• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৩ মে ২০২৪, ০৫:২৫ পূর্বাহ্ন

দূষিত ভেজাল খাদ্য : অন্ননালিতে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে ক্যান্সার!


প্রকাশের সময় : জানুয়ারী ১৮, ২০২০, ১:৫২ PM / ৫২
দূষিত ভেজাল খাদ্য : অন্ননালিতে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে ক্যান্সার!

সুমন আফসার ও ফয়জুল্লাহ ওয়াসিফ : দেশে আশঙ্কাজনকভাবে অন্ননালির ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। পুরুষ কিংবা নারী উভয়ের ক্ষেত্রেই এ রোগে আক্রান্তের হার বাড়ছে সমানতালে। একসময় পুরুষের ফুসফুসের ক্যান্সার ও নারীর ক্ষেত্রে জরায়ুর ক্যান্সারের প্রবণতা ছিল বেশি। তবে বর্তমানে এ চিত্র পাল্টেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য বলছে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ক্যান্সারে আক্রান্তের প্রায় ১৪ শতাংশই অন্ননালির ক্যান্সারের রোগী।

অন্ননালির ক্যান্সারে আক্রান্তের হার বাড়ার পেছনে খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, দূষিত ও ভেজাল খাদ্য গ্রহণই বেশি দায়ী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, খাবারের কাঁচামাল থেকে শুরু করে ব্যবহূত ভোজ্যতেল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানহীন। আর এসবে তৈরি খাবারই থাকছে প্রতিদিনকার খাদ্যতালিকায়। খাদ্যে ভেজাল দেয়ার প্রবণতাও পেয়েছে বহুমাত্রিকতা। খাবার ও ফলমূল আকর্ষণীয় এবং দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করতে ক্ষতিকর কার্বাইড, শিল্পে ব্যবহূত রঙ, ফরমালিন, প্যারাথিয়ন ব্যবহার করছেন ব্যবসায়ীরা। বেকারির পণ্য ও মসলায় মেশানো হচ্ছে কাপড়ে ব্যবহূত বিষাক্ত রঙসহ অন্যান্য রাসায়নিক। দূষিত ও ভেজাল এসব খাবার সাময়িক অসুস্থতার পাশাপাশি ক্যান্সারের মতো দীর্ঘমেয়াদি রোগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

শুধু তা-ই নয়, নানা ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিকের উপস্থিতিও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অন্ননালির ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত শিল্প-কারখানায় ব্যবহূত রাসায়নিকযুক্ত পানি পরিশোধন ছাড়াই ফেলা হচ্ছে পার্শ্ববর্তী নদী বা জলাশয়ে। এসব অঞ্চলে সেচের পানি ও তা থেকে উৎপাদিত বিভিন্ন শাকসবজিতে আর্সেনিকসহ অন্যান্য ভারী মৌলের উপস্থিতি থেকে যাচ্ছে। এরই মধ্যে ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদানের উপস্থিতি থাকায় দেশে উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রফতানিতে একাধিকবার নিষেধাজ্ঞাও এসেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পাঁচ বছরে শুধু ইউরোপের বাজারে রফতানি হওয়া ফল ও সবজিতে শনাক্ত হয়েছে ৬০০-এর বেশি ক্ষতিকারক উপাদান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. নাজমা শাহীন এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, অন্ননালির ক্যান্সারের জন্য ভেজাল খাবার অনেকাংশেই দায়ী হতে পারে। কারণ আমাদের দেশে ফুড গ্রেড না মেনে অনেক খাবারই তৈরি হচ্ছে, যা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা অনুচিত। বিভিন্ন ধরনের খাবারে ফুড গ্রেডের বদলে ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রেডের রঙ, লবণ বা চিনি ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে তদারকির অভাব রয়েছে। খাবারের মান নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হলে রোগীর সংখ্যা কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।

ডব্লিউএইচওর তথ্যমতে, বাংলাদেশে ২০১৮ সালে নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে দেড় লাখের বেশি মানুষ। এর মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৮৩ হাজার ৭১৫ আর নারীর সংখ্যা ৬৭ হাজার ৬৬। নতুন এসব রোগীর ১৩ দশমিক ৯ শতাংশই অন্ননালির ক্যান্সারে আক্রান্ত। এ সংখ্যা ২০ হাজার ৯০৬। অন্ননালির পর সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে ঠোঁট বা মুখগহ্বরের ক্যান্সারে। এ সংখ্যা ১৩ হাজার ৪০১, যা মোট আক্রান্তের ৮ দশমিক ৯ শতাংশ। স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে ১২ হাজার ৭৬৪ জন নারী, যা মোট রোগীর সাড়ে ৮ শতাংশ। জরায়ুর ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীর সংখ্যা ৮ হাজার ৬৮। এটি মোট আক্রান্তের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আর ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে ১২ হাজার ৩৭৪ জন, যা মোট আক্রান্তের ৮ দশমিক ২ শতাংশ। এর বাইরে বছরটিতে অন্যান্য ক্যান্সারে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে মোট ৮৩ হাজার ২৬৮ জন।

খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন হওয়ায় অন্ননালির ক্যান্সারের রোগীর সংখ্যা বাড়তে পারে বলে মনে করেন জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের ক্যান্সার এপিডেমিওলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন। তিনি বলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা জেনে কিংবা না জেনে শরীরের জন্য ক্ষতিকর খাদ্য গ্রহণ করছি। নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি বেশ কিছুদিন ধরে আলোচনায়ও রয়েছে। ডব্লিউএইচওর প্রতিবেদনটি বিবেচনায় নিয়ে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে। অন্ননালির ক্যান্সার রুখতে জনসচেতনতার বিকল্প নেই।

দেশে সার্বিকভাবে ক্যান্সারের রোগী বাড়ার পেছনে অন্য যেসব কারণ রয়েছে, তার অন্যতম হলো বায়ু ও পানি দূষণ। দূষণজনিত কারণে ফুসফুস, স্কিন ক্যান্সার, কিডনি ও মূত্রনালির ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এছাড়া আর্সেনিকের দূষণ, বংশগত জীবাণু বহন, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, মানহীন খাবার, স্বাস্থ্যসচেতনতার অভাবেও রোগটিতে আক্রান্ত হচ্ছে অনেকেই।

ডব্লিউএইচওর তথ্য বলছে, ৭৫ বছরের কম বয়সী মানুষের ক্ষেত্রে ক্যান্সারে আক্রান্তের হার ১১ দশমিক ৪ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষ ক্যান্সার রোগীর হার ১২ দশমিক ৯ আর নারী ক্যান্সার রোগীর হার ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৮ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে দেশে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৪২ হাজার ৭৩১। এ সময়ে নারী ও পুরুষ ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা প্রায় সমান। নারীদের মধ্যে ক্যান্সারের রোগীর সংখ্যা ১ লাখ ২১ হাজার ২৮২ আর পুরুষদের মধ্যে এ সংখ্যা ১ লাখ ২১ হাজার ৪৪৯।

জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সদ্য বিদায়ী পরিচালক ও রেডিওথেরাপির অধ্যাপক ডা. মো. মোয়াররাফ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, মূলত পুরুষের ক্ষেত্রে ফুসফুস ও নারীর ক্ষেত্রে স্তন বা জরায়ুর ক্যান্সারের রোগী বেশি। তবে এখন অন্ননালির ক্যান্সারের রোগীও পাওয়া যাচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবার বা শুঁটকিসহ অন্যান্য খাবারে মিশ্রিত রাসায়নিক আমাদের অন্ননালি হয়ে সরাসরি পাকস্থলীতে যাচ্ছে। এতে তাত্ক্ষণিক তেমন কোনো প্রভাব না পড়লেও দীর্ঘমেয়াদে এ ধরনের খাদ্যাভ্যাস আমাদের শরীরে ক্যান্সারের মতো রোগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এজন্য খাবার গ্রহণে সচেতনতার বিকল্প নেই।

দেশে যেসব রোগের কারণে মানুষ মারা যাচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম ক্যান্সার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, বাংলাদেশে ৭৫ বছরের কম বয়সী মানুষের মধ্যে ৮ দশমিক ৬ শতাংশ রয়েছে মৃত্যুঝুঁকিতে। ২০১৮ সালে দেশে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ১ লাখ ৮ হাজার ১৩৭ জন। এর মধ্যে ৬২ হাজার ৫২০ জন পুরুষ ও ৪৫ হাজার ৬১৭ জন নারী।

এদিকে জাপানিজ জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল অনকোলজির (জেজেসিও) ক্যান্সার কন্ট্রোল ইন বাংলাদেশ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ১ কোটি ২৭ লাখ মানুষ ক্যান্সারের অণুজীব বহন করছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এটি নিউফ্লাসিয়া নামে পরিচিত। তবে অণুজীব বহন করলেও এর বড় অংশই ক্যান্সারে আক্রান্ত নয়। ২০৩০ সালে ক্যান্সারের অণুজীব বহনকারীর সংখ্যা ২ কোটি ১৪ লাখে উন্নীত হতে পারে।

ক্যান্সার প্রতিরোধে খাদ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকে কঠোর নজরদারিতে আনা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য প্রকৌশল ও চা প্রযুক্তি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. ইফতেখার আহমদ। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে অনুমোদনহীন কীটনাশক কিংবা সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি রাসায়নিক ব্যবহার হচ্ছে। এছাড়া রাসায়নিক ব্যবহারের একটা নির্দিষ্ট সময় পর সবজি বা ফল খাবার হিসেবে গ্রহণ করা উচিত হলেও সেটা মানা হচ্ছে। অনিরাপদ এসব খাবার গ্রহণই আমাদের রোগ-ব্যাধি বাড়িয়ে তুলছে, যা এক সময় মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে মানুষকে।(বণিক বার্তা)
(ঢাকারনিউজ২৪.কম/আরএম/১:৫২পিএম/১৮/১/২০২০ইং)