• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ০৫:০৯ পূর্বাহ্ন

এক ইউনিয়নে ৫ হাজার পুকুর খনন : কমছে ৮শ’ হেক্টর কৃষি জমি


প্রকাশের সময় : জুলাই ১৩, ২০১৮, ১০:৫২ PM / ৩৭
এক ইউনিয়নে ৫ হাজার পুকুর খনন : কমছে ৮শ’ হেক্টর কৃষি জমি

শের মোহাম্মদ, গুরুদাসপুর (নাটোর) : আজ থেকে পাঁচ বছর আগেও মাঠের পর মাঠ ছিল সবুজে ঘেড়া। ভুমিহীনরা তখন কিছু জমি লিজ নিয়ে ফসল উৎপন্ন করতেন বছর জুড়েই। তাতেই জীবনজীবিকা চলতো গ্রামের কৃষিজীবি মানুষগুলোর। এখনো ঠাঁয় পড়ে আছে ওইসব জমি। এখন আর মাঠভরা সবুজ ফসল দেখা যায়না। বদলেগেছে মাঠের চিত্র। বাধ্যহয়ে কৃষকের পেশা পরিবর্তন করতে হচ্ছে। দরীদ্র ভুমিহীনরা চালাচ্ছে ভ্যান-রিক্সা। আর প্রান্তিক কৃষকদের পাঁচ বছর আগের ফসলি জমি এখন এলাকার প্রভাবশালীদের দখলে। সেসব জমিতে আর চাষাবাদ হয়না। আপাত দৃষ্টিতে যতদুর চোখ যায় মাটির উঁচু উঁচু পাড়। এসব পাড় ঘেরা একটার পর একটা পুকুর। অবৈধভাবে পুকুর খনন করায় শুধু যে কৃষকের ফসলি জমি হারাতে হচ্ছে তা নয়। সরকারী খাস খতিয়ানের জমিও রেহাই পাচ্ছেনা। তবুও প্রসাশন নিরব-নির্বীকার। বর্তমানে উপজেলাজুড়ে পুকুরের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ হাজারে যার বেশিরভাগ পুকুর খনন করা হয়েছে চাপিলা ইউনিয়ন জুড়ে। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, প্রায় ৫ হাজার পুকুর রয়েছে শুধু ওই ইউনিয়নেই।

জলাবদ্ধতার কবলে চাপিলাঃ চাপিলা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তথ্যমতে, এই ইউনিয়নে আয়তনের তিন শতাংশ কৃষি জমিই এখন পুকুর। স্থানীয় চেয়ারম্যান আলাল উদ্দিন ভুট্ট বলেন, তার ইউনিয়নের মহারাজপুর, কান্দাইল, বৃ-চাপিলা, গযেন্দ্র চাপিলা, পম-পাথুরিয়া, গরিলা, খিদির গরিলা, খিদির চাপিলা, বৃ-পাথুরিয়া, খামার পাথুরিয়াসহ এলাকায় প্রায় ৫ হাজার পুকুর খনন করা হয়েছে। এসব পুকুরে বিষাক্ত খাদ্যে চাষ করা মাছ মরে গন্ধ ছড়াচ্ছে। ফলে স্থানীয় বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে। সামান্য বৃষ্টিতে গ্রামের পাকা সড়ক, মেঠোপথ এমনকি ঘরবাড়ি ডুবে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীসহ জন-জীবনে। চাপিলা ইউনিয়নের স্থানীয় বাসিন্দারা জানান,-প্রসাশনের তৎপরতা না থাকায় পুকুর খনন বন্ধ হয়নি। চাপিলা ইউনিয়নের প্রতিটি বিলের জমিতেই তিন ফসল উৎপন্ন হতো। বছরজুড়েই নানা ধরনের মওসুমি ফসল উৎপন্ন করতেন কৃষক। তাছাড়া পুকুরের মাটি বহনকারী ট্রাক্টরের যত্রতত্র চলাচলে গ্রামিণ সড়কগুলোও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
গুরুদাসপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, পুকুর শুধু যে জনজীবন বিষিয়ে তুলছে তা নয়। পুকুরের কারনে মারাত্মক ফসলহানীর ঘটনা ঘটছে। বিগত পাঁচ বছরে গুরুদাসপুর উপজেলার বিলগুলোর প্রায় সাড়ে নয়শ হেক্টর ফসলি জমি কমেছে। তথ্যমতে, ২০১১ সালেও গুরুদাসপুর উপজেলাজুড়ে ফসলি জমির পরিমান ছিল ১১৬৬০৯ হেক্টর। ওই সালে ৭০ হেক্টর, ২০১২ সালে ৮০ হেক্টর, ২০১৩ সালে ৯৫, ২০১৪ সালে ১৫, ২০১৫ সালে ১৫০, ২০১৬ সালে ১৯০, ২০১৭ সালে ১৭৫ হেক্টর জমি কমেছে। কমে যাওয়া জমির শ্রেণী পরিবর্তন না হলেও এখন পুকুর।

পুকুরের সঠিক হিসাব নেই, মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের চলতি বছরের জরিপ অনুযায়ী গুরুদাসপুর উপজেলাজুড়ে বেসরকারী পুকুরের হিসাব দেওয়া হয়েছে ৫৪৩৫টির। সরকারী রয়েছে ৩২টি। উপজেলা মৎস্য অফিসের চালানো ২০১৭ সালের একটি জরিপে দেখা গেছে, সেসময় উপজেলায় বেসরকারী পুকুরের সংখ্যা ছিল ৪৬৪৯ টি। এসব পুকুরের জলায়তন ছিল ৯৩৬৭ হেক্টর জমি। এই জরিপের পর ২০১৭ সাল থেকে চলতি বছরের শুরুর দিকে ৮৬টি পুকুর নতুন করে খনন করা হয়েছে। এরপর যে পুকুর খনন করা হচ্ছে তার কোন হিসাব নেই।

সরেজমিনে উপজেলার বিভিন্ন বিল এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সরকারী আর ব্যক্তি মালিকানা মিলে পুকুর খনন করা হয়েছে শত শত হেক্টর জমিতে। উপজেলার মশিন্দা ইউনিয়নের রানীগ্রাম, হাাঁসমারী বিলে দেখা গেছে সরকারের খাস জমিদখল করে পুকুর খনন করা হচ্ছে। পৌর সদরের দক্ষিণ নারিবাড়ি বিলে পানি চলাচলের কালভার্ট বন্ধ করে পুকুর খনন চলছে। ধারাবারিষা ইউনিয়নের সোনাবাজু উচ্চ বিদ্যালয় ঘেঁষে পুকুর খনন করা হয়েছে। চাঁপিলা ইউনিয়নের সড়কগুলো ডুবে গেছে। জলাবদ্ধ রয়েছে শত শত বিঘা জমি। সবমিলিয়ে উপজেলায় পুকুরের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় পনের হাজারের মতো। এছাড়া বিয়াঘাটের হাঁড়িভাঙ্গা বিলে খনন করা হয়েছে প্রায় ৫০টিরও বেশি পুকুর। চাকলের বিলের সৌদর্য্য শেষ করে চলছে ওই সকল পুকুর খনন। এসব এলাকায় এখনও পুকুর খনন চলছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আব্দুল করিম বলছেন, ৫১২ একর আয়তনের হাঁড়িভাঙ্গা বিলটিতে বোরো ৭২০ মেট্রিকটন, রোপা আমন ২১২ মে.টন ও বোনা আমন ৩৭৫ মে.টনসহ মোট প্রায় ১৮০০ মে.টন আবাদ হয়। বর্ষাকালে বিলটি তলিয়ে গেলেও সেখানে বোনা আমন ও উঁচুতে রোপা আমনের আবাদ হয়-বছর জুড়েই। অথচ নিয়মনীতি উপেক্ষা করে এই বিলে নির্বিচারে ৫০টিরও বেশি পুকুর খনন করায় আশঙ্কাজনক হাড়ে কমছে ফসলি জমি। নিচু জমিগুলোতে সৃষ্টি হচ্ছে স্থায়ী জলাবদ্ধতা। শুধু হাঁড়িভাঙ্গা বিল নয়। চাঁপিলাসহ উপজেলাজুড়ে বিগত পাঁচ বছরে হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমি কমেছে পুকুর খননের কারনে। এতে কৃষকের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সরকার।

চাষি আবুল মিয়া, আখের আলী ও মুনছের মৃধাসহ অন্তত দশজন চাষি জানালেন, পুকুর খনন বন্ধে যোগেন্দ্রনগর, বিলহরিবাড়ি, সাবগাড়িসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের কৃষকরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর অভিযোগ দিয়েছিলেন। কিছুদিন পুকুর খনন বন্ধ থাকলেও পরে আবার শুরু হয় ফসলি জমি ধ্বংসযজ্ঞ। এখন আনাচে-কানাচে শুধু পুকুর আর পুকুর।

আবু তাহেরসহ হাঁড়িভাঙ্গা বিলে জমি থাকা অন্তত ১৫জন কৃষক জানান, পুকুরের পাড়গুলো উঁচু হওয়ার কারনে সাধারন কৃষকের কৃষি জমিগুলো নিচে পড়েছে। তাদের জমিতে চলাচলের পথ বন্ধ। চাষের লাঙল, সার-কীটনাশক নিয়ে যাওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। পানি নিষ্কাশনের পথগুলো সংকুচিত হয়ে পড়ায় জমে থাকা পানি নামতে পারছে না। এখন বিলে স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বছর জুরেই এসব জমিতে কোন প্রকার চাষাবাদ করা সম্ভব হচ্ছে না। গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহম্মদ মনির হোসেন বলেন, পুকুর খনন বন্ধে প্রশাসন তৎপর রয়েছে।

সর্বশেষ নাটোর জেলা আ.লীগের সভাপতি গুরুদাসপুর-বড়াইগ্রাম আসনের সাংসদ অধ্যাপক মোঃ আব্দুল কুদ্দুস গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সহকারী কমিশনার (ভূমি), থানার অফিসার ইনচার্জসহ উপজেলার পুকুর খনন বন্ধে কয়েকটি গ্রামে অভিযান চালিয়েও পুকুর খনন বন্ধ করতে পারেননি।

(ঢাকারনিউজ২৪.কম/এসডিপি/১০:৪৫পিএম/১৩/৭/২০১৮ইং)