার আগে নিয়ন্ত্রণের লড়াইয়ের ফল ভালো হবে না। এসব কারণে শ্রমবাজার খোলার পথ বন্ধই থেকে যাবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সাধারণ শ্রমিকরা।

দাতো হানিফের সমর্থক হিসেবে পরিচিত বায়রার সাবেক সভাপতি আবুল বাশার সমকালকে বলেন, তিনি সিন্ডিকেটের বিরোধী। তিনি চান সব এজেন্সি কর্মী পাঠানোর কাজ পাক। যারা গতবার সিন্ডিকেট করেছিল তারাই এ উদ্যোগের বিরোধিতা করছেন। বায়রার বর্তমান সভাপতি বেনজির আহমেদও একই দাবি করেছেন।

সাধারণ জনশক্তি ব্যবসায়ীরা বলেছেন, দাতো হানিফের নেতৃত্বে মালয়েশিয়ার বেসরকারি স্বাস্থ্য পরীক্ষাকারীদের সংগঠন ফোমেমার প্রতিনিধিরা এসেছেন। তারা বাংলাদেশের ৪৫টি মেডিকেল সেন্টার পরিদর্শন করছেন। যেখানে মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়। এর মাধ্যমে তারা মূলত স্বাস্থ্য পরীক্ষার কাজের নিয়ন্ত্রণ পেতে চাইছেন। এতে সমস্যা নেই বলে দাবি করেছেন বায়রা মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান। তবে বাজার উন্মুক্ত হওয়ার আগেই স্বাস্থ্য পরীক্ষার কী প্রয়োজন- এ প্রশ্নের কোনো জবাব কারও কাছ থেকেই মেলেনি। দাতো হানিফও তার বাংলাদেশ সফর নিয়ে কথা বলেননি গণমাধ্যমের সঙ্গে।

অনিয়মের অভিযোগে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে মালয়েশিয়া। কিন্তু সাগরপথে মানব পাচার বেড়ে যাওয়ায় দীর্ঘ আলোচনার পর ২০১২ সালে সরকারি ব্যবস্থাপনায় (জিটুজি) কর্মী নিতে রাজি হয় মালয়েশিয়ায়। কিন্তু এ পদ্ধতি সফল না হওয়ায় ২০১৬ সালে বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে যুক্ত করে জিটুজি প্লাসে কর্মী নিয়োগে দুই দেশ সমঝোতা স্মারক সই করে।

মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের চাহিদাপত্র দেওয়ার কাজ পায় সিনারফ্ল্যাক্স নামের একটি কোম্পানি। বাংলাদেশের এক হাজার ২০০ রিক্রুটিং এজেন্সির মধ্যে মাত্র ১০টি কর্মী পাঠানোর কাজ পায়। এই ১১টি প্রতিষ্ঠানই পরিচিতি পায় ‘সিন্ডিকেট’ হিসেবে। বাংলাদেশের ১০ এজেন্সির কয়েকটি ছিল মন্ত্রী ও এমপিদের পরিবারের সদস্য ও ঘনিষ্ঠদের প্রতিষ্ঠান। জিটুজি প্লাসে ২০১৭ সালের মার্চে কর্মী যাওয়া শুরু হয়। গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেড় বছরে পৌনে দুই লাখ কর্মী এ পদ্ধতিতে মালয়েশিয়া যান।

জিটুজি প্লাসে কর্মীপ্রতি অভিবাসন ব্যয় সর্বোচ্চ এক লাখ ৬০ হাজার নির্ধারণ করা হলেও অভিযোগ রয়েছে, কেউই তিন লাখ টাকার কমে মালয়েশিয়া যেতে পারেননি। দুর্নীতির কারণে জিটুজি প্লাস পদ্ধতি দুই দেশেই সমালোচিত হয়। মাহাথির মোহাম্মদের নেতৃত্বে মালয়েশিয়ার নতুন সরকার গত বছর তদন্ত করে জানায়, জিটুজি প্লাসে পাঁচ হাজার কোটি টাকা অনিয়ম হয়েছে। দুই দেশের সিন্ডিকেট এই টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। দুর্নীতির কারণে জিটুজি প্লাস বাতিল করে মালয়েশিয়া। ফলে বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য বন্ধ হয়ে যায় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার।
(ঢাকারনিউজ২৪.কম/কেএস/১২:১০পিএম/৬/২/২০১৯ইং)