• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ০৭:৫৬ পূর্বাহ্ন

কুড়িগ্রামে গরিবের বরাদ্দের টাকা ডাকাতি


প্রকাশের সময় : অক্টোবর ১৩, ২০২২, ৪:৪৫ PM / ৪৮
কুড়িগ্রামে গরিবের বরাদ্দের টাকা ডাকাতি

আতাউর রহমান বিপ্লব, কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামের উলিপুরে ‘নদীভাঙ্গন কবলিত এলাকার জনসাধারণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পুনর্বাসন সহায়তা’ প্রকল্পের প্রায় ১ কোটি ১৫ লাখ টাকার তিনভাগ টাকা ‘দিনে ডাকাতির’ মত কেটে নিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামীগ নেতা, ইউপি সদস্য ও চেয়ারম্যানের নিয়োজিত ক্যাডাররা। জুলুমের শিকার সহায়তার তালিকাভুক্ত মানুষজনের অভিযোগ, টাকা কেটে নেয়ার সময়, উপজেলার জনপ্রতিনিধি ও কর্মকর্তারদের নামও উল্যেখ করেছেন জোর করে টাকা আদায়কারি ক্যাডাররা।
অভিযোগ অনুযায়ী বরাদ্দকৃত টাকা কারো ৭৫ হাজার টাকার মধ্যে ৫০ হাজার, কারো ৬০ হাজার টাকার মধ্যে ৪০ হাজার ও কারো ৫০ হাজার টাকা থেকে ৩০ করে টাকা কেটে নেয়া হয়েছে।

এসব টাকা জোর করে কেটে নেয় উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম, পিতা আব্দুল লতিফ, হাতিয়া ইউপি সদস্য হাফিজুর রহমান ও তার ছোট ভাই মোখলেছুর রহমান, পিতা তৈয়ব আলী।
সোমবার ১০ অক্টোবর, উলিপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন জুলুমের শিকার তালিকাভুক্ত মানুষজন।

প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার অফিস সুত্র জানায় ‘নদীভাঙ্গন কবলিত এলাকার জনসাধারণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পুনর্বাসন সহায়তা’ হিসাবে উপজেলায় ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ আসে। এসব টাকা ২১০ টি পরিবারের মাঝে বরাদ্দ দেয়া হয়। পাঁচের অধিক পরিবারের সদস্যদের পরিবারের জন্য ৭৫ হাজার, পাঁচ সদস্যের পরিবারের ৬০ হাজার ও চার সদস্যের পরিবারে জন্য ৫০ হাজার টাকা। এরমধ্যে উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নে ৩০ জন, থেতরাই ইউনিয়নে ৩২ জন, দলদলিয়া ৩৩, বেগমগঞ্জ ইউনিয়নে ৯০ জন ও বজরা ইউনিয়নে ২৫ জনের নামে এই টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়।

আজিজুল হক, পিতা-দেয়ানত উল্যা, গ্রামঃ হাতিয়া বকশী, ওয়ার্ড নং-০৯ জানান, ‘আমি গত ২ সেপ্টেম্বর তারিখে উলিপুর কৃষি ব্যাংক থেকে ৭৫ পঁচাত্তর হাজার টাকা উত্তোলন করি। ব্যাংক থেকে বের হওয়ার সময় হাতিয়া ইউনিয়নের আওয়ামীলীগের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম, পিতা- আব্দুল লতিফ তিনি ৭৫ হাজার টাকা সমুদয় নিয়ে নেন। আমি বাধা দিলে ২৫ হাজার টাকা আমাকে দিয়ে বাকী ৫০ হাজার টাকা নিয়ে আমাকে ধমক দিয়ে বিদায় দেয়। তিনি আরো বলেন, ‘টাকাগুলা দিন ডাকাতি করি নিলে বাহে’।

আব্দুর রহিম, পিতা- কাশেম আলী, গ্রাম: হাতিয়া বকশী, ওয়ার্ড নং-০৯, জানান, ‘আমি গত ২৮ সেপ্টেম্বর তারিখে আমার নামে বরাদ্দ সরকারি সাহায্যের ৭৫ হাজার টাকা উত্তোলনের জন্য উলিপুর কৃষি ব্যাংকে আসি। টাকা উত্তোলনের পর স্থানীয় আওয়ামীলীগের যুগ্ন সম্পাদক আমিনুল ইসলাম টাকাগুলো আমার হাত থেকে নিয়ে নেয়। আমি প্রতিবাদ জানালে তিনি বলেন, এই টাকা হাতিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, উপজেলা, কৃষি ব্যাংক কর্মকতার্, ইউএনও, জনপ্রতিনিধিদের দিতে হবে। এরপর আমাকে ধমক দিয়ে ২৫ হাজার টাকা দেন ও ৫০ হাজার টাকা আমিনুল নিয়ে নেন। একই ভাবে আমার আপন ভাই রাজু মিয়ার কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা জোর করে কেটে নেয়।

সিরাজুল ইসলাম, পিতা :আজিজল, গ্রাম: হাতিয়া বকশী, ওয়ার্ড নং-০৯ জানান, ‘গত ২৮ সেপ্টেম্বর আমার নামের বরাদ্দের ৭৫ হাজার টাকা উত্তোলনের জন্য কৃষি ব্যাংকে আসি। টাকা উত্তোলনের পর হাতিয়া ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের যুগ্ন সম্পাদক, আমিনুল ইসলাম টাকাগুলো আমার হাত থেকে নিয়ে নেন। এরপর ওই টাকা থেকে ২৫ পঁচিশ হাজার টাকা দেন। বাকী ৫০ হাজার টাকা কেটে নিয়ে আমাকে ধমক দিয়ে বিদায় দেয়।

শামছুল আলম, পিতা মৃত- বাবর আলী, গ্রাম: নয়াদ্বারা, ওয়ার্ড-০৯ জানান, ‘আমি গত ২৮ সেপ্টেম্বর সকালে আমার নামে বরাদ্দকৃত সরকারি টাকা উত্তোলনের জন্য কৃষি ব্যাংকে আসি। ৭৪ হাজার ছয়শত টাকা উত্তোলনের পর, হাতিয়া আওয়ামীলীগের যুগ্ন সাধারন সম্পাদক আমিনুল ইসলাম ব্যাংকের পাশে ‘ছ’ মিল সংলগ্ন একটি গুদামে আমাকে ডেকে নিয়ে যায়। উত্তোলনকৃত ৭৪ হাজার ৬০০ টাকার মধ্যে ২৭ হাজার টাকা আমাকে দেয়। বাকী টাকা আমিনুল নিয়ে নেয় এবং আমাকে বলে, নয়া চেয়ারম্যান কে দিতে হবে। উপজেলা চেয়ারম্যানকে দিতে হবে এবং ধমক দিয়ে আমাকে বিদায় দেয়।

নুরবক্ত মিয়া পিতা-রহমতুল্যা, গ্রাম: চর অনন্তপুর (বাবুর চর), ওয়ার্ড-০৪ জানান, ‘গত ২৮সেপ্টেম্বর আমার নামে সরকারি বরাদ্দকৃত ৫০ প াশ হাজার টাকা উত্তোলনের জন্য কৃষি ব্যাংকে আসি। টাকা তোলার পর ব্যাংক থেকে বের হওয়া মাত্র আমাকে স্থানীয় মেম্বার হাফিজুর রহমান, (ওয়ার্ড নং-০৩) পাকরাও করে। এরপর আমাকে অটো বাইকে তুলে, অনন্তপুর বাজারের দক্ষিণ পার্শ্বে তার এক আত্নীয়ের বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে ২০ হাজার টাকা দিয়ে বাকী ৩০ হাজার টাকা নিয়ে যায়। প্রতিবাদ জানালে আমাকে হুমকি প্রদান করে’।

শহিদুর রহমান, পিতা- কেনু শেখ, গ্রাম: বাবুর চর, ওয়ার্ড-০৪ জানান, ‘আমি গত ২৮ সেপ্টেম্বর আমার নামে বরাদ্দকৃত ৬০ ষাট হাজার টাকা উত্তোলনের জন্য কৃষি ব্যাংকে আসি। টাকা তোলার পর ব্যাংক থেকে বের হলে, হাফিজুর মেম্বারের ভাই মোখলেছুর রহমান, ওয়ার্ড-০৩, আমার কাছ থেকে ৬০ হাজার টাকা নিয়ে নেয়। হাফিজুর মেম্বারের উপস্থিতিতে তার ছোট ভাই মোখলেছুর রহমান আমাকে ২০ হাজার টাকা ফেরত দিয়ে ৪০ হাজার টাকা নিয়ে নেয়। আমি বাকী টাকা চাইলে বলে, ‘এই টাকা হাতিয়ার চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, ব্যাংক কর্মকর্তা, ইউএনও, বিভিন্ন নেতাকে ভাগ দিতে হবে’।

ফুল বাবু, পিতা মৃত কলিম উদ্দিন, গ্রাম: চর অনন্ত, ওয়ার্ড-০৪ জানান, ‘গত ২৮সেপ্টেম্বর তারিখে আমার নামে সরকারি সাহায্যের বরাদ্দকৃত ৬০ হাজার টাকা উত্তোলন করি। ব্যাংক থেকে বের হওয়ার পর স্থানীয় ইউপি সদস্য ওয়ার্ড-০৩, হাফিজুরের ছোট ভাই মোখলেছুর রহমান, আমাকে অটো বাইকে তুলে নেন। এরপর অনন্তপুর বাজারের পশ্চিম দক্ষিনে একটি বাড়িতে নিয়ে আসে। সেখানে আমার টাকাগুলো নিয়ে ২০হাজার টাকা ফেরত দেয়। বাকি ৪০ হাজার টাকা জোর করে নিয়ে নেয়। সেখানে হাফিজুর মেম্বার উপস্থিত ছিলেন।

মোঃ লুৎফর রহমান, পিতা কেনু শেখ, গ্রাম: গ্রাম বাবুর চর জানান, ‘গত ২৮ সেপ্টেম্বর তারিখে আমার নামে বরাদ্দের ৬০ হাজার টাকা কৃষি ব্যাংক থেকে তুলি। টাকা তোলার পর হাফিজুর মেম্বারের ছোট ভাই মোখলেছুর রহমান টাকা সহ আমাকে অটো বাইকে তুলে নেয়। এর পর অনন্তপুর বাজারের দক্ষিন পশ্বিম একটি বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে ২০ হাজার টাকা আমাকে দিয়ে বাকী ৪০ টাকা নিয়ে নেয়। টাকা দিতে না চাইলে আমাকে ধমক দেয়।

মুকুল মিয়া, পিতা- রহমতুল্যা, গ্রাম: গ্রাম: চর অনন্তপুর, ওয়ার্ড-০৪ জানান, ‘গত ২৮ সেপ্টেম্বর তারিখে উলিপুর কৃষি ব্যাংক থেকে ৫০ হাজার টাকা উত্তোলন করি টাকা তোলার পর হাফিজুর মেম্বারের ভাই মোখলেছুর রহমান, ওয়ার্ড-০৩, জোর করে আমাকে অটো বাইকে তুলে নেয়। এর পর আমাকে সহ ১১ জনকে অনন্তপুর বাজারের দক্ষিন পশ্চিমে একটি বাড়িতে নিয়ে যায়। তারা আমার ৫০ হাজার টাকা থেকে ৩০ হাজার টাকা নিয়ে নেয় এবং আমাকে ২০ হাজার টাকা ফেরত দেন। প্রতিবাদ করলে মামলায় ফেলার হুমকি দেন।
আবু সাইদ, পিতা: মোঃ আবু বক্কর, গ্রাম: চর অনন্তপুর (বাবুর চর) বলেন, ২৮ সেপ্টেম্বর আমার নামের সরকারি বরাদ্দের ৫০ হাজার টাকা কৃষি ব্যাংক থেকে উত্তোলন করি। টাকা উত্তোলনের পর হাফিজুর মেম্বারের ভাই মোখলেছুর রহমান, ওয়ার্ড-০৩, জোর করে আমাকে অটোবাইকে তুলে নেয়। এরপর তারা আমাকে সহ ১১ জনকে অনন্তপুর বাজারের দক্ষিন পশ্চিমে একটি বাড়িতে নিয়ে যায়। তারা আমার ৫০প াশ হাজার টাকা থেকে ৩০ হাজার টাকা নিয়ে নেয় এবং আমাকে ২০ হাজার টাকা ফেরত দেন। এরপর তারা আমাকে হুমকি দিয়ে বিদায় দেন।

জোর করে টাকা আদায়ের বিষয়টি আস্বীকার করেছেন ইউপি সদস্য হাফিজুর রহমান। তিনি বলেন এই অভিযোগ মিথ্যা।
হাতিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম বলেন, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পুর্ণ মিথ্যা। তিনি এ ধরনের ঘটনার সাথে জড়িত নন।
টাকা আদয়ের বিষয়টি জানেন না বলে জানিয়েছেন হাতিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাইখুল ইসলাম নয়া।
এ ব্যাপারে উলিপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সিরাজ উদ দৌলা জানান, টাকা আদায়ের ঘটনা তিনি শুনেছেন। ‘এটা কমন বিষয়। আপনারা এটা লিখে কোন বেড়া দিতে পারবেন না’।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ইউনিয়ন চেয়ারম্যান জানান, এই আদায়ের বিষয়টি একটি ‘চেইন’। এরসাথে চেয়ারম্যান , মেম্বার, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাসহ অনেকে ভাগের অংশীদার।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার বলেন, তিনি সদ্য যোগদান করেছেন। তার সময়ে এ বরাদ্দ কিংবা এ সংক্রান্ত বিষয়ে স্বাক্ষর করেন নাই। বিষয়টি নিয়ে তিনি অবগত নন। একটি অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিষয়টি দেখবেন বলে তিনি জানান।

উলিপুরের সংসদ সদস্য এম এ মতিন বলেন, ‘এই অর্থ আদায়ের সাথে যারা জড়িত, তারা যে দলেরই হোক- তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা উচিত’ বলে তিনি মন্তব্য করেন।