• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ০৩:৩৬ পূর্বাহ্ন

মাদক পাচারে আর্ন্তজাতিক রুট এখন কুড়িগ্রাম


প্রকাশের সময় : সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৯, ৮:০৬ PM / ৩৬
মাদক পাচারে আর্ন্তজাতিক রুট এখন কুড়িগ্রাম

আতাউর রহমান বিপ্লব, কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি : কুড়িগ্রাম এখন মাদক দ্রব্য পাচারে আর্ন্তজাতিক রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে মাদককারবারীদের কাছে। সড়ক-নৌ পথ ব্যবহার করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় চলে যাচ্ছে এসব মাদকদ্রব্য। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রতিদিন হাজার-হাজার পিচ ইয়াবা,গাঁজা,মদসহ বিভিন্ন মাদক পাচার হচ্ছে।
দেশের উত্তর সর্বশেষ নদ-নদী আর সীমান্ত বেষ্টিত দারিদ্রতম জেলা কুড়িগ্রাম। জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে ৭টি উপজেলার সাথে ভারতের তিনটি রাজ্যের সীমান্ত রয়েছে ২৭৮.২৮কি.মি.। এরমধ্যে প্রায় ৩২কি.মি. সীমানায় কাঁটাতারের বেড়া নেই। নদী পথ রয়েছে ৩১৬কি.মি.। ভারতের পশ্চিম বঙ্গ ও আসাম রাজ্যের সীমানায় কুড়িগ্রাম-২২বিজিবি’র অধীনে ১৯৮কি.মি. সীমান্ত রেখা। জামালপুর-৩৫বিজিবি’র আওতায় সীমানা প্রায় সাড়ে ৪৬কি.মি. কাঁটাতারের ওপারে ভারতের আসাম ও মেঘালয় রাজ্য। ভারতের পশ্চিম বঙ্গ রাজ্যের সীমানায় লালমনিরহাট-১৫বিজিবি’র অধীনে ৩৬কি.মি. সীমান্ত। ফলে প্রতিদিনেই দীর্ঘ সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে আসছে বিপুল পরিমাণ মাদক। এসব মাদকের মধ্যে ইয়াবা,মদ,গাঁজা,ফেন্সিডিল,হেরোইনসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য। তবে পরিবহনে সহজ হওয়া সবচেয়ে বেশি আসছে ইয়াবা। আর মাদক পাচারে ব্যবহার করা হচ্ছে সীমান্তবর্তি এলাকার গরিব-নিরীহ মানুষদের। মাদক বহন ব্যবহার হচ্ছে নারী-পুরুষ,যুবক,কিশোর এবং শিশুদের। এতে করে মাদক প্রতিরোধে এক প্রকার হিমশীম খেতে হচ্ছে আইনশৃংখলা বাহিনীদের। ইতোমধ্যে রৌমারী উপজেলা দিয়ে নিরাপদ ও আন্তর্জাতিক রুট হিসেবে ব্যবহার করছে মাদক পাচারকারী চক্র গুলো। এখানে ভারতের আসাম-মেঘালয় রাজ্যের নিকটবর্তি পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় অনায়সে আসছে ইয়াবার বড়-বড় চালানসহ গাঁজা। রাতের আধারে বিএসএফসহ ভারতীয় মাদক ব্যবসায়ীরা কাঁটাতারের উপর দিয়ে ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইনসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য পার করে দেবার অভিযোগও উঠেছে। বাংলাদেশী মাদক ব্যবসায়ী সীমান্তের লোকজনকে অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে মাদকদ্রব্য নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন।
প্রশাসনের বিভিন্ন সংস্থা সুত্রে জানাযায়,জেলার ৭টি উপজেলার প্রায় ৬০টি পয়েন্ট এবং ভারতের ৪৫টি পয়েন্ট দিয়ে আসে মাদক। আর এসব মাদকদ্রব্য একাধিক হাতবদল হয়ে চিলমারী-রৌমারী এবং রাজিবপুর দিয়ে নৌ-সড়ক পথে চলে যাচ্ছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। নতুন কৌশল অবলম্বন করে বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ মাদকদ্রব্য সীমান্ত দিয়ে নিয়ে আসছে মাদক পাচারের একাধিক সিন্ডিকেট চক্র। এসব পয়েন্টে ভারত-বাংলাদেশের প্রায় দু’সহ¯্রাধিকেরও বেশি রয়েছে মাদক ব্যবসায়ী। আর রৌমারীতেই ছোট-বড় পাঁচ শতাধিকেরও বেশি। স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাব,সীমান্তবর্তি ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিসহ প্রশাসনের কিছু অসাধু ব্যক্তিদের মদদে ক্রমেই বাড়ছে মাদকের ব্যবসা। কম পরিশ্রমে অধিক টাকা পাওয়ায় প্রতিদিনিই নতুন-নতুন মুখ মাদক পাচারে জড়িয়ে পড়ছে। প্রশাসনের নজরদারী বৃদ্ধি করায় পাচারকারীরা নতুন কৌশল হিসেবে কিছু মাদক নিয়ে ধরা পড়ার অভিনয় করে বড়-বড় চালান পার করে নিয়ে যাচ্ছে সিন্ডিকেট চক্রটি।
অনুসন্ধানে জানাযায়, মাদক ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্ধ লেনদেন করছেন মাদক ব্যবসায়ীরা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ইয়াবা সিন্ডিকেট চক্র হুন্ডির মাধ্যমে ভারতে অর্থ পাঠাচ্ছেন। ফলে প্রায় প্রতিদিনেই আসছে ইয়াবা,গাঁজা,হেরোইন,ফেন্সিডিল,মদসহ মাদকদ্রব্য। তবে পরিবহনে সহজলভ্য হওয়ায় অন্যান্য সীমান্তর তুলনায় রৌমারীর সীমান্ত দিয়ে বিপুল পরিমাণে ইয়াবা ঢুকছে বাংলাদেশে। ভারত-বাংলাদেশের যেসব সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে আসছে মাদকদ্রব্য। বাংলাদেশের রৌমারী-রাজিবপুর উপজেলার প্রায় সাড়ে ৪৬কি.মি সীমান্ত এলাকা জুড়ে রয়েছে বালিয়ামারী,মাখনেরচর,আলগারচর,খেওয়ারচর,বকবান্দা,ঝাউবাড়ি,বড়াইবাড়ি, চরফুলবাড়ি, নওদাপাড়া,খাইটয়ামারী,চর বামনেরচর,বেহুলারচর,গয়টাপাড়া, চর বোয়ালমারী,ধর্মপুর,খেতারচর, চর গয়টাপাড়া ও ডিগ্রীরচর।
আর ভারতের সীমান্ত পয়েন্ট হলো-শিংমারী,শিশুমারা,আসামের আলগা,গোধুলী,দ্বীপচর, কুকুরমারা,দিয়ারারচর, ঢালেরচর, কুসনিমারা, জোরডাংগা,সোনারপারা,মানকারচর,কাঁকরিপারা,কালাইরচর।
ফুলবাড়ি উপজেলার ৩৬কি.মি. সীমান্ত এলাকায় গোরকমন্ডল,কিসনান্দ বকসী,বালাটারী,বজেরকুটি,খলিশ কোটাল, করুষা-ফেরুষা,গাজিরটারী,রৌসন শিমুলবাড়ী,নন্দির কুটি,জুম্মার মোড়,চাঁন্দের বাজার,থোসবিদ্যাবাগিস,চোত্তাবাড়ি মোড়,নাখারজান,আজোয়াটারী,কাশিয়াবাড়ি,কাশিপুর,অনন্তপুর এবং উত্তর অনন্তপুর।এখানে ভারতের সীমান্ত পয়েন্ট হলো-নয়ারহাট,মরাকুটি,খাবিদা হাবিদা,নারায়ণগঞ্জ,কিসামত করলা,দোল দেবিরপাট,ভাটিয়ারমোড়,বসকোটাল, থরাইখানা, ধাপরারহাট, সেউতি-১ ও সেউতি-২, চৌধুরীরহাট এবং সাহেবগঞ্জ।
নাগেশ^রীর উপজেলায় সীমান্ত এলাকা প্রসাদের কুটি,নাগরাজ,মডায়টারী,শিঙ্গের ভিটা,চাটাম,সুভারকুটি,বালাবাড়ি, ধলুয়ারবাড়ি,বালারহাট।এখানে ভারতের সীমানা পয়েন্ট হলো-বিন্নছড়া,নালিয়া,বামনহাট,চৌধুরীরহাট, গোলকগঞ্জ।
ভূরুঙ্গামারী উপজেলার সীমান্ত এলাকা শিংঝাড়,শালঝোড়,দিয়াডাঙ্গা,রাঙ্গালেরকুটি,বাগভান্ডার,বাশজানি,পাগলার হাট। এবং ভারতের সীমান্ত পয়েন্ট মশালডাঙ্গা, সাহেবড়ঞ্জ এবং কালজানি।
একাধিক সোর্স, মাদক ব্যবসায়ী এবং মাদক সেবীরা জানান,মাদক আসার প্রধান উৎসই হলো হুন্ডির টাকা। এই হুন্ডির টাকা বন্ধ করা গেলেই মাদক ব্যবসা অনেকাংশে কমে যাবে। রৌমারীর আলগারচর সীমান্তে ভারতীয় মাদক ব্যবসায়ী হলেন, ধুবড়ি জেলার মানকার চর থানার ফকিরবাট গ্রামের আমিরুল হক,সোনা মিয়া,ঝগড়ার চরের জহুরুলসহ প্রায় ৭/৮শ মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে। এরা ইয়াবা,গাঁজা,ফেন্ডিডিলসহ সব ধরনের মাদক সাপ্লাই করে। বর্তমানে আমাদের এখানে মাদক চক্রের সিন্ডিকেটের মূল হোতার পুরো নাম-ঠিকানা না বললেও জানান, জামালপুরের বঙ্গ।সে দেশের সব মাদক সিন্ডিকেটের সাথে জরিত। তার লোকজন দিয়ে ইয়াবাসহ মাদকের বড়-বড় চালান পার করে নিয়ে আসছে ভারত থেকে।সীমান্তে ভারতীয় সীম ব্যবহার করে বাংলাদেশী-ভারতীয় মাদক ব্যবসায়ীরা আলাপচারিতা করে। ফলে স্থানীয় প্রশাসনও বলতে পারে না কারা এগুলোর সাথে জরিয়ে পড়ছে। বিএসএফ কিংবা মাদক ব্যবসায়ীরা ফোনে যোগাযোগ করে দিনে বা রাতের বেলায় ক্রিকেট বলের মতো স্কচ টেপ পেচিয়ে, সিগারেটের প্যাকেটে করে, প্লাষ্টিকের ছোট-ছোট প্যাকেট ভরে ইয়াবা কাঁটাতারের উপর দিয়ে ঢিল মেরে ফেলে দেয়। আর বহনকারীরা সংকেত পেয়ে কৃষক বা রাখালের ছদ্মবেশে এসব মাদক নিয়ে আসছে অনায়সে। মাদক নিরাপদ স্থানে পৌঁছানোর জন্য ৫/১০ হাজার টাকার বিনিময়ে ভাড়ায় খাটাচ্ছে সীমান্ত এলাকার নারী-পুরুষ,শিশু-কিশোররা।এতে সীমান্তের অনেকেই রাতারাতি স¤পদের মালিক বনে যাচ্ছেন। সীমান্ত এলাকায় অর্থের লোভে পড়ে স্থানীয়রা জরিয়ে পড়ায় মাদক এখন সহজলভ্য হয়ে পড়ছে জেলার অধিকাংশ এলাকায়। অনেকেই মাদকের ভয়াল ছোবল থেকে ফেরত আসলেও মাদক বন্ধে প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে নারাজ। তারা বলেন, প্রশাসনের অনেকেই এখানে জড়িত থাকায় নিজেদের ক্ষতির আংশকার কারণে প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে অনিহা প্রকাশ করেন।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এক বিজিবি সদস্য জানান, আলগার চরে সিংহভাগ মানুষই মাদক ব্যবসার সাথে জরিত। রাতের বেলা বিএসএফ সীমান্তে লাইটের আলো কমিয়ে দিয়ে ইয়াবা পাচার করে। আমাদের বিজিবি টহল টিম বের হলে স্থানীয় মাদককারবারিরা ফোনে জানিয়ে দেয়। ফলে টহল টিমের বিপরীত দিকে পাচার করে। এখানে ইয়াবা পাচারে মহিলারাই বেশি জরিত। কেননা তারা গরু-ছাগলকে ঘাস খাওয়াতে গিয়ে ইয়াবার প্যাকেট বুকের মধ্যে বা শরীরের বিভিন্ন অংশে লুকিয়ে পার করে থাকে। স্থানীয় অনেক জনপ্রতিনিধি মাদক ব্যবসার সাথে জরিয়ে পড়ায় মাদক নির্মূল করা যাচ্ছে না। কঠোর পদক্ষেপ নিতে গেলে বিজিবি’সহ প্রশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে নেমে পড়ে। বিওপি’র সাথে এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই নাজুক। সোর্সের মাধ্যমে মাদক পাচারের খবর পেলেও যেতে না যেতে তারা পালিয়ে যায়। বর্ষা মৌসুমে আমাদের সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির মুখে পড়তে হয়। গ্রামের কাচা রাস্তা গুলো খাল খন্দে ভরা।ফলে কাঁদা মাটিতে টহল দিতে গিয়ে অনেক নাস্তানাবুদ হতে হয় বিজিবি সদস্যদের।
পুলিশ সুপার মহিবুল ইসলাম খান-বিপিএম জানান, সচেতনতা বৃদ্ধিসহ অভিযান জোরদাড় করা হয়েছে। মাদক ব্যবসায়ীসহ মানি লন্ডারিংকারীদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে এবং দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে তিনি আশ্বাস দেন।

ঢাকারনিউজ২৪.কম/আরএম/৮:০৩পিএম/১৭/৯/২০১৯ইং)