• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ০৭:৪৬ পূর্বাহ্ন

নাছির-নওফেল দু’জনকেই প্রধানমন্ত্রীর কঠোর বার্তা


প্রকাশের সময় : ফেব্রুয়ারী ১৮, ২০২০, ১১:৩২ AM / ৪৫
নাছির-নওফেল দু’জনকেই প্রধানমন্ত্রীর কঠোর বার্তা

 
চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগে কোন্দল মেটাতে কঠোর হলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্থানীয় রাজনীতির গ্রুপিংয়ে নেতৃত্ব দেওয়া উপমন্ত্রী নওফেল ও মেয়র নাছিরকে আস্তে আস্তে ‘ক্ষমতাহীন’ করছেন তিনি। শিক্ষা উপমন্ত্রীর পাশাপাশি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগে সাংগঠনিক সম্পাদকের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। দুই মাস আগে তাকে সেই পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এবার প্রধানমন্ত্রী একই শিক্ষা দিলেন বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনকে। তার বদলে চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে তৃণমূল থেকে মেয়র প্রার্থী করেছেন স্বচ্ছ ভাবমূর্তির রেজাউল করিম চৌধুরীকে। দলীয় কোন্দলে ইন্ধন দেওয়াতেই দুই মাসের ব্যবধানে চট্টগ্রামের আলোচিত দুই নেতার এভাবে ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয় রাজনীতি বিশ্নেষকরা।

চট্টগ্রামের প্রায় প্রতিটি কলেজে নাছির ও নওফেলের অনুসারী আলাদা দুটি গ্রুপ সক্রিয় আছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেলেও একই অবস্থা। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নাছির ও নওফেলের অনুসারীরা একাধিকবার সংঘর্ষে জড়িয়েছে। ছাত্রলীগ দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই গ্রুপিং শুরু হলেও এখন এটি বিস্তার লাভ করেছে যুবলীগ, মহিলা লীগ, এমনকি শ্রমিক লীগেও। মূল রাজনীতির বাইরে দুই নেতার অনুসারীরা এভাবে উপদলে বিভক্ত থাকায় সাংগঠনিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আওয়ামী লীগ।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ইফতেখার উদ্দীন চৌধুরী বলেন, ‘ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে অনেকবার বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। নাছির ও নওফেলের অনুসারী বলে তারা বিবাদে লিপ্ত হলেও এতে বড় দুই নেতার সায় আছে বলে মনে করি না। মূলত তাদের নাম ব্যবহার করে সুবিধাভোগী ছাত্র নেতারা নানাভাবে ফায়দা নিতে বিবাদে জড়ায়। আমি দায়িত্বে থাকাকালীন বিষয়টি অনেকবার কেন্দ্র পর্যন্ত গড়িয়েছে। কেন্দ্র থেকে উভয় গ্রুপের অনেককে বহিষ্কারও করা হয়েছে। তারপরও বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রুপিংটা নির্মূল করা যায়নি। কিছুদিন আগেও তারা ক্যাম্পাসে সংঘর্ষে জড়িয়েছে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক শিরীণ আখতার বলেন, ‘ব্যারিস্টার নওফেল ও মেয়র নাছিরের গ্রুপ পরিচয় দিয়ে কয়েকদিন আগেও বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। অথচ দুই নেতাই আমাকে স্পষ্টভাবে বলেছেন, তাদের কোনো গ্রুপ নেই। যারা তাদের পরিচয় দিয়ে অন্যায় কিছু করে, তাদের আইনিভাবে মোকাবিলা করতে।’

আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দীন চৌধুরী বলেন, ‘গ্রুপিং যে কোনো দলের জন্য বিষফোড়া। এটা যত চাঙা থাকে, মূল দলের শক্তি তত কমে।’ একই মত দিয়েছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন চট্টগ্রাম জেলা শাখার সভাপতি অধ্যাপক সিকান্দার খান। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন নেতার অনুসারী হয়ে গ্রুপিং করা হলে মূল দলের সাংগঠনিক শক্তি দুর্বল হয়ে যায়। হয়তো এ কারণে এবার তৃণমূলের এক নেতাকে মেয়র পদে মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ। সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেও এমন ধারণা পেয়েছি আমি।’

গ্রুপিং ক্ষতিকর জেনেও চট্টগ্রামের রাজনীতিতে এটি এখন শুধু বিষফোড়া নয়, বিষবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার অনুসারীরা গুরু মানতে শুরু করে মহিউদ্দিন-তনয় ব্যারিস্টার নওফেলকে। এবার চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনের মেয়র পদে ১৯ জনের মনোনয়নপত্র নেওয়ার নেপথ্যেও ছিল এই গ্রুপিং। ব্যারিস্টার নওফেল নিজে মেয়র পদে মনোনয়নপত্র না নিলেও তার অনুসারীরা দল বেঁধে ফরম নিয়েছেন নাছিরকে ঠেকাতে। আবার নাছিরের অনুসারীরাও নওফেলপন্থিদের ঠেকাতে একই পথ বেছে নিয়েছেন। এটির রেশ পড়েছে কাউন্সিলর পদে প্রার্থীদের মধ্যেও। ৫৬টি কাউন্সিলর পদে তাই ফরম নিয়েছেন ৪০৬ জন। অতীতে চট্টগ্রামের কোনো নির্বাচনে এত বেশি সংখ্যক মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিল না।

প্রয়াত মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছিরের দূরত্ব তিন দশকের। সময়ের পরিক্রমায় এই কোন্দল আরও তীব্র হয়েছে। চট্টগ্রামের রাজনীতিতে একসময় অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। একপর্যায়ে তার সেই সাম্রাজ্যে হানা দেন আ জ ম নাছির। মহিউদ্দিন চৌধুরীর বিরোধিতার পরও মেয়র হওয়ার পাশাপাশি নগর আওয়ামী লীগে সাধারণ সম্পাদক পদও বাগিয়ে নেন তিনি। এটিকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেননি মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীরা। তাই নাছির মেয়র ও সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর কোন্দল নামক বিষবৃক্ষ আরও শাখা-প্রশাখা বিস্তার করতে থাকে। এই বিরোধ নিরসনে দুই নেতাকে অনেকবার সতর্কও করা হয়েছে কেন্দ্র থেকে। কিন্তু নাছির-নওফেল কেউ তাতে কর্ণপাত করেননি। এর ফলও তারা পেয়েছেন। নওফেলকে হারাতে হয়েছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ। আর নাছির বঞ্চিত হলেন মেয়র পদে প্রার্থিতা থেকে।

নািছর-নওফেলের গ্রপিংটা চট্টগ্রামে দিবালোকের মতো সত্য হলেও তারা দু’জন এটি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেননি কখনই। মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার আগে চট্টগ্রামের এক অনুষ্ঠানে ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেছিলেন, ‘চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগে কোনো গ্রুপিং নেই। মেয়র পদে যাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে, তার পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করব আমরা সবাই।’

আবার একই সময় স্থানীয় গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নওফেল বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছিরের নানা কর্মকাণ্ডের সমালোচনাও করেন। তিনি বলেছেন, ‘বর্তমান মেয়র তো আলোচনার মাধ্যমে কোনো কাজ করেন না। সবকিছু একা করতে চান। নগরের এমপিদের নিয়েও তিনি কোনোদিন এক টেবিলে বসেননি। কোনো কাজে সমন্বয় নেই। সরকার প্রচুর টাকা বরাদ্দ দিলেও তার সুফল তাই সেভাবে পাচ্ছে না জনগণ।’

মনোনয়নপত্র বিতরণের আগে সমকাল কার্যালয়ে এসেছিলেন আ জ ম নাছির। গ্রপিং প্রসঙ্গে তখন তিনি বলেছিলেন, ‘কেউ যদি গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে চায়, আমার তখন কী করার থাকে। প্রধানমন্ত্রী ২০১৫ সালে আমাকে মেয়র পদে মনোনয়ন দিয়েছেন। নগরের সাধারণ সম্পাদক বানিয়েছেন। সেটি যদি কেউ চ্যালেঞ্জ করে গ্রুপিংয়ে ইন্ধন দেয়, তখন আমার হাতে আর বিকল্প কী থাকে?’

সরাসরি স্বীকার না করলেও দুই নেতার এমন কথোপকথনই বলে দিচ্ছে, নগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে কতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল গ্রুপিং। দুই নেতার ক্ষমতা কমিয়ে এবার যেন সেই গ্রুপিংয়ের রাশ টানতে চাইলেন প্রধানমন্ত্রী।

(ঢাকারনিউজ২৪.কম/কেএস/১১:৩২এএম/১৮/২/২০২০ইং)