• ঢাকা
  • শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০২:৩৭ পূর্বাহ্ন

বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা শ্রদ্ধেয় কামাল লোহানী


প্রকাশের সময় : জুন ২০, ২০২০, ১:১৪ PM / ৩৬
বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা শ্রদ্ধেয় কামাল লোহানী

সোনিয়া দেওয়ান প্রীতি : করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী মারা গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)। মহান আল্লাহ রাব্বুল আল-আমীন তাঁকে বেহেস্ত নসিব করবেন এই প্রার্থণা করি। ছোটবেলা বাবার মুখেই প্রথম কামাল লোহানীর নামটা শুনেছিলাম। কামাল লোহানী, বংশী সাহা সহ প্রথম সাড়ির যত সাংবাদিকদের নাম ও তাদের সাহসীকতার গল্পগুলো খুব গর্বের সাথে বাবা আমাকে শোনাতেন। বিশ্বের কোথায় কোন নেতা কেমন, কোথায় কোন সাংবাদিক সাহসী রিপোর্ট করে দেশের জন্য ভাল কিছু করেছেন সেইসব জ্ঞান ভান্ডার ছিল আমার বাবা। তখন মনে হতো বাবার চেয়ে জ্ঞানী আর একজনও নেই আমার পৃথিবীতে। বাবা চেয়েছিলেন আমিও আরসব সাধারনের মাঝে অসাধারন কেউ হই, আমাকে নিয়েও সর্বত্র চর্চা হোক। লেখালেখির প্রতি আগ্রহটা সেখান থেকেই জন্মায় আমার। স্কুলের পড়াগুলো কমপ্লিট করার পাশাপাশি লিখতে থাকি জাতীয় দৈনিক, ম্যাগাজিন সহ বিভিন্ন মাধ্যমে। মা আমায় সব সময় লাল জামা, লাল চুরি, পায়ে নুপুর পরাতে চাইতেন। কিন্তু বাবা চুরির বদলে নতুন নতুন ডিজাইনের ঘড়ি এনে দিতেন। যে ডিজাইনের ঘড়িগুলো তখনও কেউ চিনতনা, সেগুলো পরে আমি স্কুলে যেতাম। শালীনতা বজায় রাখার শর্তে বাবা চাইতেন শাড়ি-চুরির চেয়ে জিন্স-টপস্ আর হাতে ঘড়ি পরি। কৈশোরে অন্যান্য কাজিন সিস্টার কিংবা বন্ধুদের বিয়ের হিরিক পরে গেলো যখন, মা তখন বাবার ভয়ে চুপি চুপি ঘটক এনে পাত্র দেখা শুরু করলেন। প্রায়ই দেখতাম ঘটকদের অপমান করে বাবা বাসা থেকে বের করে দিতেন। আমিও ধীরে ধীরে বাবার মতোই হয়ে উঠি। একটা সময়তো ঘটক বা বিয়ের অফার আসা দুরের কথা পাত্র বা ঘটক আমাকে দেখলেই ১০ হাত দুরে থাকত। পছন্দ থাকলেও ভয়ে কেউ এই বাড়িতে আসত না বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। আশপাশের এর ওর কাছে বলে বেরাতো। আত্মীয়দের কোথাও কোনো দাওয়াতে শুধু বাবাকে নিমন্ত্রণ করলে, বাবা সরাসরি বলে দিতেন- আমার আগে যদি আমার বড় মেয়েকে নিমন্ত্রণ করতে পারেন, তাহলেই আমাকে আশা করবেন, নয়ত আমাকে কোনো কাজে পাবেন না। ঠিক একইভাবে আত্মীয়-অনাত্মীয়দের বিচার শালিসে বাবা আমাকে সবার আগে নিয়ে যেতেন। বাবা বরাবরই চাইতেন আমি যেনো আরসব মেয়েদের মতো মেয়েলী না হয়ে উঠি, যেনো সমাজের বিশেষ ১০ জনের মাঝে একজন হয়ে উঠতে পারি। একজন মেয়ে মানুষের চেয়ে মানুষ হয়ে উঠি আমি। তাইতো সাংবাদিক কামাল লোহানী থেকে শুরু করে জ্ঞানীগুণিদের গল্পগুলো আমাকে শোনাতেন এবং একটু একটু করে সাহস যোগাতেন আমার মাঝে। সেই থেকে বিয়ের আগ পর্যন্ত নিজেকে কেবলই একজন ‘মানুষ’ ভেবেই এগিয়ে চলতাম আমি। বাসায় সব সময় জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলো রাখা হতো। পত্রিকার পাতায় ধর্ষণ, নির্যাতন সহ নেগেটিভ সব সংবাদগুলো পড়তে পড়তে চোখে অজস্র জল আর ভেতরে জেদ হতো ভীষণ। ভাবতাম ‘মানুষ এতটা নৃশংস হয় কি করে, আমাদের কি কিছুই করার নেই? আমরা কি রুখে দাঁড়াতে পারিনা সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে?’ সেই থেকে আজকের আমি। কিন্তু বাবার আশা পূরন করতে পারিনি। বার বার জীবন যুদ্ধে লড়াকু সৈণিক হয়েও আজও সাধারনের মাঝেই নিজেকে আবিস্কার করি। বয়সের সাথে বাবা অনেকটাই বদলে গেছেন, হয়ত বদলে গেছি আমিও। সময়ের বিবর্তনে দু’জনের মাঝে মতপার্থক্য দিন দিন যেমন বেড়েই চলেছে, তেমনি মানসিক দুরত্ব। আজ সাংবাদিক কামাল লোহানীর মৃত্যু সংবাদটা পাবার পর থেকেই সেই ছোট বেলার বাবা আর আমার গল্পগুলো মনে পরছে। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজকে বাবাকে মিস্ করছি ভীষণ। করোনা ভাইরাসের কারণে তাদের বাড়ি যাওয়া সম্ভব না, আবার এমনিতেও যাইনা ও বাড়িতে। হয়ত সব সময়ের মতো একবার ফোন করব, ‘কেমন আছেন, সব ঠিকঠাক তো’ বলেই ফোনটা রেখে দিব। কিন্তু সব সময়ের মতো বলতে পারব না- ‘আব্বু আমি ভীষণ ভয় পাচ্ছি, আপনাকে ভীষণ মিস্ করছি’। হয়ত বাবাও ভেতর থেকে আমার মতই ফিল করেন, বাইরে থেকে শুধু রাগি রাগি একটা ভাব। বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা শ্রদ্ধেয় কামাল লোহানী…..।
লেখক : সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী

(ঢাকারনিউজ২৪.কম/এসডিপি/১:১৪পিএম/২০/৬/২০২০ইং)