• ঢাকা
  • শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০৬:১৩ অপরাহ্ন

পুঁজিবাজার ও দেশের অর্থনীতি


প্রকাশের সময় : মার্চ ১৪, ২০১৭, ৭:৩৮ PM / ৩৫
পুঁজিবাজার ও দেশের অর্থনীতি
  • সাইদুর রহমান

একটি দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য পুঁজিবাজার হলো উওম মাধ্যম । শিল্প স্হাপন করতে চান, বিদূৎকেন্ড স্হাপন করতে চান, ব্রীজ নির্মাণ করতে চান আপনার জন্য শেয়ার বাজার হাত প্রসারিত করে বসে আছে । বিশ্বের উন্নত ও সমৃদ্ধশালী দেশের অর্থনীতিকে চালায় ঐ দেশের পুঁজিবাজার আর আমাদের দেশের পুঁজিবাজার চলে অর্থনীতির উপর ভর করে ।

১৯৯৬ সালে পুঁজিবাজার ধসের কথা শুনেছি ; দেখেনি । কিন্তু ২০১০ সালে শেয়ার বাজার ধসের ধ্বংস স্তুপের নীচে আমিও চাপা পড়েছিলাম। নিজের কষ্টের টাকা অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার দৃশ্য যে কত করুণ তা ভুক্তভোগীরাই শুধু জানেন । ১০ সালে শেয়ার বাজারের সুনামির ভয়াল চিত্র এখনও প্রতিটি বিনিয়োগকারীকে তাড়া করে বেড়াচেছ । কথায় আছে ” মানুষ পুত্র শোক ভুলে যায় কিন্তু টাকার শোক ভূলতে পারেনা “।আমাদের দেশের দুটি পুঁজিবাজারে ৯৬ ও ১০ সালে যে ধরনের ধস দেখা গেছে, তা বিশ্বের কোন পুঁজিবাজারে এ রকম পরিকল্পিত ধস নামেনি । শেয়ার বাজার মানেই উত্থান

-পতনের জায়গা । কিন্তু পতন যদি পরিকল্পিত ও চকমাফিক হয় সেটাকেই বলে পুকুর চুরি। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাজার হাজার কোটি টাকা সুসম গতিপথ দিয়ে প্রমাণ সাপেক্ষে, চালবাজী করে নিয়ে গেল । লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ বিনিয়োগকারী নিঃস্ব হয়ে গেল। টাকার শোকে কেউ পাঁচ তলা থেকে লাফ দিয়ে আত্বহত্যা করেছে, আবার কেউ সন্তানের মুখে খাবার দিতে না পেরে গলায়দড়ি দিয়েছে ।

তখনকার ডিএসই’র প্রেসিডেন্ট সহ সবাই মানুষকে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের জন্য ষাঁড়ের মতো চিল্লাতে থাকেন । আমার স্পষ্ট মনে আছে, তারা বলতেন , মিল – ইন্ডাস্ট্রি করতে চান, কোম্পানি বড় করতে, পদ্মা সেঁতু করতে চান পুজিঁবাজারে আসেন । আরও কত কিছু বলার মধ্যে বলতেন। আমাদের দেশের পুঁজিবাজার আন্তর্জাতিক মানের । উনারা হয়তো বা জানতেন না , আমাদের দেশের শেয়ার বাজারের গেইমলাররা সেই আন্তর্জাতিক মানের স্কুলের হেড মাষ্টার । তারপর কিছু দিন পর ডিএসই থেকে মাইক যোগে ঘোষণা দিলেন, দেশের প্রতিটি থানাতে ব্রোকার হাউজ খুলা হবে । কারে কে থামায় । দেশের মানুষ তাদের ভাষণ শোনে হাড়ি-পাতিল, স্বর্ণ অলংকার বিক্রি করে শেয়ার বাজার বিনিয়োগ করলেন ।এ দিক দিয়া বাজারে শেয়ার কম থাকায় নতুন নতুন বিনিয়োগকারীদের চাপে শেয়ার বাজারের পাল আকাশে উড়তে লাগলো । সেই সুযোগে শেয়ার বাজারের অর্থ ভক্ষণকারী ও অশুভ শক্তি মিলেমিশে একটা শক্ত বলয় তৈরী করলো । সমস্ত শেয়ার অতিমূল্যায়িত হয়ে গেল । কতৃপক্ষ তখনও পুঁজিবাজার অতিমূল্যায়িত হয়েছে, এ কথা স্বীকার করতে নাজার ছিলেন ।

সমস্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও গেইমলাররা ধীরে ধীরে তাদের শেয়ার বিক্রি করে দিলেন । বাজারে আর বায়ার পাওয়া গেলনা । ক্ষোভে- বিক্ষোভে ফেটে উঠলো সারা দেশের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। রাস্তায় নামলো, বাজার স্বাভাবিক অবস্হায় ফিরিয়ে আনার দাবীতে ।ন্যায্য কথা বলতে গিয়ে অন্যায্য ভাবে নির্যাতিত ও গ্রেফতার হয় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা । আমাদের আন্দোলন নিয়ে সরকারের কত নাটক দেখলাম । তারপর তদন্তের নামে আরেক নাটক শুরু হলো । তদন্ত করে দোষীদের বের করবে এবং টাকা উদ্ধার করবেন । তদন্তকারীরা গ্রহণযোগ্য একটা তদন্ত প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দিলেন । হয়তো বা বর্তমান সরকার দোষীদের রক্তচক্ষুর ভয়ে অথবা দরবেশ নারাজ হবেন এই চিন্তায় শেয়ার বাজার লুটতরাজদের বিচার করেনি । শেয়ার বাজার ভক্ষণকারী ব্যক্তিরা এখন বিশ্বের ধনকুবের খাতায় লেখান । তখন দিশেহারা হয়ে অর্থমন্ত্রী বিনিয়োগকারীদেরকে বলেন রাবিস আর অর্থ উপদেষ্টা বলেন ফটকাবাজদের বাজার । যখন রাজস্ব নেন তখন এই সব বাজে কথা গুলি মনে পরলে ভালো হতো ।

যাক আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসলেই শেয়ার বাড়ে আর শেয়ার বাজারে ধস নামে। মৃত শেয়ার বাজারকে পুনঃজীবিত করার জন্য সরকার বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহন করেন। গাছের শিকড় না থাকলে বর্ণহীন গাছ শুধু দাঁড়িয়ে থাকতে পারেই কিছুদিন, কিন্তু অক্সিজেন দিতে পারে না। তেমনি শেয়ার বাজার ছিল কিন্তু টাকা আর বিশ্বাসের একটা বড় ধরনের অভাব দিল । ২০১০ সালে পাঁচ ডিসেম্বর শেয়ার বাজারে ধস নামা শুরু করে । এরপর চলে টানা সাড়ে ছয় বছর । শেয়ার বাজার তলাবিহীন ঝুড়ি বানানোর পর যুগান্তকারী অনেক গুলি সিদ্ধান্ত সরকার ও সংশ্লিষ্ট মহল গ্রহণ করেন । যেমন সূচককে তিনটি ভাগে ভাগ করা, সব শেয়ারের ফেইসভেলু এক করা , সার্কিট বেকার উঠা- নামার ক্ষেত্রে হার সমান করা , একটায় লট করা, ব্রোকারিজ হাউজের কমিশন কমানো, জেট ক্যাটাগরির শেয়ারকে রিমান্ডে নেওয়া ইত্যাদি । ইতিমধ্যে সরকার আরেকটা নতুন বিনিয়োগকারী খুঁজে পান সেটা হলো ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারী।

সব কথার বড় কথা হলো পুঁজিবাজার স্পর্শকাতর জায়গা। সবাইকে জ্ঞান দান থেকে বিরত থাকতে হবে । তারপর প্রাসঙ্গিক কথা হলো পুৃঁজিবাজাকে স্হিতিশীল রাখতে হলে দুটি খাতকে মূর্খ ভূমিকা পালন করতে হবে ,

একটি হলো মিউচুয়াল ফান্ড অন্যটি হলো ব্যাংকিং খাত । তারসাথে আংশিক ভূমিকা রাখে নন-ব্যাংকিং আর্থিকখাত ও বীমাখাত ।বর্তমানে মিউচুয়াল ফান্ড গুলির শেয়ারের দাম অভিহিত মূল্যের চেয়ে অনেক কম ।

অথচ তারা নিয়মিত লভাংশ দিচ্ছে । আবার ব্যাংকখাতের কোম্পানি গুলি বিগত বছরে যে হারে লভাংশ দিচ্ছে তাতে করে শেয়ারের দাম অভিহিত মূল্যের চেয়ে তিন চার গুন বেশী হওয়ার কথা । কিন্তু এখনও অনেক ব্যাংকের শেয়ারের দাম ফেইসভেলুর চেয়ে সামান্য বেশী । এ দিক দিয়া দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংক গুলো মেয়াদি আমানতে, বছরে সুদ দিচ্ছে ৩.৫%থেকে ৫% । এতে করে মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখতে অহিনা দেখাচ্ছে। অপর দিকে ব্যাংকে দিনে দিনে টাকার তারল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।

২০১০ সালে ডিসেম্বর মাসের তারিখে ডিএসই সূচক ছিল ৮৯১৪৫ পয়েন্ট , মোট কোম্পানি ছিল ২৪৪টি, মোট লেনদেন ছিল ৩৩ কোটি টাকা। তখন পি/ই রেশিও ছিল বেশী।

অন্যদিকে ২০১৭ সালে ডিএসই সূচক ৫৬০০ পয়েন্ট, মোট কোম্পানি ৩৩২ টি আর মোট লেনদেন এক হাজার কোটি টাকার মতো । পি/ই রেশিও বেশ ভালো। এই সাত বছরে অনেক কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকা ভুক্ত হয়েছে । সূচক কিংবা লেনদেন কোনটাই আগের কোটায় পৌঁছাতে পারেনি ।তাই বর্তমানে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে ঝুঁকি কম ।

সাধারণ বিনিয়োগকারীদেরকে রক্ষার জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট মহলকে নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করতে হবে। বিশেষ করে এই দিক গুলি কঠোরভাবে নজরদারি করতে হবে। যেমন : পুঁজিবাজার থেকে উত্তেলিত অর্থ শিল্পখাত ছাড়া অন্য কোথাও ব্যবহার রোধ করতে হবে, আই পি ও তে দুর্নীতি বদ্ধ করতে হবে, প্রিমিয়াম নেওয়ার নামে কোন শেয়ার পুঁজিবাজারে আসার আগেই অতিমূল্যায়িত করা রোধ করতে হবে, প্রতিটি কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন সঠিক ভাবে প্রদানে বাধ্য করতে হবে ।

শক্তিশালী ও স্হিতিশীল পুঁজিবাজারের জন্য ডিএসই, সিএসই, বাংলাদেশ ব্যাংক অথাৎ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে সৎ ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করতে হবে।

” পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে ঝুঁকি আছে , আগে ভালো ভাবে জানুন, তারপর দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করুন “।

লেখক : কলামিস্ট
এবং আহবায়ক
ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ফোরাম চট্রগ্রাম ।