• ঢাকা
  • শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ০৪:৪২ পূর্বাহ্ন

কেনো মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও ভুয়ামুক্ত মুক্তিযোদ্ধা তালিকা চাই?


প্রকাশের সময় : জুন ২২, ২০১৮, ১০:০২ PM / ৩০
কেনো মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও ভুয়ামুক্ত মুক্তিযোদ্ধা তালিকা চাই?

আবীর আহাদ : উনিশশো একাত্তর সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এক রক্তাক্ত সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বীর মুক্তিযোদ্ধারা সীমাহীন শৌর্য বীর্য ত্যাগ রক্ত ও বীরত্ব দিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করেছেন । কিন্তু অতীব দু:খজনক সত্য এই যে, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলেও জাতীয় সংবিধানের মুখবন্ধ তথা প্রস্তাবনার কোথাও সেই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের কোনো কথাই নেই !

মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা ছাড়া বাংলাদেশ কল্পনাও করা যায় না । মুক্তিযোদ্ধাদের সফল মুক্তিযুদ্ধ ব্যতীত যেমন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়নি, তেমনি বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে বলেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির পিতা হয়েছেন; বাঙালিরা স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, সামরিক বাহিনীর প্রধান, কেবিনেট সচিব, মুখ্য সচিব, বড় শিল্পপতি, বড় ব্যবসায়ী প্রভৃতি হয়েছেন । দেশের একটি স্বতন্ত্র সংবিধান, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত হয়েছে । এ-ভূখণ্ডের চির গোলামির জিঞ্জির-পরা জনগণ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের গর্বিত নাগরিক হয়েছেন । এসবই সম্ভব হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের যোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের কারণে । আর এটাই ঐতিহাসিক সত্য যে, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধারা বঙ্গবন্ধুর সুমহান নেতৃত্বে তথা আওয়ামী লীগের গর্ভ থেকেই জন্মলাভ করেছে । অতএব এ-ভাবেই বলা যায় : বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা—–একে অপরের চেতনা ও ইতিহাসের পরিপূরক সত্তা । এখন সেই আওয়ামী লীগকেই তার ঐতিহাসিকতার আলোকে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনা ও মর্যাদা রক্ষা করতে হবে ।

কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিজয়ী বাংলাদেশের জাতীয় সংবিধানের দিকে নজর দিয়ে আমরা বেশ ধাক্কা খাচ্ছি । আমাদের বীরত্বে-গড়া স্বাধীন দেশের সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা শব্দদ্বয়ের উল্লেখ থাকবে না, তা কি হয় !? কিন্তু দু:খের সাথে বলতে হচ্ছে, তাই হয়েছে ।

আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনার প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : “আমরা বাংলাদেশের জনগণ উনিশশো একাত্তর খ্রীস্টাব্দের মার্চ মাসের ছাব্বিশ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে’ স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি”—–সেখানে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের কথা নেই ! আমরা বলতে চাই যে, এই অনুচ্ছেদের ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক মুক্তিসংগ্রামে’র স্থলে যদি ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে’ কথাটি লেখা হতো তাহলে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ শব্দটি মহিমান্বিত ও সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত হতো ।

অপরদিকে প্রস্তাবনার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে : “যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল” বলে উল্লেখ রয়েছে, সেখানেও মুক্তিযুদ্ধের যোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব ও অবদানের কথা নেই !

এ-অবস্থায় সংবিধানের প্রস্তাবনা মোতাবেক প্রতিভাত হয় যে, এ-দেশে কোনো সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ হয়নি বা মুক্তিযোদ্ধা বলতে কোনোকিছু নেই ! দেশটি বোধহয় আকাশ থেকে হাওয়ায় ভেসে এসেছে ! আর এ-কারণেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানান বিকৃতিসহ মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রবেশ ঘটে চলেছে ।

‘মুক্তিসংগ্রাম’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধ’ একই অর্থ বহন করে না । তাই যদি হতো তাহলে বাংলা ভাষায় এ-দু’টি ভিন্ন শব্দ সৃষ্টি হতো না । অনুরূপভাবে ইংরেজি ভাষায় এই দু’টি শব্দ এসেছে এইভাবে——Liberation Struggle (মুক্তিসংগ্রাম) ও War of Liberation (মুক্তিযুদ্ধ) । উনিশশো আটচল্লিশ থেকে উনিশশো একাত্তরের পঁচিশ মার্চ পর্যন্ত ইতিহাসের যেসব ধারাবাহিক আন্দোলন বা সংগ্রাম হয়েছিল তাকেই আমরা মুক্তিসংগ্রাম বলতে পারি । আর উনিশশো একাত্তরের ছাব্বিশ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর থেকে ষোল ডিসেম্বরের মধ্যবর্তী সময় ছিলো অতীতের মুক্তিসংগ্রামের প্রেরণায় জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষা ও সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে যে সশস্ত্র রক্তাক্ত যুদ্ধ—–সেটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধ (War of Liberation ). এই প্রক্রিয়ায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার আবির্ভাব ।

আমরা সবাই গাল ফুলিয়ে গর্বভরে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ ও ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দদ্বয় উচ্চারণ করে আসছি——অথচ সংবিধানের মূলস্তম্ভ ‘প্রস্তাবনা’য় এ-শব্দদ্বয়ের কোনোই স্বীকৃতি নেই ! এই ঐতিহাসিক ভুল তথা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের অবমূল্যায়ন করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের সৃষ্ট বাংলাদেশ চলতে পারে না ।

অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধার প্রকৃত সংজ্ঞা যা উনিশশো বাহাত্তর সালে বঙ্গবন্ধু সরকার নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন, সেই যথাযথ সংজ্ঞাটি এড়িয়ে নানান গোঁজামিলের সংজ্ঞায় রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় প্রতারণার আশ্রয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধে’র সাথে সম্পর্কহীন অ-মুক্তিযোদ্ধা, এমনকি রাজাকারদেরও ‘মুক্তিযোদ্ধা’ বানিয়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদেরকে জাতির সামনে হেয়প্রতিপন্ন করা হচ্ছে ! কোনো অবস্থায়ই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দেড়লাখের বেশি হবে না । অথচ বর্তমানে সরকারি তালিকায় এ-সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দু’লাখ ত্রিশ হাজারের ওপরে যার সত্তর /আশি হাজারই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ! আর এই সিংহভাগ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সৃষ্টি করা হয়েছিল বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে । ঐ গোঁজামিলের সংজ্ঞার আরো প্রায় দেড়লাখের মতো মুক্তিযোদ্ধা-দাবিদার অপেক্ষমান তালিকায় রয়েছে, যার নিরানব্বই ভাগই ভুয়া ! এই বিশাল সংখ্যক ভুয়ামুক্তিযোদ্ধাদের কারণে সমাজে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারাও অপমানিত হচ্ছেন এবং ঐ ভুয়াদের কারণে রাষ্ট্র তথা জনগণের বিশাল আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে ।

এ-জাতীয় ঐতিহাসিক অসংগতি, গোঁজামিল, অবমাননা ও রাষ্ট্রীয় ক্ষতি নিয়ে কি মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ চলতেই থাকবে ? প্রতিকারের কি কোনো ব্যবস্থা নেই ? নিশ্চয়ই আছে । আর আছে বলেই আমরা দাবি তুলেছি যে, জাতীয় সংসদে একটি বিল এনে সংবিধানে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ ও ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দদ্বয় সন্নিবেশিতকরণসহ মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা সুরক্ষা আইন করুন । বঙ্গবন্ধু সরকারের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার আলোকে প্রতি উপজেলা/থানাওয়ারী একটি করে ‘উচ্চপর্যায়ের বিচারবিভাগীয় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিশন’ গঠন করে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি নির্ভুল তালিকা প্রণয়ন করুন ।

নিশ্চয়ই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্যাকন্যা, আওয়ামী লীগ প্রধান, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার ইতিহাস চেতনা, সত্য ও সুন্দরকে যথাযথ মূল্য দিয়ে উপরোক্ত বিষয়াবলি সুবিবেচনায় নিয়ে আরেকটি ইতিহাস সৃষ্টি করবেন। তবে এর ব্যত্যয় ঘটলে তা হবে খুবই দু:খজনক।

আবীর আহাদ
লেখক-গবেষক
আহ্বায়ক, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা

(ঢাকারনিউজ২৪.কম/আরএম/১০:০০পিএম/২২/৬/২০১৮ইং)