• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ১১:০৮ অপরাহ্ন

মালিবাগ ফ্লাইওভার তৈরিতে এ পর্যন্ত প্রাণ গেলো ৯ জনের


প্রকাশের সময় : মার্চ ১৩, ২০১৭, ১০:০৪ PM / ৪৭
মালিবাগ ফ্লাইওভার তৈরিতে এ পর্যন্ত প্রাণ গেলো ৯ জনের
  • নিজস্ব সংবাদদাতা

রাজধানীর মালিবাগে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারে ক্রেন ছিড়ে পড়া গার্ডারের নিচে চাপা পড়ে একজন নিহত হয়েছেন। তার নাম মো. স্বপন (৪০)। ঘটনায় পলাশ (৩৫) ও নুরুন্নবী (৪০) নামে আরও দুইজন আহত হয়েছে। রবিবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে ফ্লাইওভারে গার্ডার তোলার সময় ক্রেন ছিঁড়ে তা নিচে রেললাইনে পড়ে গেলে এই দূর্ঘটনা ঘটে। এতে সাড়ে ঘন্টা ধরে ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। ফযএই ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ শুরু থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন দূর্ঘটনায় ৮ জন শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন। এদের মধ্যে ৩ জন বিদ্যুতস্পৃষ্ঠ হয়ে, ৩ জন নির্মাণ কাজ চলাকালে গাড়ির ধাক্কায় এবং ২ জন নির্মাণ সামগ্রী মাথায় পড়ে নিহত হন। এছাড়া প্রায় ২০ জন শ্রমিক আহত হয়েছেন। রবিবার রাতে নিহত স্বপন কাঠমিস্ত্রি ছিলেন। তিনি স্থানীয় সততা ফার্ণিচার নামে একটি দোকানে কাজ করতেন। মাথায় প্রচন্ড আঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছে। তার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়ায়। এঘটনায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, রাত ২টার দিকে মালিবাগ রেলগেট এলাকায় নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের একটি গার্ডার তোলার সময় ক্রেন ছিড়ে ছিটকে নিচে পড়ে। এসময় গার্ডারের নিচে পড়ে স্বপন মারা যায়। আহত পলাশ ও নুরুন্নবীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পলাশ ফ্লাইওভারের কাজ করা তমা কনস্ট্রাকশনের প্রকোশলী।

ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের পরিদর্শক পলাশ চন্দ্র মোদক জানান, দূর্ঘটনার পরপরই ফায়ার সার্ভিসের ৫ টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌছায়। প্রায় ৭০ ফুট লম্বা গার্ডার রেললাইন বরাবর পড়ে যায়। এতে ঐ সময় ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ঘটনাস্থল থেকে তিন জনকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে স্বপন নামে একজন মারা যায়। ফায়ার সার্ভিস বড় যন্ত্রপাতি দিয়ে রেললাইনের ওপর থেকে গার্ডার কেটে সরিয়ে ফেলার কাজ শুরু করে। ভোর সাড়ে ৫ টার দিকে গার্ডার রেললাইন থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। এ সময়ে মধ্যে ঢাকা প্রবেশ করা আন্ত:নগর ট্রেনগুলোকে বিমানবন্দর, টঙ্গি ও আড়িখোলা রেলস্টেশনে থামানো হয়।

ঢাকা রেলপথ থানার এসআই রাশেদ রানা বলেন, রেললাইনের উপর গার্ডার পড়ে থাকায় ট্রেন চলাচল বিঘœ ঘটে। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা তিন ঘন্টার চেষ্টায় গার্ডারের একটি অংশ কেটে সরিয়ে নিলে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়। সোমবার ভোর সোয়া ৬টা থেকে ট্রেন চলাচল শুরু হলেও সিডিউলে কিছু পরিবর্তন হয়েছে।

স্থানীয় সততা ফার্নিচারের মালিক কবির হোসেন বলেন, প্রায় বিশ বছর যাবৎ তার দোকানে কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন স্বপন। তার দোকানে কাজের পাশাপাশি রাতে উড়ালসড়কের নির্মাণকাজ চলার সময় লোকজন যাতে চলাচল করতে না পারে সেজন্য চার ঘণ্টার চুক্তিতে সম্প্রতি কাজ করছিলেন স্বপন। এর মধ্যে দুর্ঘটনা ঘটে। স্ত্রী ও তিন ছেলে-মেয়ে নিয়ে ডিআইটি রোডের একটি বাসায় থাকতেন স্বপন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেছেন, রাজধানীর মালিবাগে মগবাজার ফ্লাইওভারের গার্ডার পড়ে একজনের মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া নিহতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে।

সোমবার মালিবাগে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে দুর্ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে মেয়র বলেন, ঘটনা তদন্তে এলজিইডির অতিরিক্ত তত্ত্বাবধায়ক আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে কমিটি কতদিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে কিংবা ক্ষতিপূরণের পরিমাণ কত হবে সে সম্পর্কে মেয়র কিছু বলেননি। তিনি বলেন, স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর পক্ষে দুর্ঘটনাস্থল দেখতে এসেছি। মন্ত্রী পরিষদের বৈঠক থাকায় এখানে তিনি আসতে পারেননি। এ ধরনের ঘটনা অনাকাঙ্খিত এবং অনভিপ্রেত। ঘটনায় কেউ দোষী প্রমাণিত হলে তাকে শাস্তির আওতায় আনা হবে। কাউকে এক বিন্দু ছাড় দেয়া হবে না। মেয়র বলেন, এটা হঠাৎ করেই ঘটে গেছে। এটা কারও কাম্য নয়। নিহতের পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। আহতদের সুচিকিৎসার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে। ফ্লাইওভার নির্মাণকাজ চলার সময় আশপাশে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল কি না এমন প্রশ্নের জবাবে সাঈদ খোকন বলেন, এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী আমাকে জানিয়েছেন প্রকল্প এলাকায় নিরাপত্তা পর্যাপ্ত ছিল।

দীর্ঘদিন ধরে ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ চলতে থাকায় রাজধানীর মালিবাগ-মৌচাক সড়কের বেহাল অবস্থা। ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজের কারণে সড়কের বিভিন্ন স্থানে তৈরি হয়েছে বড় বড় খানা-খন্দ-গর্ত। চরম ভোগান্তি মেনেই এই সড়কে প্রতিদিন যাতায়াত করতে হয় নগরবাসীকে। আর একটু বৃষ্টিতেই এসব গর্ত হয়ে ওঠে যেন মৃত্যুফাঁদ। প্রতিদিনই ঘটে দুর্ঘটনা। নগর পরিকল্পনাবিদরা মনে করছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় জনদুর্ভোগের বিষয়টি পরিকল্পনায় রাখা হলে এমন অবস্থা তৈরি হবে না।

২০১৫ সালের ৫ এপ্রিল ফ্লাইওভারের মগবাজার প্রান্তে নির্মাণ কাজ চলার সময় প্রভাতী-বনশ্রী পরিবহনের একটি বাসের ধাক্কায় মাজেদ মন্ডল ও আসাদুল মন্ডল নামে সহদোর নিহত হন। দুর্ঘটনার পর নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান তমা কনষ্ট্রাকশন কর্তৃপক্ষ জানায় যে, নিহত দুই শ্রমিকের ক্ষতিপূরুণ দেয়া হবে। গত বছরের ১৬ই মার্চ। মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারে মৌচাক মার্কেটের কাছে নির্মাণ যান্ত্রপাতির আঘাতে রাব্বী আহমেদ ইমন (২২) নামে এক শ্রমিক মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারায়। ঐ ঘটনায় তমা কনষ্ট্রাকশন কর্তৃপক্ষ বলে যে ইমনের গাফিলতির কারণেই নির্মাণ কাজ চলার সময় যন্ত্রপাতির আঘাতে তার মৃত্যু হয়। এরপর ২৫ মার্চ দুর্ঘটনা এড়াতে নিরাপত্তার নিশ্চিতের আদেশ দেন উচ্চ আদালত। কিন্তু তারপরও ঠেকানো যাচ্ছে না এই ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজে জীবনের প্রাণ হানির ঘটনা। ওই ১৬ জুন বিদ্যুতস্পৃষ্ঠ হয়ে সুমন নামে এক শ্রমিক মারা যান।

নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, যারা এই নির্মাণ কাজে যুক্ত বা কাজটি করছে তারা খুব একটা দায়িত্ববান বলে মনে হয় না। দক্ষতার অভাব হয়তো ছিলো, কিন্তু সেটা পুষিয়ে যেতো যদি ব্যবস্থাপনাটা সঠিক হতো। যথেষ্ট নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা হয়নি, সাবধানতা অবলম্বন করা হয়নি। নির্মাণের সময় আরো অনেক বেশি সাবধান হওয়া উচিত।

নিয়মানুযায়ী প্রতি বছর ক্রেনেরমতো ভারি যন্ত্রাংশগুলো পরীক্ষা করা উচিত। তবে এর চর্চা আছে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্স ইন্সটিটিউট এর অধ্যাপক শাহনেওয়াজ হাসনাত-ই-রাব্বী।

উল্লেখ্য, মগবাজার-মালিবাগ ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করা হয় ২০১৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। দুই বছরের মধ্যে নির্মাণ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনও শেষ হয়নি। পরে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্মাণের সময় বাড়ানো হয়। তবে এসময়ের মধ্যে কাজের তিনধাপের দুই অংশের অর্ধেক কাজই বাকি রয়ে যায়। চলতি বছরের জুন মাসের মধ্যে যেভাবেই হোক ফ্লাওভার নির্মাণ কাজ শেষ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ না হলে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিপূরুণ দিতে হবে।

এসএস/ক্যানি